সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

খলীফা মুতাসিম ও এক বন্দী মুসলিম নারী


আব্বাসীয় খলীফা মুতাসিম বিল্লাহ মসনদে বসে পানি পান করার জন্য সবেমাত্র গ্লাস হাতে নিয়েছেন। এরমধ্যে দরবারে হাজির হয়ে একজন জানালো আমীরুল মুমিনীন! সীমান্তে রোমানরা আক্রমণ করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। অসংখ্য মুসলিম নারীর ইজ্জত লুন্ঠন ও তাদের বন্দী করে নিয়ে গেছে।
একজন নারী ভীত হয়ে বারংবার খলিফার নাম ধরে কাঁদছিলেন। সেই নারী ওয়া মু’তাসিমা, ওয়া মু’তাসিমা (হায় মু’তাসিম, হায় মু’তাসিম) বলে চিৎকার করছিলেন । মুতাসিম তোমার বোন খৃস্টানদের হাতে আজ লাঞ্ছিত!
খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ মুসলিম নারীর দুর্দশার কথা শুনে স্থির থাকতে পারলেন না। খলীফা হাত থেকে পানির গ্লাস ছুড়ে ফেলেন এবং মুতাসিম উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, লাব্বাইক (আমি আপনার ডাকে হাজির)। তিনি জরুরী ভিত্তিতে যুদ্ধের আহবান করলেন। ইবনে খালদুন লিখেছেন, ‘এই কথা শুনে মুতাসিম লাব্বাইক লাব্বাইক বলে সিংহাসন থেকে দাঁড়িয়ে যান। তিনি তখনই যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘোষণা দেন। দ্রুত তিনি আলেম ও আমিরদের ডেকে পাঠান। বাগদাদের কাজি আবদুর রহমান বিন ইসহাকও উপস্থিত হন। খলিফা সবার সামনে নিজের সম্পদের তালিকা করেন। সম্পদ তিন ভাগ করে এক ভাগ সন্তানদের জন্য, আরেক ভাগ খাদেমদের জন্য এবং অপরভাগ ওয়াকফ করে দেন। কাগজপত্র লিখে ফেলা হয় ।এ বন্দিনীকে উদ্ধার কল্পে তিনি যুদ্ধের সাজে বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্তুত করলেন।ইবনে কাসির লিখেছেন, ‘খলিফা এমন বাহিনী প্রস্তুত করেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ করতে সক্ষম হয়নি। বাহিনীর সাথে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও জিনিসপত্র নেয়া হয়। এত বেশি সরঞ্জাম নেয়া হয় যার কথা ইতিপূর্বে কেউ শোনেওনি । মূল ঘটনা হলো -
আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিম বিল্লার সঙ্গে বিদ্রোহ করে বাবুক খুররাম নাম এক মুসলিম সেনাপ্রধান। এই বাবুক খুররাম আব্বাসীয়দের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য রোমান সম্রাট নওফিল বিন মিকাইলকে তাগাদা দিতে থাকেন। নওফিল বিন মিকাইল যখন দেখলো বিশ্বাসঘাতক সহযোগী পাওয়া গেছে- তখন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। নওফিল এক লক্ষ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে মুসলিম ভূণ্ডের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করে। এরই এক পর্যায়ের তুরস্কের মালাতিয়া ও সিরিয়ার জিবিত্রা সীমান্তে বর্ণনাহীন রক্তপাত ঘটায়। নওফিলের এই অতর্কিত হামলায় অনেক নিরীহ ও সাধারণ মুসলমান শাহাদতবরণ করে। গোলকিবিহীন গোলাবারের মতো শুধু গোল করতেই থাকে। এই সময় শতশত মানুষকে শাহাদাত করে দেয় এবং নারী ও শিশুদের বন্দি করে ইউরোপ নিয়ে যায়।
এদিকে আল মুতাসিমের যুদ্ধের প্রস্তুতিতে লোকেরা বলাবলি করছিল বিষয়টি কি?
তাদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন-
আমার কাছে সংবাদ পৌছেছে, রোমান শহরে এক মুসলিম নারীর উপর আক্রমণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন-
আল্লাহর কসম, আমি এই উদ্ধারকল্পে এমন এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করব যার সম্মুখভাগ যখন রোমানদের উপর চড়াও হবে তখন তারা নিজ ঘাটি থেকে বের হতে থাকবে। খলিফা পৌঁছার পূর্বেই নওফেল বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে পালিয়ে যায়। খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ স্থানীয়দের সান্তনা দেন।আমাকে বলুন রোমানদের শক্তিশালী ঘাটি কোনটি? আমি সেখানেই সৈন্য প্রেরণ করব।"
জবাবে স্থানীয়রা জানায় আমুরিয়া। আমুরিয়া হলো বর্তমান তুরস্কের আঙ্কারার আপশাশের একটি এলাকা। তৎসময় যা কনস্টান্টিপলের অধীনস্থ ছিল। অতঃপর খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ২২৩ হিজরির ৬ই রমজান মাসে আমুরিয়া আক্রমণ করেন। মুর্হর্তেই খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহর বাহিনীর সামনে আমুরিয়ার রাজপ্রাসাদ ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। আমুরিয়ার জুড়ে ধ্বংসের জোয়ার উঠে। কোনো খৃস্টান সৈন্য সেই আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারেনি। খলিফা মুসলিম বোনের প্রতিশোধ তীব্রতায় প্রায় পাগলপারা হয়ে যান। তিনি রাগে ক্ষোভে পুরো আমুরিয়া শহরটিকে জ্বালিয়ে দেন। রোমান সম্রাট নওফেল কোনো মতে পালিয়ে সেই বারের মতো বেঁচে যায়। তখন থেকে আমুরিয়ায় বুকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়।
একজন বোনের ভালবাসায় এ ছিল খলিফার তড়িৎ সাড়া দেওয়ার নমুনা।যখন মু’তাসিমের বাহিনী রোমানদের পরাজিত করল তাৎক্ষণিক তিনি জেল খুলে নিজে সেই বোনকে মুক্ত করে আনলেন। অতঃপর যখন নারীটি তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল, তিনি হাসি মুখে জানালেন।
“বোন, আমি আপনার ডাক শুনতে পেয়েছি।”
রোমানদের হাতে একজন মুসলিম নারীর বন্দীত্ব বরদাশত করতে না পেরে খলিফা মুতাসিম তার উদ্ধারকল্পে নিজের সমগ্র সেনাবাহিনীই প্রেরণ করেছিলেন।সেই যুদ্ধকে আমুরিয়ার যুদ্ধ বলে।
তিনি ছিলেন ইসলাম ও মুসলিম নর ও নারীর সম্মান রক্ষার্থে নিয়োজিত শাসকদের এক অনন্য উদাহরণ। হত্যা নির্যাতনের শিকার মুসলিম নারীরা আজও চিৎকার করে বলে,
খলীফা মুতাসিম .. তুমি কোথায়?
মুহাম্মদ বিন কাসিম... তুমি কোথায়?
তারিক বিন জিয়াদ তুমি ...কোথায়?
কিন্তু মুতাসিম,বিন কাসিম, তারিক পাবে কোথায়!
কাজী নজরুল ইসলাম তাই মুসলিম জাতির দুঃখ দূর্দশা দেখে আক্ষেপ করে বলেন,
আনোয়ার! আনোয়ার!
যে বলে সে মুসলিম – জিভ ধরে টানো তার!
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার!
আনোয়ার! ধিক্কার!
কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার –
তলওয়ারে শুধু যার স্বাধীনতা শিক্ষার!
যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিকদার
আনোয়ার! ধিক্কার!
আল্লাহ তায়ালা বলেন -'আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।'( সুরা নিসা আয়াত -৭৫)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...