গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের আইনের প্রতি শ্রদ
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) বাংলার প্রথম ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান। তাঁর প্রকৃত নাম আজম শাহ। সিংহাসন আরোহণের পর তিনি গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ নাম ধারণ করেন। তিনি নিজে বিদ্বান ও কবি ছিলেন এবং বিদ্বান লোকদের খুব সমাদর করতেন। মাঝে মাঝে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ আরবি ও ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। একবার তিনি হাফিজের নিকট কবিতার একটি চরণ লিখে পাঠান এবং কবিতাটিকে পূর্ণ করার জন্য কবিকে অনুরোধ জানান।গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ তাঁকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণও জানান। হাফিজ দ্বিতীয় চরণটি রচনা করে কবিতাটি পূর্ণ করে পাঠান। তিনি সুলতানের নিকট একটি গজলও লিখে পাঠান। নিমন্ত্রণ করার জবাবে হাফিজ সুলতানকে যে গজল রচনা করে পাঠান।
"শক্কর শিকন শওন্দ হমাঃ তূতিয়ানে হিন্দ।
যী কন্দে ফারসী কেঃ ব-বঙ্গালাঃ মী রওদ॥
হাফিয যে শওকে মজ্লিসে সুলতানে গিয়াস্দীন।
গাফিল ম-শও কেঃ কারে তূ আয নালাঃ মী রওদ॥"
ভারতের তোতা হবে মিষ্টি-মুখো সকল-ই,
ফারসীর মিছরী যবে বাঙ্গালায় চলিছে।
হে হাফিয! গিয়াসউদ্দিন শাহের সভার বাসনা
ছেড়ো না, কাজ তোমারি কাঁদা-কাটায় চলিছে। "
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলা সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচনা করেন। সম্ভবত সুলতান কৃত্তিবাসকেও বাংলায় রামায়ণ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ কেবল শাসক ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ধার্মিক, ন্যায় পরায়ণ এবং সুবিচারক শাসক। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ইসলামি শরিয়ার নিয়ম কানুন পালন করতেন। রিয়াজ-উস-সালাতিনে সুলতানের ন্যায় বিচারের একটি কাহিনী রয়েছে। একদিন তীর ছোঁড়াবার সময় সুলতানের অজান্তে এক বিধবা মহিলার ছেলের গায়ে সুলতানের তীরের আঘাত লাগলো। কাজী সিরাজ উদ্দিন এর কাছে বিধবা মহিলা গিয়ে নালিশ জানালো। কাজী সিরাজ উদ্দিন সুলতানকে বিচারালয়ে ডেকে আনার জন্য এক পেয়াদাকে পাঠালেন। এই দিকে কাজী বিচারাসনে বসার আগে আসনের তলায় একটি বেত রেখে দিলেন।
সুলতানের প্রাসাদের কাছে পৌঁছে পেয়াদা দেখল সুলতানের কাছে পৌছানো এত সহজ নয়। তাই সে চিন্তা করতে লাগলো কি করে সহজে সুলতানের নজরে আসা যায়। এ নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে অবশেষে তার মাথায় একটু বুদ্ধি বের হলো।
পেয়াদা আযান দিতে আরম্ভ করলো যদিও তখন নামাজের সময় ছিল না। এই আযান আবার সুলতানের কানে গেল। অসময় আযান শুনে সুলতান মুয়াজ্জিনকে তার কাছে হাজির করার হুকুম দিলেন। পেয়াদাকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো। সুলতান তাকে অসময়ে আজান দেয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলো। পেয়াদা তখন বিনয়ের সাথে বলল, ”আপনি নাকি এক বিধবা মহিলার ছেলেকে তীর মেরে আহত করেছেন। কাজী আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে আদালতে হাজির করতে। আপনার কাছে সহজে পৌঁছাতে না পেরে অসময় আজান দিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন আপনি বিচারালয় চলুন?”
সুলতান আজম শাহ তখন তার বগলের নিচে একটি ছোট তলোয়ার লুকিয়ে নিয়ে কাজীর আদালতে হাজির হলেন। সুলতান কে কোন রকম সম্মান না দেখিয়ে, কাজী বিধবাকে হুকুম দিলেন, ”এই মহিলা আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে, তার মনে সান্ত্বনা দিন।”
সুলতান তখন সে বিধবাকে যথেষ্ট টাকা পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করে দিলেন। কাজী সাহেব বিধবা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ”তুমি কি ক্ষতিপূরণ পেয়েছ, খুশি মনে অপরাধীকে ক্ষমা করেছো?” বিধবা উত্তরে বলল, ”হ্যাঁ হুজুর, আমি খুশি হয়ে সুলতান কে ক্ষমা করেছি।”
তখন কাজী মহাআনন্দে উঠে দাঁড়ালেন এবং সুলতান কে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে আসনে বসালেন। সুলতান তখন তার তলোয়ার বের করে বললেন, ”কাজী সাহেব আইনের হুকুম মেনে আপনার আদালতে হাজির হয়েছি। আজ যদি আপনি আইনের বিধান না মেনে আমার পক্ষপাত করতেন, তাহলে এটি দিয়ে আপনার মাথা কেটে দুই ভাগ করে ফেলতাম। শুকরিয়া আল্লাহর আপনি ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হয়েছেন।”
কাজিও কম যান না। তিনি তাঁর বিচারাসনের নিচের থেকে বেতটি বের করে বলেন, ”হুজুর শরীয়তের বিধান মতে বিচারের আদেশ অমান্য করলে আপনার প্রাপ্য শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত। আল্লাহর কসম আপনি যদি পবিত্র আইনের বিধান পালন করতে ইতস্তত করতেন, তাহলে আমি এই বেত দিয়ে আপনার পিঠে আঘাত করতে এক মুহুর্ত বিলম্ব করতাম না। যাই হোক আমার উপর একটি বিপদ এসেছিল। আল্লাহর হুকুমে বিপদ কেটে গেছে।”
কাজী অবশ্য জানতেন সুলতানকে বেত্রাঘাত করলে তার প্রাণপাতের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এত কিছুর পরেও ন্যায়পরায়ণ কাজীর কাছে তার জীবনের চেয়ে বড় ছিল আইনের মর্যাদা।
স্যার উইন্সে হেগ এ কাহিনীকে ইংল্যান্ডের রাজা হেনরী এবং বিচারক কুইনের ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন। এই বিচারের দৃষ্টান্ত যদি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে কত না নিরপরাধ মানুষের জীবন বেঁচে যেতো। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে স্বস্থানে ন্যায় বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করার তওফিক দান করুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন