ইসরায়েল সর্বোচ্চ যুদ্ধ বিমান ধবংসের রেকর্ড বাঙালি বৈমানিক সাইফুল আজমের
মো.আবু রায়হান
সাইফুল আজম একজন বৈমানিক ও বীরযোদ্ধা ।তিনি ১৯৪১ সালে পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তার পিতার নাম ছিল নুরুল আমিন। ১৫ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, ১৯৫৬ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান যান। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দুই বছর পর ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। একই বছর তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। সাইফুল আজম বাংলাদেশ, পাকিস্তান, জর্ডান ও ইরাকের বিমানবাহিনীর বৈমানিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র যোদ্ধা, যিনি আকাশপথে লড়াই করেছেন তিনটি ভিন্ন দেশের বিমানবাহিনীর হয়ে। একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডটিও এই যোদ্ধার।
এক সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে লড়াইয়ে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশি গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । ১৯৬৭ সালের ৫ জুন তৃতীয় আরব-ইসরায়েলি ছয়দিনের যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে মিশরীয় বিমান বাহিনীর সব বিমান অচল করে দেয়। ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর হামলা থেকে জর্দানের মূল বেস মাফরাকের প্রতিরক্ষার জন্য তাকে ডাকা হয়। সেসময় জর্দান বিমানবাহিনীর হয়ে সাইফুল আজম হকার হান্টার বিমান নিয়ে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর আক্রমণের আগমূহুর্তে জর্দানের বিমান বাহিনীর পক্ষে উড্ডয়ন করেন। তিনি অসামান্য দক্ষতা এবং সাহসিকতার দৃষ্টান্ত রেখে তার বিমানের চেয়ে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির দুইটি ইসরায়েলি মিরাজ ফাইটার বিমান ভূপাতিত করেন।
দুইদিন পর তাকে ইরাকে জরুরি ভিত্তিতে বদলি করে পাঠানো হয়। তিনি ইরাকি বিমান বাহিনীর হয়ে ইসরায়েলি ফাইটারের মোকাবেলা করেন এবং ডগ ফাইটে একটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করেন। বিমানঘাঁটি আক্রমণের সময় তিনি পশ্চিম ইরাকে ছিলেন। ইসরায়েলি পাইলট ক্যাপ্টেন গিডিওন ড্রোর সাইফুল আজমের উইংমেনসহ দুজন ইরাকি যোদ্ধাকে গুলি করতে সক্ষম হন, এর বিপরীতে সাইফুল আজম তাকে গুলি করতে সক্ষম হন। তিনি ক্যাপ্টেন গোলানের বোমারু বিমানকেও ভূপাতিত করতে সক্ষম হন। পরে দুই ইসরায়েলি বৈমানিককে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। আকাশযুদ্ধে তিনি চারটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করতে সক্ষম হন, যা এখন পর্যন্ত একটি রেকর্ড। আজ পর্যন্ত এককভাবে সর্বাধিক ইসরায়েলি বিমান ধ্বংসের রেকর্ড তাঁরই। দুই দিনের ব্যপ্তিতে তিনি দুইটি ভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করে ৪টি ইসরায়েলি ভূপাতিত করেন। এজন্য তাকে জর্দানের অর্ডার অব ইস্তিকলাল ও ইরাকি সাহসিকতা পদক নুত আল সুজাত প্রদান করা হয়।। জর্দান, ইরাক তাঁকে সম্মাননা দিলেও সর্বোচ্চ উপাধি দিয়েছে মার্কিন বিমানবাহিনী।যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা আর কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাদারিং অব ঈগলস ফাউন্ডেশন বিশ্বের যে ২২ বৈমানিককে ‘লিভিং ঈগল’ সম্মাননা দিয়েছিল, সাইফুল আজম তাদেরই একজন।
সাইফুল আজম ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। পাকিস্তানে ফেরার পর ১৯৬৯ সালে শেনিয়াং এফ-৬ জঙ্গি বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন । এরপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফাইটার লিডারস স্কুল-এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাইট সেফটি পরিচালক এবং পরে ডিরেক্টর অব অপারেশনসের দায়িত্ব পালন করেন সাইফুল আজম। ১৯৭৭ সালে পদোন্নতি পেয়ে হন উইং কমান্ডার, পান ঢাকায় বিমান ঘাঁটির দায়িত্ব।
সাইফুল আজম ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে অবসর নেন।
লড়াকু এই আকাশ যোদ্ধা গত বছর ১৪ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সাইফুল আজমের মৃত্যু শোকগ্রস্ত করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদেরও। ফিলিস্তিনের ইতিহাসবিদ ওসামা আল-আশকার তাকে বর্ণনা করেন একজন ‘মহান বৈমানিক’হিসেবে।ফেইসবুকে এক পোস্টে শোক জানাতে গিয়ে তিনি লিখেন, জেরুজালেমের পবিত্র আল-আকসা মসজিদকে রক্ষার লড়াইয়ে এই ‘বাংলাদেশি ভাইও’ শামিল হয়েছিলেন।
ফিলিস্তিনের অধ্যাপক নাজি শুকরি এক টুইটে সাইফুল আজমের প্রতি স্যালুট জানিয়ে লিখেন, “তিনি ফিলিস্তিনকে ভালোবাসতেন এবং জেরুজালেমের স্বার্থে লড়াই করেছিলেন।”মৃত্যুতে সাইফুল আজমকে স্মরণ করে জর্ডানও। দেশটির যুবরাজ হাসান বিন তালাল এক শোকবার্তায় এই বাংলাদেশি বৈমানিকের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন