ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের নীরবতা ও পক্ষপাত
ইসরায়েলি বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশু রয়েছে। গত ৩৮ ঘণ্টায় এক হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছেন ফিলিস্তিনিরা। অপর দিকে মঙ্গল ও বুধবার গাজায় কয়েক শ লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় গাজায় ১৩ তলা একটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে।সংঘাত পরিহার করে অনেকেই শান্তি আলোচনার আহ্বান জানান। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধান পক্ষ বেছে নিয়ে নিন্দা করছেন অপর পক্ষের। ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হলে গোটা বিশ্ব সরব হতো কিছু না হলেও সহানুভূতি পেত। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আশার কথাও যেমন আছে, আছে হতাশার কথা। হতাশার কথা হলো, গত বছরের আগস্টে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তারপর একে একে বাহরাইন, মরক্কো, সুদান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।তাদের মধ্যে বিমান চলাচল শুরু হয়। প্রকল্প রূপায়ণ শুরু হয়। তখনই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনিই বলেছিলেন, মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো।
বিগত কয়েক দিনের সংঘাতের পর এ দেশ দুটোই শুধু সরব, খামেনিই বলেছেন, ''এই লড়াই হলো দমনের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই। ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে পিছন থেকে ছুরি মারছে। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কর্তব্য।
''তুরস্কে এরদোয়ানের মুখপাত্র বলেছেন, ''ইসরায়েল সমানে আগ্রাসনের নীতি নিয়ে চলছে। বিশ্বের সব দেশ মিলে তাদের থামানো দরকার।''
আজ আরব দেশগুলি যদি সমালোচনায় মুখর হয়, তা হলে আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো, সুদানের উপর ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা নিয়ে চাপ বাড়বে। এমনিতেই ওই দেশের মানুষের একাংশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাই ওই সব দেশের প্রধানদের বলতে হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা সমাধানের জন্যই তারা ওই পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে যখন চুক্তি হচ্ছে, তখন আবু ধাবির যুবরাজ বলেছিলেন, ''ফিলিস্তিনের এলাকায় ইসরায়েল আর আগ্রাসন করবে না। কিন্তু ইসরায়েল তার পুরনো সন্ত্রাসী ও বিশ্বাসঘাতকতার চরিত্র হতে বের হতে পারেনি, পারবেও না।
ফিলিস্তিন আক্রান্ত ও নির্যাতিত। তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে বিশ্ব সন্ত্রাসী অবৈধ দখলদার ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করে নিজেদের আবারও সন্ত্রাসীদের দোসর হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাদের মানবাধিকার নিয়ে দেয়া বক্তব্য জাস্ট আইওয়াশ বৈকি!
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, হামাসকে অবশ্যই অতি দ্রুত রকেট হামলা বন্ধ করতে হবে । তিনি আরও বলেন, "দুই পক্ষকেই শান্ত থাকতে হবে"।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগীদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব টুইট করে বলছেন যে রকেট হামলা "অবশ্যই বন্ধ করতে হবে"। বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করা বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, পশ্চিম তীর, গাযা এবং পূর্ব জেরুসালেমে গুরুতর সংঘর্ষ হচ্ছে, যা তাৎক্ষনিকভাবে বন্ধ করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, গাযা থেকে ইসরায়েলের বেসামরিক লোকের উপর যে ভাবে হামলা করা হয়েছে, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য না।
সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই বিষয়ে একটি জরুরি বৈঠক হলেও কোন বিবৃতি দেয়া হয়নি।
জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস শান্তি ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি তৎপরতা আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তিবিষয়ক দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড বলেন, দুই পক্ষ ‘পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে এগিয়েছে’।
তুরস্কের যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক ফাহরেত্তিন আলতুন বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা ও তাদের ভূমিদখল, মসজিদে হামলা, নিরপরাধ শিশুদের হত্যা। এসব নৃশংসতা কি আত্মরক্ষার্থে? এসব হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিক্রিয়া আছে? ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন- তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।তিনি পুতিনকে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি আচরণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইসরায়েলকে ‘একটি শক্তিশালী ও প্রতিরোধমূলক শিক্ষা দিতে হবে’। তবে এতে পুতিন এরদোগানকে সায় দিয়েছেন বলে জানা যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে রয়েছেন বলে টুইট করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এতে তিনি লিখেন, আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং আমরা গাজার সঙ্গে আছি, আমরা ফিলিস্তিনের সঙ্গে আছি।
হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে বলেছেন, ‘ইসরায়েল যদি বাড়াতে চায় তাহলে আমরা তার জন্য প্রস্তুত। আর তারা বন্ধ করতে চাইলে আমরা তার জন্যও প্রস্তুত।’
আশার কথা হলো এবারের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ ইসরায়েলের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়েছে।ইসরায়েলে প্রায় ৮৩ লক্ষ লোকের বাস। এদের মধ্যে ৬১ লক্ষ ইহুদী জাতি ও ধর্মাবলম্বী এবং ১৭ লক্ষ আরব জাতিভুক্ত যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। ইসরায়েলের লড শহরে ইসরায়েলি আরবদের বিক্ষোভ পুরো মাত্রার দাঙ্গায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুঁড়তে থাকে এবং পুলিশ জবাবে স্টেন গান চালায়।সংঘর্ষে ৫২ বছর বয়সী এক বাবা এবং তার ১৬ বছরের কন্যা নিহত হয়। একটা রকেট এসে তাদের গাড়িকে আঘাত করলে তারা মারা যায়। ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারিৎজ-এর খবরে বলা হয় সংঘর্ষে আহত হয়েছে আরও প্রচুর মানুষ।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামন নেতানিয়াহু লড শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন মঙ্গলবার রাতে। ১৯৬৬ সালের পর এই প্রথম সরকার আরব সম্প্রদায়ের ওপর জরুরি আইন প্রয়োগ করল বলে জানাচ্ছে টাইমস অফ ইসরায়েল পত্রিকা।নেতানিয়াহু শহরে শান্তি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাতে সেখানে গেছেন। তিনি বলেন প্রয়োজনে তিনি কারফিউ জারি করবেন।ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে শহরে ইহুদিদের প্রার্থনাস্থল সিনাগগ এবং দোকানে আগুন দেয়া হয়েছে। রয়টার্স সংবাদ সংস্থা খবর দিয়েছে একজন আরব বাসিন্দা তার গাড়ি নিয়ে বের হলে তাতে পাথর ছোঁড়া হয়েছে।লড শহরের মেয়রকে উদ্ধৃত করে টাইমস অফ ইসরায়েল বলছে, "সেখানে পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে"। তিনি বলেছেন, "লড-এ গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেছে।"
ইসরায়েলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কেন্দ্র বেন গুরিয়ান বিমানবন্দর থেকে মঙ্গলবার বিমান চলাচল কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ইসরায়েলের যেসব শহরে বড় আরব জনগোষ্ঠী বসবাস করেন সেসব শহর এবং পূর্ব জেরুসালেম এবং পশ্চিম তীরেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিউইয়র্ক, লন্ডন, করাচি, রাবাতের মতো বিশ্বের বড় শহরগুলোতে জড়ো হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
নিউইয়র্কে ফিলিস্তিনি পন্থী সমর্থকরা ইসরায়েলি কনস্যুলেটের কাছে মিছিল করে। লন্ডনের জনগণও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের একাত্মতা প্রকাশ করেছ
লেবাননের বৈরুতের মার ইলিয়াস ক্যাম্পে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন