ভারতের সাত রাজ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু
সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারত একটি বহুধর্মীয়, বহুভাষিক, ও বহুজাতিক রাষ্ট্র।ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে জনসংখ্যার বিচারে এই দেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান উত্তর-পূর্বে চীন, নেপাল, ও ভুটান এবং পূর্বে বাংলাদেশ ও মায়ানমার অবস্থিত। এছাড়া ভারত মহাসাগরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া ভারতের নিকটবর্তী কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও পূর্বে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতের উপকূলরেখার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিলোমিটার।
ভারতে ৮০ কোটিরও বেশি ৮০.৫% হিন্দু, অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে রয়েছে মুসলমান ১৩.৪%, খ্রিস্টান ২.৩%, শিখ ১.৯%, বৌদ্ধ ০.৮%, জৈন ০.৪%, ইহুদি, পারসি ও বাহাই ধর্মাবলম্বী মানুষ।বর্তমানে ভারত ২৮টি রাজ্য ও আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত । ভারতে মোট ৮০.৫% মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যার বিচারে ভারতের সাতটি রাজ্যে কিন্তু তারাই সংখ্যালঘু।জম্মু ও কাশ্মীর ও লাক্ষাদ্বীপ মুসলিম-প্রধান; নাগাল্যান্ড, মিজোরাম,অরুণাচল ও মেঘালয় খ্রিষ্টান-প্রধান; পাঞ্জাব শিখ-প্রধান।আসুন জেনে নিই সেই রাজ্যগুলোর কথা-
জম্মু ও কাশ্মীর
জম্মু ও কাশ্মীর হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। ভারতের এই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলটির দক্ষিণে ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্য দুটি অবস্থিত। জম্মু ও কাশ্মীরের উত্তরে পাক-অধিকৃত গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল ও পূর্বে ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখ অবস্থিত। এই অঞ্চলের পশ্চিমে ও উত্তরপশ্চিমে লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোলের ওপারে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর গিলগিত-বালতিস্তান অবস্থিত।জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ফলে, রাজ্যের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সেখানে সংখ্যালঘু।
লাক্ষাদ্বীপ
লাক্ষাদ্বীপ ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যা ভারতের মূল ভূ-খণ্ড থেকে ২০০ থেকে ৪৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে লাক্ষা সাগরের মালাবার উপকূলের অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। ভৌগোলিক মতবাদ অনুসারে, অসংখ্য মৃত প্রবাল কীটের দেহাবশেষ সঞ্চিত হয়ে সমুদ্র মধ্যে এই দ্বীপসমূহের সৃষ্টি হয় । তাই এই দ্বীপপুঞ্জকে 'প্রবাল দ্বীপ'ও বলা হয়ে থাকে ।৩২ বর্গ কিলোমিটার (১২ বর্গ মাইল) আয়তনের লক্ষদ্বীপ হল ভারতের সবচেয়ে ছোট কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল।যদিও এই অঞ্চলটি লক্ষদ্বীপ নামে পরিচিত, আসলে এটি কেবল ভৌগোলিকভাবে দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রীয় দ্বীপসমূহর নাম। লাক্ষাদ্বীপের মোট ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ মানুষই নিজের পরিচয় দেন মুসলমান হিসাবে। সেখানে হিন্দু জনসংখ্যা মাত্র আড়াই শতাংশ!
মিজোরাম
ভারতের উত্তর-পূর্বে, এটি সর্বদক্ষিণের স্থলবেষ্টিত রাজ্য এবং ভারতের সাতভগিনী রাজ্যের ত্রিপুরা, আসাম, মণিপুর এই তিনটি রাজ্যের সাথে যার সীমানা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের প্রায় ৭২২ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে মিজোরামের সীমানা অবস্থিত।হিন্দু জনসংখ্যা সেখানে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, ৮৭ শতাংশ মানুষ সেখানে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। রয়েছেন সাড়ে আট শতাংশের কাছাকাছি বৌদ্ধও।
নাগাল্যান্ড
উত্তর-পূর্ব ভারতে একটি রাজ্য। এটির পশ্চিমে আসাম রাজ্য, উত্তরে অরুণাচল প্রদেশ এবং আসাম, পূর্বে মায়ানমার এবং দক্ষিণে মণিপুর সীমানা করেছে। রাজ্যের রাজধানী কোহিমা, এবং বৃহত্তম শহর দিমাপুর।সবচেয়ে বেশি ব্যাপটিস্ট রাজ্য’ নামে খ্যাত নাগাল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশ হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত। স্বাভাবিকভাবেই, সেখানে খ্রিস্টান রয়েছেন ৮৮ শতাংশ।
অরুণাচল প্রদেশ
উত্তর-পূর্ব ভারতে অবস্থিত ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। এর দক্ষিণে ভারতের অঙ্গরাজ্য আসাম, পশ্চিমে ভুটান, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে গণচীন, এবং পূর্বে মিয়ানমার। অরুণাচল প্রদেশের আয়তন ৮৩,৭৪৩ বর্গকিলোমিটার। গণচীন অঙ্গরাজ্যটির অংশবিশেষ নিজেদের বলে দাবী করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হওয়ার ধারা অরুণাচল প্রদেশেও অব্যাহত। এখানে হিন্দুদের মোট সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি, প্রায় ২৯ শতাংশের কাছাকাছি। অল্পের জন্য এগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের তকমা জুটেছে খ্রিষ্টানদের, যারা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। রয়েছেন ২৬ শতাংশ ‘দোনয়ি পোলো’ নামের আদিবাসী ধর্মানুসারীরাও।
মেঘালয়
উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। এই রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব দিকে আসাম রাজ্য এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অবস্থিত। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। ব্রিটিশ ভারতের সময় একে "প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলা হতোমেঘালয়ের ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী। মাতৃতান্ত্রিক সামজব্যবস্থায় চলা এই রাজ্যের মোট ৭৫ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান।১৮৩০ সালে বাপিস্ট ধর্মপ্রচারকরা এখানে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময় উপজাতিদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে।
পাঞ্জাব
উত্তরে জম্মু ও কাশ্মীর, পূর্বে হিমাচল প্রদেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে হরিয়ানা, দক্ষিণ-পশ্চিমে রাজস্থান, এবং পশ্চিমে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ভারতের, পাঞ্জাবের সীমা নির্ধারণ করেছে। রাজ্যের রাজধানী চণ্ডীগড়ে অবস্থিত। এটি একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং প্রতিবেশী রাজ্য হরিয়ানারও রাজধানী।পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম শিখ ধর্ম। মোট জনসংখ্যার ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এই ধর্ম অনুসরণ করেন। সেখানকার ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ হিন্দু, তাই তারাই সংখ্যালঘু।
৮ রাজ্যে হিন্দুদের সংখ্যালঘু মর্যাদা দেওয়ার দাবি অনেক দিন ধরেই জানানো হচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মহল থেকে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টে এ সংক্রা'ন্ত এক আবেদন জানিয়েছিলেন বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়। অশ্বিনী উপাধ্যায় সাফাই দিয়েছিলেন যে, লাদাখের হিন্দু জনসংখ্যা এক শতাংশ। মিজোরামের ২.৭৫ শতাংশ, লাক্ষাদ্বীপে ২.৭৭ শতাংশ, কাশ্মীরের চার শতাংশ, নাগাল্যান্ড ৮.৭৪ শতাংশ, মেঘালয় ১১.৫২ শতাংশ, অরুণাচল প্রদেশে ২৯.২৪ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩৮.৪৯ শতাংশ এবং মণিপুরে ৪১.২৯ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা রয়েছে। তার দাবি, ওইসব রাজ্যে হিন্দুদের সংখ্যালঘুদের মর্যাদা দেওয়া উচিত এবং সংখ্যালঘুদের দেওয়া অধিকারও তাদের পাওয়া উচিত। কিন্তু এসব রাজ্যে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় তারা সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও সুবিধা পায় না।ভারতের ৮টি রাজ্যে হিন্দুদের সংখ্যালঘু মর্যাদা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে।জানা গেছে লাক্ষাদ্বীপ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, জম্মু ও কাশ্মীর, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর এবং পাঞ্জাবে হিন্দুরা সংখ্যালঘু মর্যাদা পেতে পারেন। ১৯৯২ সালে অযোধ্যা কাণ্ডের পরে মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত সরকারি গেজেটে পাঁচটি ধর্মীয় সম্প্রদায়- মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ এবং পার্সীদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল। এ সংক্রা'ন্ত ২(গ) ধা'রায় বলা হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকার যাদের সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত করবে তারাই সংখ্যা'লঘু হবে।কেন্দ্রীয় সরকার এবার এই লক্ষ্যে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে যে, সংখ্যাল'ঘু বিবেচনার প্রক্রিয়াটি আদমশুমারি অনুযায়ী করা উচিত। এর ফলে ওই আটটি রাজ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু মর্যাদা পেতে পারেন। এমনটি হলে জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিমরা এবং পাঞ্জাবের শিখরা সংখ্যালঘু হওয়ার মর্যাদা হারাতে পারেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন