কুব্বাতুস সাখরা কোনো মসজিদ নয়
বা মসজিদুল আকসার সংবাদ পরিবেশ করা হয় । আসলে এটি বায়তুল মুকাদ্দাসের ছবি নয়। এটি কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রকের ছবি। রাসুলুল্লাহ (সা) যুগ থেকে মসজিদের একটা অবকাঠামোগত আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেছে। একটা মসজিদে সাধারণত নামায আদায়ের জন্য নির্ধারিত একটি অংশ বা ঘর থাকে। তার সম্মুখভাগে একটা বর্ধিত অংশ থাকে, যাকে বলে মিহরাব। কুব্বাতুস সাখরায় কোনো মিহরাব নেই। এছাড়া কয়েক কারণে কুব্বাতুস সাখরা কোনো মসজিদ বা এবাদতখানা নয়।শুরুতে এটি মসজিদ হিসেবে নির্মাণও করা হয়নি। আরবিতে কুব্বাহ হলো গম্বুজ আর সাখরা হলো পাথর। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, “পাথরের (উপর নির্মিত) গম্বুজ”; হিব্রুতে বলে কিপ্পা হা-সেলা। সেকেন্ড টেম্পল বা দ্বিতীয় বায়তুল মুকাদ্দাস রোমানরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। রোমানরা সেখানে জুপিটারের মন্দির বানিয়েছিল, সেই জায়গায় উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রক নির্মাণ করেন।আটকোণা এই গম্বুজের ভেতরেই রয়েছে সেই পাথরের ভিত্তি - যেখান থেকে রাসুলুল্লাহ (সা) মিরাজে গিয়েছিলেন বোরাক চড়ে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বোরাকের পায়ের ছাপ এখনও পাথরে দেখা যায়। ৬৮৯ থেকে ৬৯১ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। নির্মাণ দায়িত্বে দুজন প্রকৌশলী ছিলেন। একজন হলেন মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক বাইসানের বাসিন্দা রাজা ইবনে হায়ওয়াহ ও অপরজন হলেন খলিফা আবদুল মালিকের খ্রিষ্টান দাস জেরুজালেমের ইয়াজিদ ইবনে সালাম।
কুব্বাতুস সাখরা মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন। এর নকশা এবং অলংকরণে সমসাময়িক বাইজেন্টাইন স্থাপত্যশৈলী এবং স্বতন্ত্র ইসলামি ঐতিহ্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।এর স্থাপত্য ও মোজাইক বাইজেন্টাইন চার্চ ও প্রাসাদের আদলে গড়ে তোলা হয়েছিল।
১০১৫ সালে গম্বুজটি ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু ১০২২-২৩ সালে পুনর্নির্মিত হয়।১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম অধিকার করে নেয়। কুব্বাত আস সাখরা অগাস্টিনিয়ানদের দিয়ে দেয়া হয়। তারা এটিকে গির্জায় রূপান্তর করে এবং আল-আকসা মসজিদকে রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। নাইটস টেম্পলাররা কুব্বাতুস সাখরার স্থানটিকে সুলায়মান (আ) কর্তৃক নির্মিত উপাসনালয়ের স্থান বলে বিশ্বাস করত।
১১৮৭ সালে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জেরুজালেম জয় করার পর কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রকের উপরের ক্রুশ নামিয়ে সেখানে ক্রিসেন্ট লাগিয়ে দেন।
নিচে পাথরের চারপাশে কাঠের আবরণ দেয়া হয়। সালাউদ্দিনের ভাতিজা আল মালিক আল মুয়াজ্জাম ঈসা ভবনের পুনর্গঠনের দায়িত্ব পালন করেন।মামলুক শাসনের সময় কুব্বাতুস সাখরা গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় আসীন ছিল। মামলুকরা ১২৫০ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।
ওসমানীয় সুলতান সুলাইমান তার রাজত্বকালে (১৫২০-১৫৬৬) এ স্থাপত্যের বাহিরে পুরোটা জুড়ে টাইলস লাগানো হয়। ভেতরে লাগানো আছে মোজাইক ও মার্বেল যাতে সুরা ইয়াসিন লিখিত আছে। তার উপরে লেখা হয় সুরা ইসরা বা সুরা বনী ইসরাইল, কারণ সেখানে নবী (সা) এর এই বায়তুল মুকাদ্দাসে আসার কথা লিখিত আছে।।এসব কাজের জন্য সাত বছর সময় লাগে।
১৬২০ সালে কুব্বাতুস সাখরার পাশে উসমানীয়রা কুব্বাত আন নবী নামক আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ করে। ১৮১৭ সালে দ্বিতীয় মাহমুদের আমলে বড় ধরনের সংস্কার সম্পন্ন হয়। ১৯২৭ সালের ১১ জুলাই ফিলিস্তিনে সংঘটিত ভূমিকম্পে কুব্বাতুস সাখরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিপূর্বে সম্পাদিত সংস্কারগুলো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৫৫ সালে জর্ডান সরকার সম্প্রসারণমূলক পুনর্গঠন কাজ শুরু করে। আরব সরকারগুলো ও তুরস্ক এতে অর্থ সহায়তা দেয়। সুলতান সুলাইমানের সময় স্থাপিত বেশ কিছু টাইলস এসময় প্রতিস্থাপিত করা হয়। অতিবৃষ্টির ফলে এগুলো স্থানচ্যুত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে এই সংস্কারের অংশ হিসেবে গম্বুজটি এলুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৯৬৪ সালের আগস্টে সংস্কারকার্য সমাপ্ত হয়।
১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েলের ছয় দিনের যুদ্ধে কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রকের মাথায় ইসরায়েলের পতাকা ওড়ানো হয়। কিন্তু শীঘ্রই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দায়ানের নির্দেশে সেটি নামিয়ে ফেলা হয় এবং এর দায়িত্ব দেয়া হয় মুসলিম সংগঠন ওয়াকফের হাতে। এখনো সেই ওয়াকফের হাতেই এর অধিকার রয়েছে।
১৯৯৩ সালে জর্ডানের বাদশাহ হুসাইন তার একটি বাড়ি বিক্রি করে পাওয়া ৮.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ৮০ কেজি সোনা কিনে তা দান করে দেন এ কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রকের জন্য। সেই সোনাই আজ জ্বলজ্বল করে ডোম অফ দ্য রকের গম্বুজে। আগেই বলেছি কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রক কোন মসজিদ বা এবাদতখানা নয়। তাহলে এর মধ্যে কি আছে? এরমধ্য আছে একটা পবিত্র পাথর এবং এই পাথরের নিচে আছে একটা গুহা
হাদিসের বর্ণনা মতে, এ পাথরের ওপর ভর রেখে হযরত হযরত মুহাম্মদ (সা) মিরাজ বা উর্ধ্বারোহণ করেন। আর, ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী, এটির নাম ভিত্তিপ্রস্তর, বা ফাউন্ডেশন স্টোন। হিব্রুতে ডাকা হয় এভেন হা-স্তিয়া। এটিই হোলি অফ দ্য হোলিজ এর অবস্থান বলে বিশ্বাস করা হয়। ইহুদিদের আছে এই পাথরটাই মূল কিবলা। হযরত উমর (রাঃ) এই পাথরটিকে সালাম দিয়ে ছিলেন, “আসসালামু আলাইকুম”; পাথরটি উত্তর দিয়েছিল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম”
গম্বুজটির ঠিক নিচে এই পাথরটি। আর পাথরটির দক্ষিণ পূর্ব কোনায় একটা গর্ত আছে। এই গর্ত দিয়ে প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট একটা গুহাতে প্রবেশ করা যায়। এই গুহাটির নাম বির আল-আরুয়াহ বা আত্মার কূপ (Well of Souls); এই গুহার ভিতরে নামাজ পড়ার জায়গা আছে। গুহাটির আয়তন প্রায় ৬৫ বর্গফুট এবং উচ্চতা ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি থেকে ৮ ফুট ২ ইঞ্চি পর্যন্ত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন