বিভক্ত ফিলিস্তিন ও পৃথক শাসন ব্যবস্থা

 




মো. আবু রায়হান
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত (যেখানে বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড অবস্থিত)। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। এটি ইহুদি ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের জন্মস্থান।
ইয়াসির আরাফাত জীবিতকালীন পর্যন্ত হামাসের সাথে ফাতাহর কোনো দ্বন্দ্বও ছিল না। কিন্তু দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখনই যখন ২০০৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হামাস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় এবং নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ নির্বাচনে পশ্চিমারা পর্যবেক্ষক ছিল। পশ্চিমারা বলেছিল, তারা নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেবেন কিন্তু হামাস জয়ী হবে তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি।যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমাবিশ্ব একযোগে ঘোষণা করল, হামাস যতদিন সরকার হিসেবে থাকবে ততদিন তারা ফিলিস্তিনিদের কোনো সাহায্য সহযোগিতা করবে না।অন্যদিকে, ইসরাইলকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে যাবে। ফাতাহ তথা মাহমুদ আব্বাসও সুযোগ খুঁজছিলেন হামাসকে কিভাবে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়। অনেক টানাপড়েনের পর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসাবে মাহমুদ আব্বাস হামাস সরকারকে বরখাস্ত করেন ও তার নিজ দল ফাতাহ দ্বারাই সরকার গঠন করেন। স্বভাবতই নির্বাচনে বিজয়ী হামাস তা মেনে নিতে অস্বীকার করে।ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ফিলিস্তিনের দুই অংশ পশ্চিম তীর ও গাজা ২০০৭ সালের আগস্টে চলে যায় দুটি দলের নিয়ন্ত্রণে। সেই থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ পশ্চিম তীরে ও ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে হামাস গাজা শাসন শুরু করে। ফাতাহ-হামাস দ্বন্দ্বের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১৪ জুন রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস তাকে পদচ্যুত করেন। কিন্তু ইসমাইল হানিয়া আদেশ মেনে নেননি এবং গাজায় প্রধানমন্ত্রীত্ব করতে থাকেন।পশ্চিমতীর ও গাজার মধ্যে গাজা টানেল নামে একটি টানেল রয়েছে। দুই অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি.।ইসরায়েলের অনুমতি সাপেক্ষে তাদের ভূমি ব্যবহার করে দুই অঞ্চলের মানুষ যাতায়াত করতে পারে। তবে যাতায়াত ব্যবস্থা ইসরায়েলিদের দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
পশ্চিম তীর
পশ্চিম তীর পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের নিকটবর্তী স্থলভূমি। পূর্বে জর্ডান সীমানা এবং দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর দিকে গ্রিন লাইন পশ্চিম তীর ও ইসরায়েলকে পৃথক করে। পশ্চিম তীর মৃত সমুদ্রের পশ্চিম তীরের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধারণ করে। পশ্চিম তীরটি সেই অঞ্চলটিকে দেওয়া নাম ছিল যা ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পরে জর্ডান কর্তৃক দখল করা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে ১৯৫০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছয়-দিনের যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল দখল করার পূর্ব পর্যন্ত বাড়তি অংশ হিসেবে সংযুক্ত ছিল।পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ফিলিস্তিন ও কিছু অংশ ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে।যদিও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণকে অবৈধ বিবেচনা করে। পশ্চিম তীরের জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ লক্ষ। আয়তন ৫৬৫৫ বর্গ কিমি।এর মধ্যে ২২০ বর্গ কিমি ভূমধ্যসাগরের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের সমুদ্র সীমা। ভাষা আরবি ও আধুনিক হিব্রু। পশ্চিম তীরে সুন্নি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বসবাস। মুদ্রার নাম শেকেল।

গাজা ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত স্বশাসিত ফিলিস্তিনি অঞ্চল।গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত এমন একটি এলাকা যা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই এলাকাটি ৪১ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার চওড়া। আয়তন ৩৬৫ বর্গ কিমি.। জনসংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ।গাজা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। গাজার জনসংখ্যা ২০১৫ সালের ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ৩১ লক্ষে গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হয়।এরা বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় বাড়ি ছেড়ে পালানো বা উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর। অনেকেই এখনো বাস করেন শরণার্থী শিবিরে, তারা এখনো স্বপ্ন দেখেন নিজের হারানো বসতভূমি - যা এখন ইসরায়েলে - সেখানে ফিরে যাবার।গাজা ভূখণ্ডের পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে মিশর, এবং উত্তরে, পূর্বে, ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ইসরায়েল।এলাকাটি কড়া প্রহরাধীন এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। গাজা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার।
গাজা
প্রতিদিন সেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। গড়ে গাজার লোকেরা দিনে মাত্র ছয় ঘন্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আসে ইসরায়েল থেকে, তবে গাজার একটি নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, আর কিছু মিশর থেকে আসে। অনেক লোক ডিজেলের জেনারেটর ব্যবহার করে - তবে তা খুবই ব্যয়বহুল।গাজায় বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। কোন বড় মিঠা পানির জলাধার নেই। গাজার বাড়িগুলোতে পাইপে যে পানি আসে তার সরবরাহ অনিয়মিত। ৯৭ শতাংশ বাড়িকেই নির্ভর করতে হয় ট্যাংকার দিয়ে সরবরাহ করা পানির ওপর।
গাজা এক সময় মিশরের অধিকারে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল এলাকাটি দখল করে নেয়। পরে ২০০৫ সালে ইসরায়েল এলাকাটির দখল ছেড়ে দেয়, সেখান থেকে চলে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা এবং প্রায় ৭ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারী।এই এলাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে। হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে জয়ী হয় - কিন্তু তার পর প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সাথে তাদের সংঘাত সৃষ্টির পর তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।হামাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর খুব দ্রুত ইসরায়েল এই এলাকাটির ওপর একটা অবরোধ আরোপ করে। গাজা ও ফিলিস্তিনের অন্য এলাকার মধ্যে লোকজন ও পণ্যের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মিশরও গাজার দক্ষিণ সীমান্তে অবরোধ আরোপ করে।ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এক সংক্ষিপ্ত সামরিক সংঘাত হয় ২০১৪ সালে। ইসরায়েলের চেষ্টা ছিল গাজা থেকে রকেট হামলা থামানো ,অন্যদিকে হামাসের লক্ষ্য ছিল তাদের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো।
ইসরাইল তার আসল আধিপত্যবাদী অস্তিত্বের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মনে করে হামাসকে। তাই হামাস গাজার শাসনভার কাঁধে তুলে নেয়ার পর থেকেই ইসরাইল অবরোধের মাধ্যমে এ ক্ষুদ্র জনপদের ২১ লক্ষ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে অসহায় গাজাবাসী বিনা দোষে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। গাজায় যাতে কোনো পণ্যসামগ্রী এমনকি খাদ্য পর্যন্ত ঢুকতে না পারে ইসরাইল কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর এ কাজে সহযোগিতা করে আসছে মিসর।
বহির্বিশ্বের সাথে গাজার একমাত্র সংযোগ পথটি হলো রাফা ক্রসিং যা মিশরের নিয়ন্ত্রণাধীন। গাজাবাসীকে এ পথ দিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগে সাহায্য করে মিসর। কিন্তু তা হোসনি মুবারকের আমল থেকেই বন্ধ ছিল। মোহাম্মদ মুরসির আমলে সেই পথ খুলে দেয়া হলেও এখন আবার বন্ধ। আর বাকি দিক ইসরাইল দ্বারা পরিবেষ্টিত ও একদিকে সাগর।
২০০৬ সালের নির্বাচনের কয়েক মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশকে লেখা একটি চিঠিতে ইসমাঈল হানিয়া নির্বাচিত সরকারের সরাসরি আলোচনার জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি আহ্বান করেন। তিনি ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সন্ধির প্রস্তাব করেন এবং ১৯৬৭ সালের পূর্বের ফিলিস্তিনি সীমানা মেনে নেন এবং আন্তর্জাতিক বয়কট প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং বয়কট বহাল রাখে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল