হুইল চেয়ারে বসা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার মহানায়ক






মো.আবু রায়হান
শায়খ আহমাদ ইসমাইল হাসান ইয়াসিন (১৯৩৬ – ২২শে মার্চ ২০০৪) একজন বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, ফিলিস্তিনের শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক ও ধর্মীয় নেতা। তিনি গাযা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং হামাসের প্রতিষ্ঠাতা।কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। এছাড়া তিনি মসজিদে ইমামতি করতেন এবং খুতবাও দিতেন। তাঁর বলিষ্ঠ যুক্তি এবং উপস্থাপন ভঙ্গী তাকে ফিলিস্তিনের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।শিক্ষক হিসেবেও ছাত্রদের মধ্যে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াসিন তাঁর ছাত্রদের মনেও ইসরাইল বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করে দেন।
আসকালান শহর থেকে থেকে বিশ কিমি দূরে জুরাহ নামক স্থানে শায়খ আহমাদ ইয়াসিন ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেন।ইসরাইল তখন ফিলিস্তিন দখল করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের অনেক অঞ্চল দখল করে নিজেদের বলে ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইলিরা। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ ইয়াসিন এবং মাতার নাম সা'দা আল হাবেল। ইয়াসিনরা ছিলো সাত ভাই-বোন। তিন বছর হতে না হতেই তার পিতা মৃত্যু বরণ করেন ।
১৯৪৮ সালে যখন ইয়াসিনের বয়স মাত্র দশ বছর তখন ইসরাইলি বাহিনী তাদের গ্রাম দখল করে নেয়।
তাঁর পুরো গ্রা্মকেই ইসরাইলী বাহিনী গুড়িয়ে দেয়।
হত্যা করা হয় অসংখ্য নারী-পুরুষকে। কোনো রকম পালিয়ে ইয়াসিন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। এই গ্রামটির বর্তমানে অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। শিবিরে অর্ধাহারে-অনাহারে প্রচন্ডকষ্টে দিন কাটতে থাকে তার। আর এতেই ইসরাইলের প্রতি বাড়তে থাকে ঘৃণা। খুব কাছ থেকে ফিলিস্তিনীদের দুর্দশা দেখবার সুযোগ পাওয়ায় তিনি নির্ণয় করেন যে ইসরাইলী আগ্রাসনই ফিলিস্তীনীদের মূল সমস্যা।
ইয়াসিনের বয়স যখন ১২ বছর, তখন মারাত্মক দূর্ঘটনায় পরেন তিনি।শরণার্থী শিবিরের বাইরে বন্ধু আব্দুল্লাহর সাথে কুস্তি খেলতে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পান। টানা পঁয়তাল্লিশ দিন তার গর্দান প্ল্যাস্টার করে রেখেও শেষ রক্ষা হয় না। আহমাদ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। তার বন্ধুর হাতে চোট পেলেও দুই পরিবারের মধ্যে যাতে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে না ওঠে তার জন্য কারোর কাছেই আব্দুল্লাহ'র নাম বলেননি- বলেছিলেন-ব্যাঙ ব্যাঙ খেলতে গিয়ে নিজে নিজেই চোট পেয়েছেন।এই আঘাত থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি আহমদ ইয়াসিন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে হুইল চেয়ারেই জীবন কাটাতে হয়।
তবে শারীরিক এই অক্ষমতা শেখ আহমদ ইয়াসিনকে আটকে রাখতে পারেনি। উচ্চশিক্ষার জন্য কায়রো আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। শরীরের অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেলে গাজায় ফেরত আসেন। ঘরে বসেই পড়ে ফেলেন দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর ধর্মের নানাস বিষয়। আধুনিক নানা বিষয়ে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯৫৯ সালে দ্বিতীবার মিসরে গিয়ে ব্রাদারহুডের আন্দোলনের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ব্রাদারহুডের কর্মকাণ্ড তাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। ফিলিস্তিন ফিরে এসে তার দাওয়াতী কাজ অব্যহত রাখেন। এসময় তিনি বলেন,'ফিলিস্তিনের সমস্যা আমাদের, আমাদেরকেই এর সমাধান করতে হবে। অস্ত্র ধরে প্রতিরোধে নামতে হবে। আমাদেরকে আরবের কোন দেশ বা আন্তর্জাতিক কেউ সাহায্য করতে আসবেনা।'
১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর শায়খ তাঁর বক্তব্যে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। তিনি এসময় ইসলামী সমাজ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অবরুদ্ধ জনগণ, আহত এবং বন্দীদের জন্য ত্রাণ ও সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন সামাজিক কাজের মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন।
১৯৭৮ সালে ৪৯ বছর বয়সে শেখ আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের জন্য আল মুজাম্মা আল ইসলামি নামে একটি ইসলামি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার কর্মকাণ্ড পুরো ফিলিস্থিনে ছড়িয়ে দেন। ব্যাপক তরুণ এই সংগঠনে অংশগ্রহণ করে। তারা ফ্রি চিকিৎসা সেবা, স্কুল ও মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সারা ফিলিস্তিন জুড়ে লাইব্রেরি নির্মাণ করেন।
শেখ আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার জন্য শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। ১৯৮৭ সালে হামাস গঠন করেন। হামাস শব্দের অর্থ উদ্দীপনা । প্রথম দিকে হাসপাতাল, এনজিও, স্কুল, লাইব্রেরী গঠনের মাধ্যমে জনগণের মন আকর্ষণ করলেও ধীরে ধীরে হামাস ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে একটি স্বশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়। যার কর্মীরা ইসরাইলের উপর প্রথম সশস্ত্র হামলা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় হামাস চার্টার যার লক্ষ্য হলো অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো।এই চার্টার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত হয় হামাস চার্টার। হামাসের সামরিক শাখাও গড়ে তোলা হয়। এই শাখা দখলদার বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এই সংগ্রামের সময় ইয়াসিন ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হন এবং হামাসে তার সহযোগী অনেক নেতা ইসরাইলী ঘাতকদের হামলায় শহীদ হন। এই দলটিকে বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ না বুঝেই জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। তবে প্রথম থেকেই ইসরাইলী জনগণের ওপর জঙ্গি আক্রমণের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই, তারা শুধু ইসরাইলী দখলদারদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে, এইমর্মে ঘোষণা দিয়ে আসছে হামাস।
আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের বোঝাতে সক্ষম হলেন, তাদের স্বাধীনতা তাদেরই ছিনিয়ে আনতে হবে। এজন্য সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। হামাসের নেতৃত্বে তিনি ডাক দিলেন প্রথম ইন্তিফাদাহ এর।
ইন্তিফাদাহ মানে গণ-অভ্যুত্থান, গণজাগরণ।প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে এবং চলে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। হাতের কাছে যা পাওয়া যাবে তাই নিয়েই ইসরাইলীদের প্রতিরোধে তিনি জনগণকে উৎসাহিত করতে থাকেন। আর এতেই ব্যাপক সাড়া পেলেন তিনি। ইসরাইলি বন্দুকের সামনে পাথর নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে ফিলিস্তিনি জনতা। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই। বাদ যায়নি শিশুরাও। ইন্তিফাদাহ শুরুর এক বছরের মধ্যে ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে ৩১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়, আহত হয় ৭ হাজারের অধিক লোক, ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই আন্দোলনে পাঁচ বছরে ১৪০০জন ফিলিস্তিনি আর ২৭১জন ইসরায়েলি নিহত হয়।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ১৯৮৩ সালে প্রথম গ্রেফতার করা হয় আহমদ ইয়াসিনকে। ইসরাইলি সৈন্য হত্যার অভিযোগে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। পরে দুই বছর কারাভোগের পর বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৮৯ সালে আহমদ ইয়াসিনকে আবারো গ্রেফতার করা হয়। এবার তাকে অমানবিক অত্যাচার করা হয়। অত্যাচারে আহমদ ইয়াসিনের ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
তাঁর শরীরের ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। আস্তে আস্তে ডান চোখের দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পায়। আক্রান্ত হন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে।ইয়াসিনের সাহায্যের জন্য তার দুই ছেলেকে কারাগারে নেয়া হলেও ইসরাইলি সৈন্যরা তার সামনেই তার ছেলেদের উপর অত্যাচার করে। এবার তাকে ৪০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। টানা ৮ বছর জেল খাটার পরে ১৯৯৭ সালে জর্দানের বাদশাহ হুসাইনের সহযোগিতায় মুক্তি পান আহমদ ইয়াসিন।এরপরে দফায় দফায় তাকে গৃহবন্দীও করে রাখা হয়।
তাঁকে হত্যার জন্য ইসরাইল বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ২২ মার্চ ২০০৪ মঙ্গলবার, বাসা থেকে একশো মিটার দূরে হুইল চেয়ারে করে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাওয়ার সময় হেলিকপ্টার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয় শেখ আহমদ ইয়াসিনের উপর। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ছড়িয়ে পড়ে ইয়াসিনের শরীরের অংশ। কিছুক্ষণ পরেই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হুইল চেয়ারের অংশ এবং ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহের বিভিন্ন অংশগুলো কুড়িয়ে আনে স্থানীয়রা।শহিদ হন ইয়াসিন।ফিলিস্তিনের আকাশে ২০০৪ সালের ২২ মার্চ সকালের সূর্য উদিত হলো ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের অকুতোভয় বীর শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের শাহাদতের শোকাবহ বার্তা নিয়ে।ফিলিস্তিন জুড়ে নেমে এলো শোকের ছায়া। প্রিয় নেতাকে হারানোর শোকে মুহ্যমান ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলিদের অমানবিক এ নিষ্ঠুরতায় হতবাক মুসলিম বিশ্বও। সেদিন তার সাথে তিনজন বডিগার্ডসহ মুসল্লিদের মধ্যে থেকে আরো ৫ জন শহিদ হন। গুরুতর আহত হয় প্রায় ১৭ জন। তাঁর জানাযায় বিপুল পরিমাণ ফিলিস্তিনি জনগণের সমাগম হয়।খ্রিষ্টান-মুসলমান নির্বিশেষে দু’লাখ লোকের ঢল নেমেছিল তাঁর বিদায়ে। বিশ্বের অনেক দেশ এবং অনেক সংগঠন তার হত্যাকান্ডের নিন্দা জানায়।
তবে শায়খ শেখ আহমদ ইয়াসিনকে হত্যা করেও ফিলিস্তিনি দের স্বাধীনতা আন্দোলনকে থামিয়ে রাখা যায়নি। আহমদ ইয়াসিন একমনে বিশ্বাস করতেন যে, ইসরাইলের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে এবং পুরো ফিলিস্তিনের প্রতিটি ইঞ্চি জমিই মুসলমানদের। আরব নেতাদের ফিলিস্তিন-ইসরাইল চুক্তিতে তার আস্থা ছিলনা। এর চেয়ে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধেই তিনি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন "এই পথ আমরা বেছে নিয়েছে যার শেষ শাহাদাত বা বিজয়ের মাধ্যমেই হতে পারে" পরবর্তীতে ফিলিস্তিনের কাছে এই উক্তিটি মন্ত্রের মত হয়ে দাড়ায়।
"ইসরাইলের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে, তাদের বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে হবে"
এরকম উক্তি ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের কাছে তার সম্মানকে বহুগুনে বাড়িয়ে তোলে। তিনি আত্নঘাতি বোমা হামলাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক মনে করতেন।তাঁর কথাকে মূলমন্ত্র হিসাবে ধারণ করে আজও অবিরত চলছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন …

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল