ইসলামে ন্যায় বিচারের অনুপম দৃষ্টান্ত
মো. আবু রায়হান
মানবজীবনে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অত্যধিক।সভ্য সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের কোনো বিকল্প নেই। সুবিচারপ্রাপ্তি সব নাগরিকের অধিকার এবং ন্যায়বিচার আল্লাহর হুকুম। এটি ফরজ ইবাদত। ন্যায়বিচার ব্যতীত কোনো সমাজ মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। একটি সমাজকে সত্যিকারার্থে মানব সমাজ বলা যায় না, যদি না তাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান- এগুলো আমরা মৌলিক অধিকার বলি। কিন্তু ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি এসব অধিকারকে মূল্যহীন করে তোলে। আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়া না গেলে অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা মানুষকে স্বস্তি দিতে পারে না। অর্থাৎ মানুষকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে হলে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে ন্যায়বিচার। কোনো একটি মামলায় একটি অন্যায় বিচার মানে এক বা একাধিক নিরপরাধ ব্যক্তির ফেঁসে যাওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে এক বা একাধিক অপরাধীর অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া! এর কুফল হচ্ছে, সমাজে অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা বাড়তে থাকা এবং ভালো লোকের সংখ্যা কমে যাওয়া। এ রকম অপরাধপ্রবণ সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এখানে কেউ নিরাপদ থাকে না। তাই মানব সমাজের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য ন্যায়বিচার সবচেয়ে বড় নিয়ামক।
কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা করো নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সুরা মায়িদা আয়াত -৮)।
দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে মক্কার ৭০ জন কাফের বন্দি হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন নবীজির আপন চাচা হজরত আব্বাস ও জামাতা হজরত আবুল আস ইবনে রবী। তারা তখনও মুসলমান হননি। বন্দিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল প্রত্যেকে মুক্তিপণ পরিশোধ করতে হবে। মুক্তিপণ ছাড়া কাউকে মুক্তি দেওয়া হবে না। নবীজি (সা.) এই সিদ্ধান্ত মান্য করে নিজের চাচা ও জামাতা থেকেও মুক্তিপণ আদায় করেন। একবার মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জনৈকা মহিলা চুরি করল। উসামা (রা.) তার ওপর আল্লাহর বিধান কার্যকর না করার সুপারিশ করলে রাসুল (সা.) তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছ? এরপর তিনি দাঁড়ালেন এবং লোকদের উদ্দেশে বললেন, ‘হে মানুষেরা তোমাদের পূর্ববর্তীরা এ জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, যখন তাদের মধ্যে মর্যাদাশীল কেউ চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন দুর্বল কেউ চুরি করত তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করত আমি অবশ্যই আর হাত কেটে দিতাম।’ (মুসলিম হাদিস ১৬৮৮)
সামাজিক সুবিচারের আদর্শ দৃষ্টান্ত মিলে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর ঘটনায়। একবার এক বেদুইন থেকে খলিফা একটি ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়ায় চড়ে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ হোঁচট খেয়ে ঘোড়াটি খোঁড়া হয়ে গেল। হজরত উমর (রা.) মনে করলেন, ঘোড়ার পায়ে আগের থেকেই কিছু সমস্যা ছিল। তাই বেদুইনের কাছে ফেরত গিয়ে বললেন, তোমার ঘোড়া ফেরত নাও, এর পা ভাঙা। বেদুইন বলল, আমি যখন বিক্রি করেছি, তখন তার পা ভালো ছিল। আমি এখন ভাঙা পা-ওয়ালা ঘোড়া ফেরত নেব না। তারা উভয়ে হজরত কাজি শুরাইহকে (রহ.) সালিশ মানলেন। কাজি শুরাইহ (রহ.) দ্বিতীয় খলিফাকে বললেন, আপনি কি ঘোড়াটি সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কাজি শুরাইহ বললেন, তাহলে আপনি ঘোড়াটি পূর্ণ মূল্য দিয়ে কিনে নিন। না হয় যে অবস্থায় নিয়েছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন। কাজি শুরাইহ-এর এমন চমৎকার বিচারে খলিফা অভিভূত হলেন। বললেন, তুমি কালই কুফা চলে যাও। আজ থেকে তুমি কুফার বিচারপতি।
সুরা আনয়ামে আল্লাহ বলেন, যখন তোমরা কথা বলবে, তখন অবশ্যই ন্যায়ভিত্তিক কথা বলবে, যদিও তা তোমাদের নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধে যায় (আয়াত ১৫২)।তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার ফয়সালা করবে, তখন অবশ্যই ন্যায়বিচার করবে (সুরা নিসা ৫৮)।যখন ফয়সালা করবে, ন্যায়সঙ্গত ফয়সালা করবে (মায়েদাহ ৪২)। বলো, আমার রব আমাকে ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন (আ'রাফ ২৯)।আমাকে তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (শুরা ১৫)ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিচারকাজ পরিচালনা না করা সম্পর্কে নবী (সা) কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আউফা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকাজে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্ধ্বে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায়।” (তিরমিজি, ইবনে মাজা)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন