রমজানে আসলে কী শয়তানকে বন্দি করা হয়?


রমজান মাস এলেই শুনি শয়তানকে বন্দি করা হয়। তাহলে রমজান মাসে তারপরও এতো পাপ কাজ কেমনে সংঘটিত হয়। এই প্রশ্নের সূত্র ধরেই আজকের আলোচনা।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান উপস্থিত হয়, জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুষ্ট শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়।’ (মুসলিম, হাদিস -১০৭৯)
এবার একটি ঘটনা বলি, মির্জা গালিব ছিলেন ভারতবর্ষে মোঘল-সম্রাজ্যের শেষ ও ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের একজন উর্দু এবং ফার্সি ভাষার কবি । সাহিত্যে তার অনন্য অবদানের জন্য তাকে দাবির-উল-মালিক ও নাজিম-উদ-দৌলা উপাধি দেওয়া হয়। গালিব মদ্য পান করতেন এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তার নিষ্ঠা ছিল না৷ সেজন্যেও তাকে তীব্রভাবে সমালোচিত হতে হয়েছে৷ সুরার প্রতি আসক্তিকে গালিব মনে করতেন আশির্বাদ৷ তিনি লিখেছেন,
"ও আসাদ, সুরা পান করতে অস্বীকারকারী পুরোপুরিই অজ্ঞ; তার বেহেশতের সাকীর ভালোবাসা ছাড়া সুরা নিষিদ্ধ৷" যাই হোক অনেক অপ্রাস‌ঙ্গিক কথার অবতারণা করলাম। কোনো এক রমজানে একজন হাদিস বিশারদ মুহাদ্দিস বন্ধু গালিবের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে করলেন, গালিবকে একটু দাওয়াত দিয়ে যাই।মির্জা গালিবের বাসায় এসে দেখলেন গালিব তার কক্ষে বসে বন্ধুদের নিয়ে মদ পান করছেন এবং জুয়া খেলছে। মুহাদ্দিস বন্ধু বললেন, "গালিব, আমি হাদিসে পড়েছি রমজানে শয়তানকে বন্দি করা হয়। তোমার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি না আমি কি ভুল হাদিস পড়েছি ? না বুঝতে ভুল করেছি।" জবাবে গালিব বললেন, " দোস্ত তুমি হাদিস ঠিকমতই পড়েছ, বুঝতেও ভুল করোনি। যেটা বুঝ নাই সেটা হচ্ছে শয়তানকে যে কক্ষে বন্দি করা হয়েছে সেটাই হচ্ছে আমার এ কক্ষ।"
ঘটনাটি এমনি বর্ণনা করলাম যাতে আপনারা পরিষ্কারভাবে বুঝুতে পারেন।
আমাদের প্রশ্ন জাগে, রমজান মাসে শয়তান শিকলে আবদ্ধ থাকলে মানুষ রমজানে কিভাবে পাপ করে? এর বেশ কিছু জবাব হাদিস বিশারদরা দিয়েছেন।
এক. কাজি ইয়াজ (রহ.) বলেন, শয়তান শিকলে আবদ্ধ থাকার অর্থ আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থেই হতে পারে। রূপক অর্থে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রমজানে শয়তানের ধোঁকা-প্রবঞ্চনার হার কমে যায়, অন্যায় কাজ কম হয় এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিধান পালনের প্রতি আগ্রহ প্রবল থাকে। এ অর্থে উল্লিখিত হাদিসে বাস্তব জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যার বাস্তবতা আমরা সবাই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে থাকি। (ইকমালুল মুলিম : ৪/৬) আর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করা হলে হাদিসের অর্থ হলো, মানুষ পাপ করে দুই কারণে—১. তার কুপ্রবৃত্তি ও বদ-অভ্যাসের কারণে; ২. শয়তানের প্ররোচনায়। রমজানে শয়তান বন্দি থাকলেও কুপ্রবৃত্তির কারণে মানুষ পাপ করে থাকে। (ফাতহুল বারি : ৪/১১৪)
দুই. আল্লামা আইনি (রহ.) বলেন, শয়তানকে ওই সব রোজাদার থেকে দূরে আবদ্ধ রাখা হয়, যারা রোজার আদব ও শর্ত সঠিকভাবে পালন করে। কিন্তু যারা সেসবের ধার ধারে না, তাদের থেকে শয়তানকে আবদ্ধ না-ও রাখা হতে পারে। (উমদাতুল কারি : ১০/২৭০)
তিন. রমজানের আগে কৃত পাপের প্রভাবে মানুষ পাপ করে থাকে। যেমন একটি লোহা দীর্ঘক্ষণ আগুনে রাখার পর তা থেকে বের করা হলেও বেশ কিছুক্ষণ তার প্রভাব বাকি থাকে, একইভাবে গাড়ির চাকা দীর্ঘ সময় চলার পর থামানো হলেও কিছুদূর পর্যন্ত চলতে থাকে; ঠিক তেমনি ১১ মাসের পাপের প্রভাবে রমজানেও কারো কারো কাছ থেকে পাপ হয়ে থাকে।
চার. কোনো কোনো হাদিস ব্যাখ্যাকারী বলেছেন, রমজানে সব শয়তানকে বন্দি করা হয় না, অতিরিক্ত দুষ্ট শয়তানকে বন্দি করা হয়। তাই অন্য শয়তানদের প্ররোচনায় মানুষ পাপ করে। (ফাতহুল বারি : ৪/১১৪)
পাঁচ. মহান আল্লাহ কোরআনের সুরা নাসে বান্দাদের মানুষ শয়তান ও জিন শয়তান উভয় থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যারা মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মানুষের মধ্যেও এক ধরনের শয়তান রয়েছে, যারা মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। রমজানে জিন শয়তানকে বন্দি রাখা হলেও মানুষরূপী শয়তানদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল