সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সালাউদ্দীন আইয়ুবীর মহানুভবতা

 









সালাহউদ্দিন আইয়ুবী(১১৩৭– ১১৯৩) বর্তমানের ইরাকের তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন।তার পুরো নাম আবু-নাসির সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তার ব্যক্তিগত নাম ইউসুফ, সালাহউদ্দিন হল লকব যার অর্থ “বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ”।পাশ্চাত্যে তিনি সালাদিন নামে পরিচিত। তাঁর পরিবার কুর্দি বংশোদ্ভূত এবং মধ্যযুগীয় আর্মেনিয়ার ডিভিন শহর থেকে আগত।নুরউদ্দিন জংগি ছিলেন তার নানা।সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার তিনি অধিপতি হয়েছিলেন। লেভান্টে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সালাউদ্দীন মুসলিম প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। শুধু মুসলিম ইতিহাস নয়, শত্রুর কাছেও তিনি ছিলেন সম্মানিত এক বীর।
তৃতীয় ক্রুসেডের যুদ্ধ চলাকালে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড এক বিশাল বাহিনী নিয়ে জেরুজালেমের একরি নামক শহর কয়েক মাস অবরোধ করে রাখলে সেখানকার মুসলমানরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। পরে রাজা রিচার্ডের বাহিনী একরিতে বসবাসকারী অবরুদ্ধ অসহায় মুসলমানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। রাজা রিচার্ডের এই জঘন্য কাজে সুলতান সালাউদ্দিন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে রাজা রিচার্ডের বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। যুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে একদিন দেখা গেল রাজা রিচার্ডের যুদ্ধ শিবিরে সাদা পতাকা উড়ছে। কি ব্যাপার? রাজা রিচার্ডের এত তাড়াতাড়ি যুদ্ধ বিরতি দেয়ার কোন কারন সুলতান সালাউদ্দিন খুজে পাচ্ছেন না। পরে তিনি গোপনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন রাজা রিচার্ড গুরুতর অসুস্থ। সুলতানের অনেক সঙ্গী সাথী তাঁকে এই সুযোগে রাজা রিচার্ডকে আক্রমন করার জন্য বলল। তিনি সঙ্গীদের জানালেন অসহায় অসুস্থকে আক্রমন করা বীরের ধর্ম নয়। তিনি অসুস্থ রাজাকে আক্রমন না করে তার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু তার সুস্থতার কোন খবর পাওয়া গেল না, এ যেন রাজা রিচার্ডের জীবনের আলো নিভে আসছে। এবার গাজী সালাউদ্দিন দরবেশের ছদ্মবেশ নিয়ে রাজা রিচার্ডের শিবিরে গেলেন এবং অসুস্থ রাজার সাথে দেখা করে তার চিকিৎসার ভার নিলেন। শুরু হল চিকিৎসা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সুলতান দরবেশের ছদ্মবেশে রাজাকে ঔষুধ খাইয়ে সারারাত সেবা করে ভোরে আবার ঔষুধ খাইয়ে ফিরে যান। এভাবে তাঁর নিবিড় চিকিৎসায় তিন সপ্তাহের মধ্যেই রাজা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। শেষ দিন দরবেশ বিদায় নিতে চাইলে রাজা তাঁকে কিছু উপহার দিতে চাইলো। কিন্তু তিনি কিছুই নিলেন না।
অসুস্থ অবস্থায় রাজা তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করতে পারেননি তাই এবার তিনি তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। দরবেশ বললেন, “আমার পরিচয় না জানলেই কি নয়?” রাজার অনেক পীড়াপীড়ীর পর তিনি বললেন, “আমার পরিচয় জেনে আপনি ভয়ে চমকে উঠবেন নাতো?” রাজা রিচার্ড বললেন, আমি ভীরু কাপুরুষ নই যে কারো জন্য ভয় পাব। গাজী সালাউদ্দিন তখন বললেন, “আপনি যার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছেন আমিই সে সালাউদ্দিন।’তাঁর কথা শুনে রাজা রিচার্ডের মাথায় যেন বজ্রপাত হল। গাজী সালাউদ্দিন এবার ছদ্মবেশ খুলে সুলতানের বেশে রাজার সামনে দাড়ালেন। রাজা সুলতান সালাউদ্দিনকে দেখে চমকে উঠলো। শত্রুর প্রতি এমন আচরণ রাজা রিচার্ড কল্পনাও করতে পারেনি। সুলতান বললেন, “আপনি আমার সাথে যুদ্ধ করার জন্য এসেছেন। যদিও আপনি আমার শত্রু তবুও আপনি আমার রাজ্যের অতিথি। আপনার বিপদ আমাকে বিচলিত করেছে। তাই আপনাকে সেবা করার জন্য এই ছদ্মবেশ ধারন করি।
রাজা রিচার্ড সুলতান সালাউদ্দিনের কাছে ইসলামের আদর্শ নীতির পরিচয় পেয়ে সকল শত্রুতা ভুলে গেলেন। তিনি বললেন, “যার আদর্শ এত মহান তার সাথে শত্রুতা হতে পারে না, হতে পারে বন্ধুত্ব। আজ থেকে আমরা শত্রু নই, বন্ধু। অতপর তিনি সুলতানের সঙ্গে শান্তি-চুক্তি করে তার বাহিনী নিয়ে ইউরোপে ফিরে যান।। রিচার্ড‌ একবার সালাহউদ্দিনকে মহান রাজা বলে প্রশংসা করেন এবং বলেন যে কোনো সন্দেহ ছাড়াই তিনি ইসলামি বিশ্বের সবচেয়ে মহান ও শক্তিশালী নেতা।সালাহউদ্দিনও রিচার্ড‌কে খ্রিষ্টান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত বলে উল্লেখ করেন।
আরেকটি ঘটনা আমরা জানতে পারি, যখন রিচার্ড নিজের ঘোড়া হারিয়ে বিশাল মুসলিম বাহিনীর সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন ময়দানে, তখন মুসলিমরা তাকে আক্রমণ করেনি। বরং, সুলতান সালাহউদ্দিন তার জন্য দুটো ঘোড়া পাঠিয়ে দেন যেন সমানে সমানে যুদ্ধ হতে পারে।
একবার জেরুসালেমের রাজা গাই অব লুসিগনানকে বন্দী করা হয়। মৃত্যু ভয়ে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তবে সালাহউদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন এবং বলেন যে, “রাজা অন্য রাজাকে হত্যা করে না।
একদিন এক খ্রিস্টান মহিলার তিন মাসের বাচ্চা চুরি হয়ে যায়, এবং সেই বাচ্চাকে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। খ্রিস্টানরা তাকে বলল সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে যেতে। মহিলাটির কষ্ট জানবার পর সালাহউদ্দিন নিজের টাকায় বাচ্চাটি কিনে নেন আবার, এবং মহিলাটিকে ফিরিয়ে দেন। সালাহউদ্দিনের দরবারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মহিলার চোখ থেকে। সালাহউদ্দিন একটি ঘোড়ায় করে তাকে নিজের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।
১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখলের পর ক্রুসেডারদের গণহত্যার পরও সালাহউদ্দিন সব সাধারণ খ্রিষ্টান ও এমনকি খ্রিষ্টান সেনাদেরও ক্ষমা করেন ও নিরাপদে যেতে দেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ব্রিটিশ জেনারেল এডমন্ড এলেনবি তুর্কিদের কাছ থেকে দামেস্ক দখল করতে সফল হন। কিছু সুত্র মতে শহরে তার প্রবেশের পর তিনি সালাহউদ্দিনের বিখ্যাত ভাস্কর্যের সামনে তার তলোয়ার উচিয়ে স্যালুট জানান এবং ঘোষণা করেন, “আজ ক্রুসেডের যুদ্ধ সম্পূর্ণ হল”। তিনি আজীবন ১৯১৭ সালে তার ফিলিস্তিন বিজয়কে ক্রুসেড হিসেবে বলার বিরোধীতা করেছেন। ১৯৩৩ সালে তিনি বলেন: "জেরুজালেম কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এ যুদ্ধে কোনো ধর্মীয় কারণ ছিল না।"ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তার বিজয়কে কার্টুন প্রকাশের মাধ্যমে উদযাপন করে। এতে দেখানো হয় যে রিচার্ড‌ স্বর্গ থেকে জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং শিরোনাম ছিল "শেষ পর্যন্ত আমার স্বপ্ন সত্য হল।
আজও কানে ভাসে ইতিহাসে পড়া ইহুদী খ্রিস্টানদের সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাণী। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ ক্রুসেডাররা ইসলামের সর্বশেষ খিলাফতে থাকা অঞ্চল তুরস্ক থেকেও খিলাফতকে ধ্বংস করল। লর্ড কার্জন বলল, আমরা মুসলিমদের মেরুদণ্ড খিলাফতকে ধ্বংস করে দিয়েছি, তারা আর দাঁড়াতে পারবে না। তারা সেই সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর কবরে লাথি মেরে বলল উঠলো, উঠো সালাহুদ্দীন, তোমার বায়তুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা কর।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...