হযরত ওমরের জেরুজালেম গমন ও ওমর মসজিদ




ওমর মসজিদ জেরুজালেমের চার্চ অব দ্য হলি সেপালচারের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সৈন্যরা জেরুজালেমের কাছাকাছি চলে আসে। তখন জেরুজালেমের দায়িত্বে ছিলেন বাইজেন্টাইন সরকারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় খ্রিস্টান গীর্জার প্রধান যাজক সোফ্রোনিয়াস। জেরুজালেম দখলের ঘটনাটি ছিল এরূপ- হযরত ওমর (রা)-এর আদেশে সাহাবী আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা) জেরুজালেম অধিকার করবার জন্য এগিয়ে যান মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে। সামনে সামনে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)। নভেম্বরে জেরুজালেমে এসে পৌঁছায় মুসলিম বাহিনী। ছয় মাস অবরোধ করে রাখার পর নগরকর্তা সোফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। তবে শর্ত একটাই, হযরত ওমর (রা)-কে নিজে আসতে হবে, তাঁর হাতেই সমর্পণ করবেন।এই পরিস্থিতিতে হযরত ওমর (রা) তার এক গোলামকে সঙ্গে নিয়ে জেরুজালেমের পথে রওনা দেন। দুইজনের যানবাহন ছিল একটিমাত্র উট। তাই পালা করে ওমর (রা) এবং গোলাম উটে চড়তেন। ওমর (রা) যখন উটে চড়তেন, তখন গোলামটির হাতে থাকত উটের রশি আর গোলামটি যখন উটে চড়ত, তখন ওমর (রা) এর হাতে থাকত উটের রশি। এভাবেই তারা জেরুজালেমের কাছে পৌঁছেন। অবস্থা এমন হলো যে, ওমর (রা) জেরুজালেম শহরে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে। অর্ধ পৃথিবীর খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান। ২২ লাখ বর্গমাইলের বিশাল সাম্রাজ্যের খলিফাতুল মুসলিমিনের হাতে উটের রশি। উটের ওপর বসে আছে তাঁর গোলাম। ওমর (রা) এর গায়ে অতি সাধারণ জামা। চৌদ্দটি তালি জামায়! উটের রশি ধরে টানছেন মুসলিম বিশ্বের খলিফা। আর গোলাম বসে আছে উটের ওপর। এটা দেখে রোমানরা কী মনে করবে!
এসব ভেবে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি বলেন, “হে আমিরুল মুমিনিন! আমরা এমন এক জায়গায় আছি, যেখানকার লোকেরা চাকচিক্য পছন্দ করে। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে মানুষের মর্যাদার বিচার করে। তাই আপনি যদি একটু ভালো পোশাক পরতেন, তাহলে তা কতইনা উত্তম হতো!”
এ কথায় ওমর (রা) রেগে গেলেন। তার বুকে আঘাত করলেন। আর বললেন, আমি তোমার পক্ষ থেকে এ কথাগুলো আশা করিনি। এরপর ওমর (রা) বললেন, “আমরা হচ্ছি সেই জাতি, যাদেরকে মহান আল্লাহ ইসলাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন। আমরা যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সম্মান খুঁজি, তাহলে মহান আল্লাহ আমাদেরকে অসম্মানিত করবেন।”
সোফ্রোনিয়াস অবাক বিস্ময়ে দেখলেন কোনো জাঁকজমক ছাড়াই হযরত ওমর(রা) ও তাঁর দাস আর উট নিয়ে জেরুজালেম এসেছেন। তিনি ঘুরিয়ে দেখালেন পবিত্র শহরটি। যখন নামাজের সময় হলো, তখন সোফ্রোনিয়াস তাঁকে গির্জায় আহ্বান জানালেন, কিন্তু ওমর(রা) “না” বললেন। তিনি জানালেন, এখন যদি তিনি এই গির্জায় নামাজ আদায় করেন, তাহলে পরে মুসলিমরা এই গির্জা ভেঙে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। এতে খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান হারাবে।
(He then visited the Church of the Resurrection (today better known as the Church of the Holy Sepulchre) where Sophronius invited him to pray inside the church, but Omar declined so as not to set a precedent and thereby endanger the church's status as a Christian site. Instead he prayed outside.)ওমর (রা) এখানে কোনো জবরদস্তি করা থেকে বিরত থাকলেন এ কারণে যে, এটাই সেই জায়গা যেখানে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানের গুহাতেই তাঁর দেহ রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই গির্জা এখনো আছে, যার নাম হলো চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার। ওমর (রা) গীর্জার বাইরে নামাজ আদায় করেন যেখানে পরবর্তীতে একটি মসজিদ নির্মিত হয় (যা মসজিদে উমর নামে পরিচিত)। ওমর মসজিদের বর্তমান রূপটি আইয়ুবীয় শাসনের সময় সুলতান আল-আফদাল ইবনে সালাহ আদ-দিন কর্তৃক ১১৯৩ সালে ওই ঘটনার স্মৃতি স্বরূপ নির্মিত হয়। এর ১৫ মিটার (৪৯ ফুট) উঁচু মিনারটি ১৪৬৫ সালের আগে নির্মিত হয়। অটোমান সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ এটি পুনঃনির্মাণ করেন।
অমুসলিমদের উপাসনালয় রক্ষায় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) একটি রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের জন্য তিনি একটি সংবিধান রচনা করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জীবন ও সম্পদ, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না এবং কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন বা হামলা করা যাবে না। (তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক, তারিখে তাবারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল