মুনাফিক দেখতে কেমন ?

আমাদের সমাজে মানুষের মতো দেখতে এমন কিছু প্রাণী আছে, যারা সব মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিরগিটির মতো ঘনঘন রং বদলায়। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো এই মানুষগুলোকে আমরা মুনাফিক বলে থাকি। প্রথমত, মুনাফিক শব্দটি 'নিফাক' শব্দমূল থেকে এসেছে, যার অর্থ কোনো কিছুকে গোপন রেখে এর বিপরীত কথা বা কাজ প্রকাশ করা।দ্বিতীয়ত, মুনাফিক শব্দটির উদ্ভব হয়েছে নফক শব্দ থেকে যার অর্থ- ছিদ্র, গর্ত, বের হওয়া, সুড়ঙ্গ, খরচ করা, ব্যয় করা। কারো কারো মতে, ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বা পাহাড়ি ইঁদুর থেকে মুনাফিক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। পাহাড়ি ইঁদুরকে ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বলা হয়। কারণ এরা উভয় অত্যন্ত ধূর্ত হয়, এদের সহজে চিন্হিতক করা যায় না।1 : a person who puts on a false appearance of virtue or religion. 2 : a person who acts in contradiction to his or her stated beliefs or feelings.মুনাফিকের সংজ্ঞায় সাইয়্যেদ মুফতি আমিনুল ইহসান বলেছেন, মুনাফিক হলো এমন ব্যক্তি যে ইসলামকে মুখে প্রকাশ করে এবং অন্তরে কুফরিকে লালন করে।অর্থাৎ মুনাফিক বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যে অন্তরে কুফরি ও ইসলামবিরোধিতা রেখে মুখে ও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রকাশ করে এবং মুসলমান হওয়ার দাবি করে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা) হতে বর্ণিত যে, রাসুল (সা) বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে উক্ত স্বভাবগুলোর কোন একটি থাকে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকির একটি স্বভাব থেকে যায়- ১. তার কাছে কোনো আমানত রাখলে খিয়ানত করে ২. সে কথা বললে মিথ্যা বলে ৩. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে ৪. ঝগড়া করলে গাল-মন্দ করে। (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)এরা খুব চালাক প্রকৃতির হয়। ফলে এদের জালে আটকা পড়ে থাকতে হয় সরলমনা মুমিনদের। এরা সব সময় মানুষকে ব্যবহার করে, কিন্তু কখনো কারো কল্যাণে কাজ করে না। উপরন্তু সুযোগ পেলেই মানুষের ক্ষতি করে বসে। মহান আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন।আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ৮ থেকে ২০ পর্যন্ত মোট ১৩টি আয়াত মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে নাজিল করেছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন সুরায় আরো ৩৮টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করেছেন।এরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন তারা তোমাদের নিকট আসে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি। অথচ অবশ্যই তারা কুফরি নিয়ে প্রবেশ করেছে এবং তারা তা নিয়েই বেরিয়ে গেছে। আর আল্লাহ সে সম্পর্কে জ্ঞাত, যা তারা গোপন করত।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত -৬১)মুনাফিকরা হক কথা শোনার ব্যাপারে বধির, তারা হক কথা শোনে না, সত্য কথা বলার ব্যাপারে মূক ও বোবা এবং সত্য কথা বলে না। সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার ব্যাপারে অন্ধ। আল্লাহ তাআলা সুবিধাভোগীদের অবস্থা বর্ণনা করেন, ‘তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। তারা (হকের দিকে) আদৌ ফিরে আসবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮)গুছিয়ে মিথ্যা বলা মানুষগুলো সবার প্রিয় হয়, আস্থাভাজন হয়। কিন্তু পবিত্র কোরআনে এদের মুনাফিক বলা হয়েছে, এদের থেকে সাবধান থাকা উচিত। এ রকম লোকদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর রাসুলকে সাবধান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল এবং আল্লাহ জানেন যে অবশ্যই তুমি তাঁর রাসুল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা মুনাফিকুন, আয়াত -১)
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর নাম আমরা অনেকেই জানি। নবীযুগের মুনাফেক-সর্দার।তার মৃত্যুর পরে জানাযা পড়া নিয়ে রাসূল (সা.) এর একটি হাদীসও বর্ণিত আছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন যে- আব্দুল্লাহ বিন উবাই নামক মুনাফিক নেতা যখন মৃত্যু বরণ করলেন তখন তার ছেলে আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে এসে বলল যে, হে রাসূল আপনার পরিধেয় কাপড়টি চাই আমার পিতার কাফনের কাপড় হিসেবে এবং আপনি আমার পিতার জানাযার নামাজ পড়াবেন ও তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।
এ কথা শুনে রাসূল তার কাপড় দিলেন এবং জানাযার নামাজ পড়ানোর জন্য যথা সময়ে প্রস্তুতি নিলেন। এই কথা হযরত ওমর (রা.) শোনা মাত্র এসে রাসূলুল্লাহর জামা টেনে ধরলেন এবং বললেন হে রাসূল, মুনাফিকদের জানাযা পড়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাকে নিষেধ করেননি কি? তখন রাসূল (সা) বললেন দোয়া পড়া না পড়া উভয় আমার ইচ্ছা, আল্লাহ পাক এই ব্যাপারে আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই কথা বলে রাসূল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জানাযা পড়ালেন।
এই ঘটনার পরে মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে রাসূল (সা.) এর কাছে ওহী নাজিল হলো যে, ‘হে রাসূল (সা.), মুনাফিকদের কেউ মারা গেলে আপনি তাদের জানাযার নামাজ আদায় করবেন না এমনকি তাদের কবরের পাশেও দাঁড়াবেন না।’ (সূরা আত -তাওবাহ, আয়াত ৮৪)
মুনাফিকদের শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদীস সমূহতে কঠিন বর্ণনা দেয়া আছে। ইহকালে মুনাফিকরা সম্মানের অধিকারী হতে পারেনা, সাড়াজীবন অপবাদ, ঘৃণা, অসম্মান, এইসব নিয়েই বেঁচে থাকে এবং মৃত্যুর পরেও ভোগ করতে হয় জাহান্নামের কঠিন আযাব। মুনাফিকদের শাস্তি সম্পর্কে ইসলামের পবিত্র ধর্মীয় কিতাব পবিত্র আল কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকদের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর।’ (সুরা নিসা আয়াত ১৪৫)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল