কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন পূরণে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী
১০৯৯ সালের কোনো এক সময়ের একটি ঘটনা। বায়তুল মুকাদ্দাস তখন খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে। সেময় বাগদাদ শহরের এক কাঠমিস্ত্রি বসবাস করতেন। এ কাঠমিস্ত্রি মনের ভালোবাসা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত একটি মিম্বার তৈরি করেন।মিম্বারটি সৌন্দর্যের কথা লোক মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তা দেখতে মানুষ দলে দলে কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে আসতে শুরু করে। অনেকেই মিম্বারটি কিনতে চায়। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তার একই জবাব-‘এ মিম্বার বিক্রির জন্য নয়; বরং এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য‘ কাঠ মিস্ত্রির কথা শুনে সবাই হাসতো। অনেকে তাকে পাগল বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল-অবিচল।
অনেকদিন পর...একদিন এক ছোট্ট ছেলে তার বাবার হাত ধরে মিম্বারটি দেখতে এসেছিল। কাঠমিস্ত্রির কাছে তার স্বপ্নে কথাও জেনেছিল। সেদিনই ওই ছোট্ট ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করেছিল- সে কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই ছেলেটি আর কেউ নন; তিনি হলেন- বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর হাত ধরেই পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে আসে। আর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর সেই মিম্বারটি এ মসজিদে স্থাপন করেছিলেন।শুধু কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন নয় সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সেদিন সমগ্র মুসলিম জাতির স্বপ্ন যেন পূরণ করেছিলেন।
বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা। অসংখ্য নবি-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও মর্যাদপূর্ণ ইবাদতের জায়গা এ বায়তুল মুকাদ্দাস। রাসুলুল্লাহ (সা) ঐতিহাসিক মেরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা এ বায়তুল মুকাদ্দাসেই প্রথম সফর করেন। মসজিদে আকসা বহুকাল ধরে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ছিল। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর (রা)'র খেলাফেতের সময় ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন পুরোপুরি মুসলমানদের অধিকারে আসে। কালের পরিক্রমায় ১০৯৯ সালের ৭ জুন খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেন। ১৫ জুলাই ১০৯৯ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে।১৫ জুলাই ১০৯৯ সালে খ্রিস্টানরা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে। মসজিদে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।সেদিন মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদসের ভেতর ও বাহির। এভাবেই জেরুজালেমের ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এভাবেই অব্যাহত থাকে জেরুজালেম ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসার দখল।ফিলিস্তিনের মুসলিমরা একজন নেতার অপেক্ষায় দিন অতিবাহিত করছিল। যে নেতার নেতৃত্বে মুসলিমরা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সেই ঈমানী দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে মসজিদে আকসা ও জেরুজালেম নগরী দখলদার ইহুদিবাদি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তারা ফিলিস্তিনের ভূখন্ড দখল করে নিচ্ছে।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে। ১১৩৭ সালে জন্ম গ্রহন করেন সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব।তার নাম ইউসুফ, সালাহউদ্দিন হল উপাধি যার অর্থ ‘বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ’। তিনি ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।এ ক্রুসেড বিজয়ী বীর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দামেস্কে মারা গেলেন , ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ। মৃত্যুর আগে তিনি সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন গরীব দুঃখীদের। মাত্র এক স্বর্ণমুদ্রা আর চল্লিশ রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার বাকি। তার জানাজা-দাফন-কাফনের টাকাটাও হচ্ছিল না। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাহিরের বাগানে তাঁকে দাফন করা হয়। আটশ বছর পর আজ শুধু ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম মানবাত্মা একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জন্য কাঁদছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে।তাঁর কালজয়ী উক্তি,‘কোন জাতিকে যদি যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করতে চাও , তাহলে তাদের তরুণদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দাও’।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন