মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে কাদের গালি দেন? জানুন সঠিক ইতিহাস
সহিংস ও বিভীষিকাময় কোনো ঘটনা ঘটলেই অনেকে একে মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে চালিয়ে দেন। অনেকে না বুঝে আবার কেউ নিজেকে অধিক প্রগতিশীল হিসেবে পরিচয় দিতে এই শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করেন। আসলেই মধ্যযুগ কি এতোটাই নৃশংস ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ ছিল মধ্যযুগ, এই যুগ ছিল মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করার যুগ। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবেত্তাগন মধ্যযুগকে অসভ্য বর্বর বলে মুসলমানদের আবিষ্কার গুলোকে জনসম্মুখ থেকে লুকিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদেরকে অতীত ইতিহাস থেকে জানতে হবে, আমাদের কী গর্ব অহংকারের কোন আবিষ্কার নেই?
তাহলে জেনে আসি মূল ঘটনা। মধ্যযুগ কালবিভাজন অনুযায়ী ৬০০ সাল থেকে ১৩০০ সাল। সপ্তম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়। ৬২২ সালে মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি শক্তির উত্থানের সময় থেকে শুরু হয় এ যুগের। ১২৫৮ সালে মঙ্গলদের দ্বারা বাগদাদ অবরোধের সময়কে এর সমাপ্তিকাল ধরা হয়।অনেকে ১৪৯২ সালে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের আন্দালুসে খ্রিষ্টান রিকনকোয়েস্টার ফলে গ্রানাডা আমিরাতের পতনকেও এর সমাপ্তিকাল হিসেবে গণ্য করেন।আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নব্যুয়াত পান ৬১০ সালে। ৬২২ সালে হিজরত এবং মদিনায় ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ। এরপর ১৩০০ সাল পর্যন্ত দুনিয়া জুড়ে ইসলামের একটানা আধিপত্য ছিল। দুনিয়াব্যাপী ইসলামী হুকুমতের সে যুগটাই নাকি অন্ধকার যুগ। খোলাফায়ে রাশেদীন সহ মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানুষ গুলো দ্বারা পরিচালিত যুগতাই নাকি বর্বরতার যুগ। একজন মুসলিম হিসেবে বিষয়টা খতিয়ে না দেখে মূর্খের মত গালি হিসেবে ব্যবহার করব তা বোধকরি নিজের অস্তিত্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা।
আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের (৭৮৬-৮০৯) সময় বাগদাদে বায়তুল হিকমাহর প্রতিষ্ঠার ফলে জ্ঞানচর্চার প্রভূত সুযোগ সৃষ্টি হয়।ফাতেমীয় যুগে (৯০৯-১১৭১) মিশর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, আফ্রিকার লোহিত সাগর উপকূল, তিহামা, হেজাজ ও ইয়েমেন এর অন্তর্গত ছিল। এই যুগে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাণিজ্য ও শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। আরবরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিল। হারিয়ে যেতে থাকা অনেক ধ্রুপদি রচনা আরবি ও ফারসিতে অনূদিত হয়। আরো পরে এগুলো তুর্কি, হিব্রু ও ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিক, রোমান, পারসিয়ান, ভারতীয়, চৈনিক, মিশরীয় ও ফিনিশিয় সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তারা গ্রহণ, পর্যালোচনা ও অগ্রগতিতে অবদান রাখে।উমাইয়া(৬৬১-৭৫০) ও আব্বাসিয়(৭৫০-১২৫৮) খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকোতায় গ্রিক দার্শনিকদের কাজগুলো এবং বিজ্ঞানের প্রাচীন জ্ঞানগুলোকে সিরিয় ভাষা অনুবাদ করান যা পরে আরবিতে অনুদিত হয়।তারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন দর্শন, বিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ দেখান। স্বর্ণ যুগে কাগজের নতুনভাবে ব্যবহার বই রচনা ও জ্ঞান চর্চাকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে মুসলিম অঞ্চলে কাগজের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল, দশম শতাব্দীতে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের আল-আন্দালুস (আধুনিক স্পেন এবং পর্তুগাল) পৌঁছেছিল।
মুসলিম ও মানব সভ্যতার জন্যে মধ্যযুগটা সোনালী যুগ হলেও ইউরোপ, খ্রিস্টান আর রোমানদের জন্যে আসলেই এটি ছিল অন্ধকার যুগ ।পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতন, ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধ, মুসলমানদের একের পর এক বিজয় , মুসলমানদের কাছে কন্সটেনটিনপল হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সবই ঘটেছিল সেই মধ্যযুগে। শিক্ষা দীক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সহ জীবন যাত্রায় ইউরোপ ছিল খুবি অনুন্নত ।মজার কথা হলো মুসলিম স্পেন যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন তখন ইউরোপ অজ্ঞতা-বর্বরতায় ছিল নিমগ্ন। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, ‘All Europe was then plunged in barbaric ignorance and savage manners.’ অর্থাৎ তখন গোটা ইউরোপ বর্বর অজ্ঞতা ও বুনো ব্যবহারে নিমজ্জিত ছিল।স্পেনের কর্ডোভা ছিল স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। কর্ডোভার সভ্যতা আর জ্ঞান শিখা সমগ্র ইউরোপ গগণে রবি রশ্মির ন্যায় বিচ্ছুরিত হতো। এজন্য সেই সময় কর্ডোভাকে ইউরোপের বাতিঘর বলা হতো। কর্ডোভার অনবদ্য অবদান ও কীর্তি দেখে জার্মানির এক মঠবাসী সন্ন্যাসী বিমোহিত হয়ে বলেছিলেন, Cordova,The Jewel the World.তৎকালীন স্পেনে জ্ঞান চর্চা এতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বিখ্যাত ওলন্দাজ ঐতিহাসিক ডোজি তাঁর বিখ্যাত Spainish Islam গ্রন্থে উদার চিত্তে স্বীকার করেছেন যে, ‘স্পেনের প্রতিটি নাগরিক লেখাপড়া জানতো। অথচ সেই সময় সমগ্র ইউরোপ অজ্ঞতা ও মূর্খতায় নিমজ্জিত ছিল। নারীদের অধিকার বলতে তেমন কিছুই ছিলনা । নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ , লুট তরাজ, খুন খারাবি সহ বর্বরতা লেগেই থাকত । ব্লাক ডেথ নামের এক মহামারিতেই ইউ কে র প্রায় ১/৩ মানুষ মারা গিয়েছিল। এসব মিলিয়ে যুগটা তাদের জন্যে অন্ধকার যুগ বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন সভ্যতাসমূহ যথা মিশরীয়, গ্রীক, রোমান, পারসিয়ান, ইন্ডিয়ান, চাইনিজ এবং ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের মাঝখানে একটা গ্যাপ দেখা যায় যাকে ‘অন্ধকার যুগ’ (The dark ages) বলা হয়ে থাকে। ঐসময় জ্ঞানের আলোক শিখা যারা ধারণ করেছিলেন তারা পশ্চিমা নন, তারা হলেন অন্য সংস্কৃতির একদল মানুষ যারা মুসলিম নামে পরিচিত। সপ্তম শতাব্দী থেকে ১৩তম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় সভ্যতার অন্ধকার সময় (The dark ages) হিসাবে ইতিহাসে স্বীকৃত। ঐ সময় হলো আরব বিশ্ব তথা ইসলামী সাম্রাজ্য বিকাশের ঘটনাবলিতে ভরপুর। সে সময় বিজ্ঞান ছিল মধ্য-দুপুরের উজ্জ্বল তেজস্বী সূর্য কিরণের মত দেদীপ্যমান। ঐ সময়টাকে অযৌক্তিকভাবে, অবহেলা করে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেন তখনকার সময় কিছুই ঘটেনি। এটা হলো মহা তথ্যসন্ত্রাস। আর এ সন্ত্রাসের জনক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী আজকের বিশ্বের তথাকথিত আলোকিত মানুষেরাই।বিজ্ঞনের অগ্রগতি নিয়ে অধ্যাপক জি সারটন তার গ্রন্থে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানের প্রতি অত্যন্ত বিনয় ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন,এখানে মুষ্টিমেয় কিছু নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে।সাময়িককালে পাশ্চাত্যে তাদের সমতুল্য কেউ ছিলোনা। তারা হলেন:জাবির ইবনে হাইয়ান,আল কিন্দি,আল খাওয়ারিজমি,আল ফারগানি,আল রাজি,ছাবেত ইবনে কোররা,আল বাত্তানি,হুনায়ন ইবনে ইসহাক,আল ফারাবি,ইব্রাহীম ইবন সিনান,আল মাসুদী,আল তাবারীআবুল ওয়াফা,আল ইবনে আব্বাস,আবুল কাসিম,ইবনে আল জাযারি,আল বেরুনি,ইবনে সীনা,ইবনে ইউসুফ,আল কাশি,ইবনে আল হাইছাম,আলি ইবনে ঈশা,আল গাজ্জালি,আল জারকাব,এবং ওমর খৈয়াম।গৌরবোজ্জ্বল নামের তালিকা দীর্ঘ করা মোটেও কঠিন হবেনা।যদি কেউ আপনার সামনে উল্লেখ করে যে,মধ্যযুগ ছিলো অন্ধকার যুগ বৈজ্ঞানিক দিক থেকে অনুর্বর তাহলে তার নিকট এসব নাম উল্লেখ করুন,তাদের সবাই ৭৫০-১১০০সাল পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে সমৃদ্ধি করেছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন