সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমরা কেন মডারেট মুসলিম হতে পারি না



#মো. আবু রায়হান
ইংরেজি মডারেট ( Moderate) শব্দের বাংলা অর্থ মধ্যপন্থী । Make or become less extreme, intense, rigorous, or violent.(Oxford Dictionary) অর্থাৎ চরম নয় এমন, মাঝারি ধরনের মধ্যপন্থী। সে হিসেবে ‘মডারেট মুসলিম’-এর অর্থ ‘মধ্যপন্থী মুসলিম’ করলে হয়তো অতি সরলীকরণ করা হবে। কেননা পরিভাষাটির উদ্ভাবক পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ অর্থেই তা ব্যবহার করে।মডারেট মুসলিম বা মডার্নিস্ট মুসলিম অর্থাৎ আধুনিকতাবাদী মুসলিম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলো ঔপনিবেশিক
শাসন থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। আবার কোথাও পশ্চিমাদের প্রশ্রয়ে দীর্ঘায়িত হয় স্বৈরাচারী সামরিক শাসন। এই দুই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই আশির দশকের শেষভাগে মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ ও জাগরণের সৃষ্টি হয়। পরিবর্তনকামী মুসলিমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলন এবং বৈপ্লবিক কমিউনিস্টদের মতো সশস্ত্র বিপ্লবের পথ—দুটিই অনুসরণ করে। তবে উভয় পদ্ধতি পশ্চিমা স্বার্থ ও অর্থনৈতিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়। তাই এই মুসলিমদের বিপরীতে ইউরোপবান্ধব একটি মুসলিম গোষ্ঠী সৃষ্টি করার জোর তাগিদ অনুভব করে ইউরোপ। মুসলিম হলেও যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবিকে অযৌক্তিক মনে করবে এই শ্রেণির নামই মডারেট মুসলিম। ২০০৪ সাল থেকে আমেরিকা ইসলাম বিকৃত করে নতুন একটি ইসলাম বানাচ্ছে যার নাম মডারেট ইসলাম । এই ধর্মের অনুসারীদের নাম দিয়েছে মডারেট মুসলিম । ১৭ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে এই নতুন ধর্মের প্রচার করে তারা সমস্ত পৃথিবীতে মডারেট মুসলিম তৈরি করে যাচ্ছে।কিন্ত হায়,আমরা অধিকাংশ মানুষ তা জানিই না!
বর্তমানে বাংলাদেশে যেমন মূলধারার মুসলিম রয়েছে আবার অতি প্রগতিশীল দাবীকারী মুসলিম নিজেদের মডারেট পরিচয় না দিলেও তাদের কর্মে তা প্রতিফলিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কার্যক্রম দেখে এমন ধারণা পোষণ করতে হচ্ছে। বস্তুত এরা আদি ও আসল ইসলামকে সেকেলে মনে করে। তাই ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়, ইসলামের পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ বের করতে চায়। এদের এসব ব্যাখ্যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো, ইসলামকে প্রবৃত্তির সঙ্গে মানানসই করা। ইসলামকে পাশ্চাত্য ধারার জীবনব্যবস্থা এবং তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্য আনয়ন করা; যাতে করে ইসলামের ইতিবাচক দিকগুলোও পালন করা যায়, আবার প্রবৃত্তিপূজার অংশ হিসেবে নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যেও অংশগ্রহণ করা যায়। এদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার সুবাদেই বর্তমানে অস্তিত্বলাভ করেছে সবকিছুর ইসলামি (!) ভার্সন। ইসলামি মিউজিক, ইসলামি মদ, ইসলামি সুদ, ইসলামি জুয়া, ইসলামি পতিতালয়, ইসলামি সিনেমাহল, ইসলামি গণতন্ত্র, ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রভৃতি।
এক কথায় মডারেট মুসলিম শব্দগুচ্ছটি ইসলামের বিকৃতরূপ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। যা ইসলামের মূল রূপের সাথে সাংঘর্ষিক। মডারেট ইসলামের থিউরি হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে ইসলাম শান্তির ধর্ম। অর্থাৎ মডারেট মুসলিমদের দাবি হচ্ছে ইসলামের মধ্যে কোন অবস্থাতেই যুদ্ধ, বিদ্রোহ, হত্যা, প্রতিশোধ ইত্যাদি নেই। কাফিররা মুসলিমদের ভূমিতে আক্রমণ করে সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করলেও মুসলিমরা এর প্রতিশোধ নিবে না কিংবা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে না। যদি মুসলিমদের কোন দল উক্ত কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে তাদেরকে সন্ত্রাসী ও চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। মুসলিমদের শাসক আল্লাহর বিধান বাতিল করে নিজেদের তৈরি করা ইসলাম বিরোধী বিধানের মাধ্যমে শাসন করলেও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না, কথা বলা যাবে না। কাফির নাস্তিকরা রাসূলুল্লাহ (সা) কে গালি দিলেও তাদেরকে শায়েস্তা করা যাবে না। মোট কথা, মুসলিম জাতিকে আবেগ অনুভূতিহীন এক অপদার্থ জাতিতে পরিণত করাই হচ্ছে মডারেট ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য।
মডারেট মুসলিমরা নিজেদের আধুনিকতা, সাম্য, মানবিকতা ও উদারপন্থার ধারক বলে দাবি করে। তারা মনে করে, অন্য মুসলিমদের তুলনায় তারা আধুনিক ও উদার। তবে মুসলিম সমাজের সাধারণ ধারণা হলো, যারা দ্বীনচর্চায় উদাসীন, তারাই মডারেট; তারা দ্বীনের আপসকামী। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রেন্ড’-এ প্রকাশিত ‘Building Moderate Muslim Networks’ বইয়ে মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক (ধর্ম অনুমোদিত নয় এমন) আইনি উৎস গ্রহণ, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি সম্মান, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যেদের বিরোধিতা—উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিটিই ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যেমন—নারী অধিকার বলতে উত্তরাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, যা ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের পরিপন্থী।
ইসলাম প্রকৃতপক্ষে যা আসলে তাই। মডারেট ইসলাম বা মধ্যপন্থার ইসলাম বলে আলাদা কিছু নেই। কুরআন, হাদিস, শরিয়াহ আইন, আলেমদের ইজমা ও কিয়াস- এসব নিয়ে যে ইসলাম, তাই আমাদের মানতে হবে। এখানে সংস্কারের কিছু নেই। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানও বলেছেন, ‘মডারেট ইসলাম বলে কিছু নেই’। কারণ, মূল ইসলামকে পাশ্চাত্য ভয় পায়। তাই মূল ইসলামের বিরোধিতা এবং ইসলামের বিরুদ্ধবাদীদের সহায়তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমাজগতের কর্মকাণ্ড চলছে শত শত বছর ধরে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম (ইসলাম) পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসাবে মনোনীত করলাম।( সুরা মায়েদা আয়াত -৩)
দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেবার অর্থই হচ্ছে এর মধ্যে জীবনের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত ও বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায়। হেদায়াত ও পথনির্দেশ লাভ করার জন্য এখন আর কোন অবস্থায়ই তার বাইরে যাবার প্রয়োজন নাই। সুতরাং এ নবীর পরে কোন নবী নেই। এ শরীআতের পরে কোন শরীআত নেই। এ শরীআতে যা যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে সত্য ও ইনসাফপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, “সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই।” [সূরা আল-আন’আম আয়াত - ১১৫] [ইবন কাসীর]
মডারেট মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার দীনকে পরিপূর্ণভাবে মানতে রাজি নয়; বরং তারা দীনের কেবল ততটুকু মানতে চায়, যতটুকু তাদের মনঃপুত হয়, যতটুকু মানতে তাদের কোনো কষ্ট-ক্লেশ সইতে হয় না কিংবা ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হয় না। এবং তা-ও কেবল সে উপায়েই মানতে চায়, যা তাদের সমাজে প্রচলিত কিংবা তাদের পূর্বসুরি বাপ-দাদাদের থেকে প্রাপ্ত। এ ছাড়া আল্লাহ তাআলার অন্যান্য বিধানগুলোকে তারা অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...