হুজুর আর মারবেন না, আমি মরে যাবো, আমাকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন



ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া মাদ্রাসায় হেফজ শ্রেণির ছাত্র ছিল তাওহিদুল ইসলাম। পড়া মুখস্থ করতে না পারায় মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আমিনুল ইসলাম লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাওহিদুলের পাজরের হাড় ও একটি পা ভেঙে দেন। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেন ওই শিক্ষক।ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালে। তাওহিদুল তখন ১৮ পারা কোরআন মুখস্থ করেছিল, কিন্তু মাদ্রাসা থেকে ছেলের লাশ বাড়িতে আসবে কখনও ভাবেননি তার মা। তার মায়ের দাবি, তাওহিদুল মাঝেমধ্যে স্বপ্নে বলতো ‘হুজুর আর মারবেন না, আমি মরে যাবো, আমাকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন।’শেষ পর্যন্ত তাওহিদুল মারা যায় কিন্তু এরপরও থেমে যায়নি শিশু নির্যাতনের ঘটনা। কোমলমতি শিশুদের পিটিয়ে জখম করে কুরআনের হাফেজ বানাতে হবে এই শিক্ষা তারা কোথায় পেলেন?অথচ ইসলাম শিশুদের আদর ভালোবাসা দিয়ে লালন পালনে গুরুত্বারোপ করেছে।
রাসুলুল্লাহ (সা) শিশুদের দেখলে খুব খুশী হতেন। তাদের নিকটে যেতেন, সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করতেন, খোঁজ-খবর নিতেন, মাথায় হাত বুলাতেন, কোলে নিতেন, কাঁধে উঠাতেন, আদর-স্নেহ করতেন, খুব ভালবাসতেন। এমনকি চুমু খেতেন এবং দো‘আ করতেন। তাদের সাথে তিনি আকর্ষণীয়, রসাত্মক ও উপদেশমূলক কথা বলতেন। আবার কিছুটা হাসি-কৌতুকও করতেন। তিনি খাবারে তাদের অংশীদার করতেন, দৌড় প্রতিযোগিতা করাতেন। পথে দেখা হলে নিজের বাহনে চড়াতেন। ভুল করলে ক্ষমা করে সঠিক জিনিসটা বুঝিয়ে দিতেন। তিনি তাদের বকাবকি, মারপিট ও মুখে আঘাত করতে নিষেধ করেন
কোরআনে শিশু শব্দের সমার্থক আরবি চারটি শব্দ মোট ৭৫ বার উল্লেখ হয়েছে। যথা: ‘তিফল’ (শিশু, বালক), ‘ছবিয়্য’ (শিশু, কিশোর), ‘গুলাম’ (শিশু, তরুণ) ও ‘ওয়ালাদ’ (শিশু, বত্স, সন্তান। ‘তিফল’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে তিনবার। এর বহুবচন ‘আতফাল’ আছে একবার। ‘ছবিয়্য’ শব্দটি কোরআনে আছে দুবার। ‘গুলাম’ শব্দটি আছে ১২ বার। এর দ্বিবচন ‘গুলামান’ কর্মকারকরূপে ‘গুলামাঈন’ আছে একবার (১৮: ৮২। বহুবচনে ‘গিলমান’ আছে একবার। ‘ওয়ালাদ’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে ৩৩ বার। এর বহুবচন ‘আওলাদ’ শব্দটি রয়েছে ২২ বার।
শুধু মাদ্রাসা কেন পারিবারিকভাবেও অনেক শিশু নির্যাতনের শিকার। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, এক থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৮৯ শতাংশ সমীক্ষা চলাকালীন আগের এক মাসে অন্তত একবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। (প্রথম আলো) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ‘শিশু পরিস্থিতি রিপোর্ট মতে, ২০২০ সালে একহাজার ৫২১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে মেয়ে শিশু ১০৮৮ আর ছেলে শিশুর সংখ্যা ৪৩৩। নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬২৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৬১৬ এবং ছেলে শিশুর ১০টি। নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৪ শিশু। মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে আমরা যতটা না সোচ্চার অন্য ক্ষেত্রে আমরা ঠিক ততোটাই নীরব। শিশু নির্যাতন যেখানেই হোক তা নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অবিলম্বে তা বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হোক।
শিশুর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা মহানবী (সা.) পছন্দ করতেন না। তিনি শিশুর সঙ্গে স্নেহশীল আচরণ না করায় এক পিতাকে ভর্ত্সনা করেন। প্রহার ও বকাঝকার পরিবর্তে উত্তম আচরণ ও উপদেশের মাধ্যমে শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেও এই নীতি অনুসরণ করতেন। হজরত আনাস (রা.) তাঁর শৈশবের দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর সেবায় কাটিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হলো, “আমার কোনো কাজে আপত্তি করে তিনি কখনো বলেননি ‘এমন কেন করলে বা এমন কেন করলে না।’” (মুসলিম, হাদিস : ২৩০৯)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত হাসান (রা.)কে চুমু দিলেন, তখন সেখানে আকরা ইবনে হাবিস (রা.) উপস্থিত ছিলেন। এ দেখে তিনি বললেন, আমার ১০টি সন্তান আছে, আমি কখনো তাদের চুমু দিইনি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না। (বুখারি ও মুসলিম, রিয়াদুস সালিহীন, পৃষ্ঠা: ১২০) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার উম্মত না।’ (আবুদাউদ ও তিরমিজি)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল