নারী দিবস ও ইসলামে নারী
#মো. আবু রায়হান
আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে দিবসটি পালিত হতে লাগল।
এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয়। অথচ বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ‘সভ্য পৃথিবীর’ও ১৪৫০ বছর আগে মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে নারীর অধিকার ও প্রাপ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি তো পাচ্ছেই সেই সঙ্গে নারীরা অধিকারও হারা।ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত নেই বলেই আজ তারা বৈষম্য ও নিগ্রহের শিকার।
রাসুলুল্লাহ (সা) এর আগমনের আগে আইয়ামে জাহেলী যুগে যেখানে কন্যাশিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দিতো, নারীদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হতো, দাসী হিসেবে হাট-বাজারে পশুর মতো বিক্রি করা হতো, কন্যাসন্তানের জন্মের সংবাদে পিতা মানহানিকর মনে করে বিমর্ষ হতো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে ) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত। (সূরা নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)। আল্লাহর রাসুলের আগমনে সেখানে নারী জাতি পেল মর্যাদা ও অধিকার। আল কোরআনে ‘নিসা’ অর্থাৎ ‘মহিলা’ শব্দটি ৫৭ বার এবং ‘ইমরাআহ’ অর্থাৎ ‘নারী’ শব্দটির ২৬ বার উল্লেখ হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘নিসা’ তথা ‘মহিলা’ শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্যসংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র বৃহৎ সূরাও রয়েছে। এছাড়া পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বহু বিখ্যাত নারীর উল্লেখ রয়েছে, তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে সেরা ছিলেন। যেমন: আদি মাতা হাওয়া (আ.), আদম কন্যা আকলিমা, ইব্রাহিম (আ.)-এর পত্নী সারা, ইসমাইল (আ.)-এর মাতা হাজেরা, মিসরপতির স্ত্রী জুলায়খা, সুলাইমানের পত্নী সাবার রানি বিলকিস, ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া, আইয়ুব (আ.)-এর স্ত্রী বিবি রহিমা, ইমরানের স্ত্রী হান্না, ঈসা (আ.)-এর মাতা বিবি মরিয়ম, নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতা আমেনা ও দুধমাতা হালিমা সাদিয়া; উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা.), হাফসা (রা.), আয়িশা (রা.), মারিয়া (রা.)সহ নবী পত্নীগণ; নবীনন্দিনী রুকাইয়া, জয়নব, কুলসুম ও ফাতিমা (রা.); আবু বকরের কন্যা আসমা, শহিদা সুমাইয়া ও নবীজির দুধবোন সায়েমা প্রমুখ।কোরআনে আছে, ‘তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’
মা হিসেবে নারী -
ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’।মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা, মায়ের আনুগত্য করা, মায়ের প্রতি ইহসান করা ফরয করেছে। মায়ের সন্তুষ্টিকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি হিসেবে গণ্য করেছে।
মায়ের অবাধ্য হওয়া, মাকে রাগান্বিত করা— হারাম; এমনকি সেটা যদি শুধু উফ্ উফ্ শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমে হয় তবুও। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর আপনার রব আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে ও মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। আর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”(সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)
কন্যা হিসেবে নারী-
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মেয়েশিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক।’ হাদিস শরিফে আরও আছে, ‘যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যাসন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যাসন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়।মেয়ে সন্তান প্রতিপালনের জন্য মহা প্রতিদান ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হচ্ছে- “যে ব্যক্তি বালেগ হওয়া পর্যন্ত দুইজন মেয়েকে লালন-পালন করবেন সে ও আমি কিয়ামতের দিন এভাবে আসব (তিনি আঙ্গুলসমূহকে একত্রিত করে দেখালেন)”।সহিহ মুসলিম -২৩১)
স্ত্রী হিসেবে নারী-
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক।’ (মুসলিম শরিফ)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে–ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯)। কোরআনে আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত ২২৮)।হাকিম ইবনে মুয়াবিয়া (রা.) তার পিতা মুয়াবিয়া (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম হে আল্লাহর রাসূল, স্বামীর উপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে? তিনি বললেন, তার অধিকার হলো যখন তুমি খাবে তখন তাকেও খাওয়াবে, তুমি যখন যে মানের কাপড় পড়বে তাকেও সে মানের কাপড় পড়াবে। তার মুখে আঘাত করবে না। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করবে না, গৃহ ব্যতীত অন্য কোথাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে না। (আবু দাউদ)
ইসলাম নারীকে বোন হিসেবে, ফুফু হিসেবে ও খালা হিসেবেও সম্মানিত করেছেন।মোটকথা, ইসলাম নারীর মর্যাদা সমুন্নত করেছে। অনেক বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীকে সমান অধিকার দিয়েছে। পুরুষের ন্যায় নারীও ঈমান আনা ও আল্লাহ্র আনুগত্য করার জন্য আদিষ্ট। আখিরাতে প্রতিদান পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারী পুরুষের সমান। নারীর রয়েছে- কথা বলার অধিকার: নারী সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে ও আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে। নারীর রয়েছে মালিকানার অধিকার: নারী ক্রয়-বিক্রয় করবে, পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হবে, দান-সদকা করবে, কাউকে উপঢৌকন দিবে। নারীর অনুমতি ছাড়া কারো জন্য তার সম্পদ গ্রহণ করা জায়েয নয়। নারীর রয়েছে সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার। নারীর উপর অন্যায়, অত্যাচার করা যাবে না। নারীর রয়েছে জ্ঞানার্জনের অধিকার। বরং নারী তার দ্বীন পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা ফরয।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন