ব্যক্তি বন্দনা ও ইসলাম



ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজ হবে ব্যক্তিত্ববান মানুষ দ্বারা ভরপুর আলোকিত একটি সমাজ। যে সমাজে থাকবে না কোনো শঠতা, মোসাহেবি , তেলবাজি বা বাড়াবাড়িমূলক স্বভাব; যাতে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য ও প্রতারণার দ্বার উন্মুক্ত হয়। মুসলিম সমাজে মানুষের চরিত্র হবে অত্যন্ত খোলামেলা, হৃদ্যতাপূর্ণ ও সুস্পষ্ট। তাদের কথা ও কাজের মধ্যে থাকবে না কোনো অমিল। আর না তারা একে অন্যের তোষামোদি বা তেলবাজি করে যে যার যার সুবিধা লুফে নিবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে আমোদের মুসলিম সমাজ এমনই এক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত যে, তা আজ এক তোষামোদের সমাজে পরিণত হয়েছে। কেউ সুবিধা আদায়ের জন্য, কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অথবা অসুবিধায় পড়ে একে অন্যের অযাচিত প্রশংসায় লিপ্ত হয়। এক দিকে চলে পেছনে পেছনে চরম পরচর্চা অন্য দিকে চলে মুখোমুখি অতি প্রশংসা।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, ‘বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যায় অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য— তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’ তিনি আরও বলেন— ‘যে তৈল দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও প্রফেসর হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভ রাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।...........‘যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’পরচর্চার পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যক্তি প্রশংসা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, অধিকার এবং মানুষের ব্যক্তিত্বকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে। ফলে ইসলামে এ উভয় প্রকার বাড়াবাড়িমূলক কাজকেই অতি নিন্দনীয় ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।কুরআনুল কারিমে এসেছে-‘তুমি মনে করো না- তারা শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে, যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আনন্দিত হয় এবং না করা বিষয়ের জন্য প্রশংসিত হতে ভালোবাসে। এরূপ কখনও মনে করো না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা আল ইমরান : আয়াত ১৮৮)সুতরাং কারো প্রশংসা, খোশামোদ, তোষামোদ করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত না করাই ইসলামের বিধান। কেননা অতিরক্তি প্রশংসা ও তোষামোদের দ্বিমুখী ক্ষতি রয়েছে। যে ব্যক্তি প্রশংসা করে আর যার প্রশংসা করা হয়, উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি প্রশংসা-স্তুতির বিষয়ে প্রথম মূলনীতি হলো, ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।’আকিদাগত দিক থেকেও সকল প্রকার প্রশংসা করা হবে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। যাকে বলা হয় ‘হামদ’। আর ব্যক্তি চরিত্রের প্রশংসা করা করা হবে আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূল (আ: )গণের, যাকে বলা হয় ‘নাত’। এতদ্ব্যতীত মুসলিম মাত্রই অন্যের প্রশংসা বিষয়ে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে যে, তিনি কী করতে যাচ্ছেন! সাধারণত উদ্দেশ্য হাসিলকে সামনে রেখে কোনো ব্যক্তির প্রশংসা বা তোষামোদে প্রবৃত্ত হওয়া জায়েজ নয়। ইসলাম এ কাজকে অতি গর্হিত ও নীতিবিবর্জিত স্বভাব হিসেবে দেখে থাকে। কেননা তা সম্পূর্ণরূপে ‘আলহামদুলিল্লাহ’র খিলাফ। এ ছাড়া সার্বিক দিক বিবেচনায় বিষয়টি শিষ্টাচারবিরোধী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের আওতাভুক্ত।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন,
সাহেব কহেন, ”চমৎকার ! সে চমৎকার !”
মোসাহেব বলে, ”চমৎকার ! সে হতেই হবে যে !
হুজুরের মতে অমত কার ?”
হাদিস শরিফে দেখা যায়, যখনই কেউ সামনে উপস্থিত ব্যক্তির প্রশংসা করত, রাসূলুল্লাহ (সা:) স্বয়ং তাতে বাধা দিতেন এবং তার বিরোধিতা করে বক্তব্য পেশ করতেন। অনুরূপভাবে সাহাবিদের সামনেও কেউ প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করলে তাঁরা তা ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন এবং সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করতেন।
ইসলামে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রেরিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর চারিত্রিক প্রশংসাও করতে হয় বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে। যেমন নামাজে ও নামাজের বাইরে তাঁর প্রতি দোয়া-দরুদ পাঠ করার বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে; যা রাসূলুল্লাহ (সা:) স্বয়ং নিজে উম্মাহকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজের ব্যাপারেও সাহাবিদেরকে অতিরিক্ত প্রশংসায় প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে আমার সাহাবিরা, তোমরা তোমাদের নবীর ব্যাপারে এমন কোনো প্রশংসায় প্রবৃত্ত হবে না, যেমন করেছিল তোমাদের পূর্ববর্তীরা। তারা (খ্রিষ্টানরা) তাদের নবীর প্রশংসা করতে করতে তাঁকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। অথচ তিনি (ঈসা আ:) ছিলেন আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।’ একজন নবীর প্রতি এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে যে, উম্মতরা তাকে প্রভু বানিয়ে ফেলে! অতএব নবী-রাসূলগণের প্রশংসার ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হয়, যাতে কোনো প্রকার অতিশয়োক্তি বা বাড়াবাড়ি করা না হয়।হজরত আবু মূসা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সা:এক ব্যক্তিকে আরেক ব্যক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তো তাকে হত্যা করে ফেললে, অথবা তার পিঠ কেটে ফেললে।’। (আদাবুল মুফরাদ)।হজরত আবু বাকর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একবার এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর সামনে অন্যের প্রশংসা করল। তখন নবী করিম (সা.) বললেন, তোমার অকল্যাণ হোক। তুমি তো তোমার ভ্রাতাকে হত্যা করলে। এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন। তারপর বললেন, যদি তোমাদের কেউ কারও প্রশংসা করতেই হয় সে যেন এরূপ বলে যে, আমি অমুক ব্যক্তি সম্পর্কে এরূপ ধারণা রাখি, তবে প্রকৃত অবস্থা আল্লাহতায়ালা অবগত। আর তা তখন বলবে যখন প্রকৃতই তুমি বিশ্বাস করবে যে, ওই ব্যক্তি এরূপই। আর কারও পবিত্রতা বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর বাড়াবাড়ি করবে না (বুখারি ও মুসলিম)।
হজরত আবু মা’মার বলেন, এক ব্যক্তি জনৈক আমিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার প্রশংসা করছিল। হজরত মিকদাদ তার মুখের ওপর বালু ছুড়ে মারেন এবং বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে প্রশংসাকারীর মুখে বালু নিক্ষেপ করতে আদেশ করেছেন।’ (আদাবুল মুফরাদ)।অপর এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আলী (রা:)-এর যখন প্রশংসা করা হতো তখন তিনি এই দোয়া করতে করতে ওই স্থান ত্যাগ করতেন যে, ‘হে আল্লাহ, আমি আমাকে অন্যের চেয়ে ভালো চিনি, আরো ভালো চেনো তুমি। অতএব তারা আমার ব্যাপারে যা ভাবে, আমাকে তার চেয়েও উত্তম করে দাও এবং আমার সব পাপ ক্ষমা করে দাও, যা আমি অসতর্কাবস্থায় করে ফেলেছি।’ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তির যদি প্রশংসা করতে হয়, তা হলে এতটুকুন বলা যায় যে, তিনি একজন ভালো লোক। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর অনেক সাহাবির ব্যাপারে অনুরূপ বলেছেন। যেমন, হজরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে ভালো লোক আবু বকর, ভালো লোক উমর, ভালো লোক আবু উবাইদাহ, ভালো লোক উসআদ ইবনে উযাইর, ভালো লোক সাবিত ইবনু কায়স, ভালো লোক আমর ইবনুল জামুহ ও ভালো লোক মুআজ ইবনু জাবাল!’ (আদাবুল মুফরাদ)। সুতরাং এটিই হচ্ছে ব্যক্তি প্রশংসার একমাত্র সঠিক রীতি, যা রাসূল সা: থেকে প্রকাশ পেয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল