আমরা মুসাফির





আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাঁধ ধরে বললেন, “এ দুনিয়াতে তুমি (এমনভাবে) থাকো, যেন তুমি একজন অপরিচিত বা একজন মুসাফির।”
ইবনে ‘উমার (রাঃ) বলতেন, “যদি তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকো, তবে সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা করো না। যদি তুমি সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকো, তবে সন্ধ্যার প্রত্যাশা করো না। সুস্থ থাকা অবস্থায় তুমি অসুস্থতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো, আর বেঁচে থাকা অবস্থায় নিজেকে প্রস্তুত করো মৃত্যুর জন্য।”
(সাহিহ বুখারি – কিতাবুর রিকাক, হাদিস ৬৪১৬)
হযরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) একটি উদাহরণ দিয়েছেন। একটি জাহাজ কোথাও যাচ্ছে। জাহাজের যাত্রীরা সবাই মুসাফির। পথিমধ্যে একটি দ্বীপের দেখা পেলে জাহাজের ক্যাপ্টেন দ্বীপে জাহাজটিকে নোঙ্গর করে, যাতে সফরের জন্য প্রয়োজনীয় রসদসামগ্রী ও জ্বালানী নেয়া যায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন ঘোষণা করে, আমরা কয়েক ঘণ্টা এখানে যাত্রাবিরতি করব, যাত্রীদের কেউ চাইলে জাহাজ থেকে নেমে ঘুরেফিরে আসতে পারেন। ঘোষণার পর যাত্রীরা সবাই জাহাজ থেকে নেমে পড়ে এবং দ্বীপটিকে দেখার জন্য ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দ্বীপটি ছিল দেখতে খুব সুন্দর, নানা রকম প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর। যাত্রীরা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এদিকে জাহাজের রওনা দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসল। যাত্রীদের মধ্যে অনেকে ভাবল, জাহাজ ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে, এবার ফিরে যাই। তারা জাহাজে ফিরে আসল এবং জাহাজের ভালো আসনগুলো দখল করে আরাম করে বসল। যাত্রীদের কেউ কেউ ভাবল, দ্বীপটি এত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর, আমরা আরো কিছুক্ষণ থাকি। কিছুক্ষণ ঘুরাফিরার পর তারা ভাবল, জাহাজ না আবার ছেড়ে দেয়। তারা তড়িঘড়ি করে জাহাজে ফিরে আসল। এসে দেখল, জাহাজের ভালো আসনগুলো দখল হয়ে গেছে। বসার খারাপ এবং বাজে স্থানগুলো আছে। তারা সেখানেই বসে পড়ল আর মনে মনে ভাবল, যাক জাহাজে তো উঠেছি।
যাত্রীদের কয়েকজন তখনও দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ও মোহিত হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। তারা মনে মনে ভাবছিল, কি চমৎকার, এখানে তো অনেক ভালো লাগছে, জাহাজে সময়টা একদম বাজে কাঁটছিল। তারা দ্বীপের সৌন্দর্য দর্শনে এতটা মগ্ন হয়ে পড়ল যে, জাহাজে ফেরার কথা ভুলে গেল। জাহাজ ছেড়ে দিল আর তারা দ্বীপেই রয়ে গেল। দিনের বেলা দ্বীপে তাদের ভালোই কাটল। কিন্তু যখন সন্ধ্যা হল এবং ধীরে ধীরে রাত অন্ধকার হলো তখন সেই নিঝুম দ্বীপে তাদের ভয় ভয় করতে লাগল। রাত যত গভীর হচ্ছিল ভয়ের মাত্রা তত বাড়ছিল। দূরের জঙ্গলে বিভিন্ন হিংস্র জন্তুর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ভয়ে তাদের এরূপ অবস্থা দাঁড়াল যে, এক মুহূর্ত সেই দ্বীপে অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ল। বলুন, যেসব যাত্রী দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দ্বীপে রয়ে গিয়েছিল তারা কত বড় বেকুব ও নির্বোধ।
আলোচ্য উদাহরণ উল্লেখ করার পর ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, দুনিয়া হলো সেই দ্বীপটির মতো। সুতরাং এ দুনিয়াতে মন লাগানো এবং এর রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া সেরূপ, জাহাজের যাত্রীরা যেরূপ দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল এবং যাদেরকে দুনিয়ার লোকেরা নির্বোধ ও বেকুব বলেছে। দুনিয়ার প্রতি আসক্ত লোকেরাও তেমনি নির্বোধ ও বেকুব।
রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “দুনিয়ার সাথে আমার কি ? দুনিয়া আর আমার সম্পর্ক হল (এমন যে), আমি তো কেবল একজন আরোহীর মতোই, যে কিনা একটি গাছের ছায়ার নিচে বসে, এরপর সে তা ছেড়ে চলে যায়।” (তিরমিযি – হাদিস ২৩৭৭, ইবনে মাজাহ – হাদিস ৪১০৯, মুসনাদে আহমাদ – হাদিস ১/৩৯১)
মুসলিম শরিফের এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হযরত মাসতুর ইবনে শাদ্দাদ (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর শপথ! পরকালের তুলনায় দুনিয়ার উপমা শুধু এতটুকুই যেমন তোমাদের মাঝে কেউ নিজের একটি অঙ্গুলি সমুদ্রের পানিতে চুবিয়ে তুলে নিল। অতঃপর দেখ তাতে কতটুকু পানি লেগে এসেছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল