ব্যক্তি বন্দনা থেকে শিরকের সূচনা
ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ। শিরককারীকে বলা হয় মুশরিক। তাওবা ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে শিরককারীর ক্ষমা নেই।সে অনন্তকাল জাহান্নামের আজাব ভোগ করবে। শিরক ছাড়া অন্য গুনাহ আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্য যত পাপ-তাপ আছে, তা যাকে ইচ্ছা (বিনা শাস্তিতেই) ক্ষমা করে দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করে, সে মহা অপরাধে অপরাধী হয়ে যায়।’ (সুরা নিসা, আয়াত -৪৮) শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ / পাপ হওয়ার কারণ হলো, এটি মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই আল্লাহ কিছুতেই এই অপরাধ সহ্য করেন না। এ পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল এসেছেন, তাঁদের প্রধান কাজ ছিল শিরক উত্খাত করে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করা।
সর্বপ্রথম হজরত নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায় পৃথিবীতে শিরক শুরু করে।এর আগের সম্প্রদায়গুলো আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। সর্বক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন ছিল। এই পার্থিবজগতে শিরকের কোনো নাম-নিশানা ছিল না। নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ে পাঁচজন বড় আলেম ছিলেন; যাঁরা সর্বক্ষণ মহান বিধাতার ইবাদতে মগ্ন থাকতেন, মানুষকে দ্বীনের প্রতি আহ্বান করতেন। সেই পাঁচ ব্যক্তির নাম—ওয়াদ্দ, সুআ, ইয়াগুজ, ইয়াউক ও নছর। এই নেক বান্দারা নিজেরাও এক আল্লাহর ইবাদত করতেন এবং মানুষদেরও একত্ববাদের শিক্ষা দিতেন।একসময় তাঁরা একের পর এক মৃত্যুবরণ করেন। এতে সাধারণ লোকজন কষ্ট পায় এবং বলে, হায় আফসোস! যাঁরা আমাদের ইবাদতের কথা বলতেন, বিভিন্ন আমলের কথা বলতেন, আল্লাহর বিধান মেনে চলার কথা বলতেন, তাঁরা আমাদের ছেড়ে সবাই চলে গেলেন। আমরা তো এতিম হয়ে গেলাম। এ জগতে তো দ্বীন প্রচারের আর কোনো আগত নতুন বুজুর্গ দেখছি না।এ অবস্থায় শয়তান তাদের কুমন্ত্রণা দেয় যে তোমরা পাথর ও কংক্রিট দ্বারা তাঁদের মূর্তি বানিয়ে নাও এবং উপাসনালয়ে সেগুলো প্রতিস্থাপন করে নাও। সেগুলো দেখলে তোমাদের ঈমান তাজা হবে। আনন্দচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করতে মন চাইবে। জনগণ শয়তানের এই প্ররোচনাকে ভালো পরামর্শ মনে করল এবং তাঁদের প্রতিকৃতি অনুসরণে তাঁদের মূর্তি বানিয়ে ফেলল, যাতে সেগুলোকে দেখে ইবাদত ও নেক কাজ করতে পারে। বাস্তবতাও ছিল এমন যে যখন ওই সময়ের লোকজন এ মূর্তিগুলো দেখত তখন তারা আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হয়ে যেত। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হতে থাকে। একপর্যায়ে যারা মূর্তি প্রতিস্থাপন করেছে; কিন্তু উপাসনা করেনি তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। তাদের পর তাদের পরবর্তী প্রজন্মের যুগ আসে। তারা তাদের পিতা-মাতাকে এই মূর্তিগুলোর প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শন করতে দেখে। এরপর আরো পরবর্তী প্রজন্মের যুগ আসে। এভাবে একের পর এক যুগ শেষ হতে থাকে। তারপর শয়তান তাদের বলে, তোমাদের বাপ-দাদারা এসব মূর্তিরই পূজা করত। যখন তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত কিংবা তারা কোনো বিপদের সম্মুখীন হতো তখন তারা সঙ্গে সঙ্গে এই মূর্তিগুলোর শরণাপন্ন হতো। সুতরাং তোমরাও এগুলোর পূজা-অর্চনা করো, দেখবে তোমাদেরও সব বিপদাপদ দূর হয়ে যাবে। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এসব লোক একপর্যায়ে মূর্তির পূজা-অর্চনা শুরু করে দিল এবং আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতার সাগরে ডুবে গেল।এ অবস্থায় আল্লাহ তাআলা হজরত নূহ (আ.)-কে তাদের কাছে পাঠান, হজরত নূহ (আ.) কয়েক শতাব্দী তাদের দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিছুসংখ্যক লোক তাঁর কথায় ঈমান আনে। বেশির ভাগই তাঁর কথা শোনেনি। শেষ পর্যন্ত কাফিরদের ওপর আল্লাহ তাআলার গজব অবতীর্ণ হয় এবং তুফান দ্বারা তাদের ধ্বংস করে দেওয়া। তারা খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা (আ.) প্রশংসা করতে করতে তাঁকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।’ একজন নবীর প্রতি এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে যে, উম্মতরা তাকে প্রভু বানিয়ে ফেলে! অতএব নবী-রাসূলগণের প্রশংসার ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হয়, যাতে কোনো প্রকার অতিশয়োক্তি বা বাড়াবাড়ি করা না হয়।কুরআনে এসেছে, ইহুদিরা বলে, উজাইর আল্লাহর পুত্র, আর খ্রিস্টানরা বলে, (ঈসা) মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এ সবই তাদের মুখের (বানানো) কথা। তাদের আগে যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল, তাদের মতোই এরা কথা বলছে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! এরা বিভ্রান্ত হয়ে কোন দিকে যাচ্ছে? (সুরা তাওবা, আয়াত - ৩০)ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আদিতে একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল; কিন্তু তাদের ধর্মবিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি ঢুকে পড়েছিল। আলোচ্য আয়াতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দ্বারা একত্ববাদ কিভাবে বিকৃত হয়েছে এবং তারা কিভাবে একত্ববাদের শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়েছে, তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন