সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মাতৃভাষা চর্চায় ইসলাম








#মো. আবু রায়হান
মা মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি মানুষের অতি আবেগের তিনটি অনুসঙ্গ। ভাষা সদা প্রবাহমান ও পরিবর্তনশীল। সেহিসেবে ভাষা বৈচিত্র মহান আল্লাহর অনুপম নিদর্শন। বর্তমানে ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে ছয় থেকে সাত হাজার ভাষা রয়েছে। শুধু এশিয়ায় প্রচলন আছে দুই হাজার ২০০ ভাষার। অবশ্য অধিকাংশ ভাষায়ই খুব অল্প সংখ্যক লোক কথা বলে। দশ লক্ষ বা ততোধিক লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা প্রায় ২০০। আবার পাঁচ কোটি বা ততোধিক লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা মাত্র ২৩টি। তবে দশ কোটি বা ততোধিক লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা মাত্র বারোটি। লোক সংখ্যা বিচারে এই বারোটি ভাষা হচ্ছে (১) মান্ডারিন চীনা (২) ইংরেজি (৩) স্পেনীয় (৪) হিন্দি (৫) আরবি (৬) বাংলা (৭) রুশ (৮) পুর্তগীজ (৯) জাপানী (১০) জার্মান (১১) মালয়-ইন্দোনেশীয় ও (১২) ফরাসী। প্রথমে বহু ভাষা গড়ে উঠলেও বিভিন্ন কার্যকারণে ও প্রক্রিয়ায় বর্তমানে মাত্র স্বল্পসংখ্যক ভাষায়ই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কথা বলে।
পবিত্র কোরআনে কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। ’ (সূরা রুম, আয়াত - ২২) বর্ণিত এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও মহান আল্লাহ পাকের নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। তাই এ ভাষার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনসহ যত্নশীল হওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়ার নির্দেশনায় শামিল।আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘রহমান, তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী রয়েছে।’ (সূরা আর রাহমান ,আয়াত - ১-৫)।মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বাণীতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মানুষ সৃষ্টির পর মানুষের মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি ও তার মাধ্যম ভাষা আল্লাহই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং ভাষা আল্লাহর দান। আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের মতো ভাষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত।
মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, আমি রাসূলগণকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (দ্বীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। (সূরা ইবরাহিম আয়াত- ৪)কোরআনে মাজিদের এ আয়াত থেকে ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনের পথে দাওয়াত দানকারীদের জন্য মাতৃভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের নির্দেশনাও পাওয়া যায়।প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। ’ রাসূলের এ বাণী থেকে প্রমানিত হয়; বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ।আল্লাহ তাআলা মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। তাঁদের ধর্ম প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত বা মহা সত্যের প্রতি আহ্বান। আর এর জন্য ভাষার কোনো বিকল্প ছিল না। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা-১৪ ইবরাহিম আয়াত-৪)।আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘রাসুলরা মাতৃভাষাভাষী হওয়ার কারণ হচ্ছে, যেন তাঁদের জাতি রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং তাঁরা কী নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা বুঝতে পারেন।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৪৭৭)
রাসুল গণ শুধু মাতৃভাষায় ধর্ম প্রচার করেননি; বরং তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ ভাষায় পাণ্ডিত্যের অধিকারী। সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী। রাসুল (সা.) বলেন, আমি আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষী। একইভাবে পবিত্র কোরআনে মুসা (আ.)-এর ভাষ্যে হারুন (আ.)-এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী, তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত - ৩৪)
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবেসো; যেহেতু আমি আরবি ভাষায় কথা বলি, কোরআন আরবি ভাষায় লেখা এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ (বুখারি)। কিন্তু আরবি পরকালের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সব নবী-রাসুল আরবি ভাষাভাষী ছিলেন না; এমনকি সব আসমানি কিতাবও আরবি ভাষায় লেখা হয়নি। আমরা জানি, তাওরাত কিতাব ইবরানী বা হিব্রু ভাষায় হযরত মুসা (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়; যাবুর কিতাব ইউনানী বা আরামাইক  ভাষায় হযরত দাউদ (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়; ইঞ্জিল কিতাব সুরিয়ানি  ভাষায় হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়; এবং সর্বশেষ আসমানি কিতাব কোরআন আরবি ভাষায় সর্বশেষ নবী ও রাসুল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল করা হয়।জ্ঞান অর্জন ও দাওয়াতি কার্যক্রমের জন্য বিদেশি ভাষা শিখতেও আপত্তি নেই। এ বিষয়টিকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি। রাসুল (সা.) হযরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের ‘ইবরানি’ ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে তা আত্মস্থ ও কণ্ঠস্থ করে ফেলেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...