নবি রাসুলদের পেশা
আদম (আ.) ছিলেন একজন কৃষক। তিনি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর ছেলেদের পেশাও ছিল চাষাবাদ। তা ছাড়া তিনি তাঁতের কাজও করতেন। কারো কারো মতে, তাঁর পুত্র হাবিল পশু পালন করতেন। কৃষিকাজের যন্ত্রপাতির নাম আল্লাহ তাআলা তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহর বাণী, ‘আর আল্লাহ আদমকে সব নামের জ্ঞান দান করেছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩১)
২। শিস (আ.)
শিস (আ.)ও কৃষক ছিলেন। তাঁর পৌত্র মাহলাইল সর্বপ্রথম গাছ কেটে জ্বালানি কাজে ব্যবহার করেন। তিনি শহর, নগর ও বড় বড় কিল্লা তৈরি করেছেন। তিনি বাবেল শহর প্রতিষ্ঠা করেছেন। (ইবনে কাসির)
৩। ইদরিস (আ.)-
ইদরিস (আ.)-এর পেশা ছিল কাপড় সেলাই করা। কাপড় সেলাই করে যে অর্থ উপার্জন করতেন, তা দিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইদরিস শব্দটি দিরাসা শব্দ থেকে নির্গত। তিনি বেশি পরিমাণে সহিফা পাঠ করতেন বলে তাঁকে ইদরিস বলা হয়। পড়াশোনার প্রথা তাঁর সময় থেকে চালু হয়। একদল পণ্ডিত মনে করেন, হিকমত ও জ্যোতির্বিদ্যার জন্ম ইদরিস (আ.)-এর সময়ই হয়েছিল।
৪।নুহ (আ.)
নুহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নৌকা তৈরির কলাকৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তিনি নৌকা তৈরি করেছিলেন। আল্লাহর বাণী—‘আর তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহি অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করো।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৭) তিনি ৩০০ হাত দীর্ঘ, ৫০ হাত প্রস্থ, ৩০ হাত উচ্চতাসম্পন্ন একটি বিশাল নৌকা তৈরি করেন।
৫। হুদ (আ.)
হুদ (আ.)-এর জীবনী পাঠান্তে জানা যায় যে তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। ব্যবসা ও পশু পালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
৬। সালেহ (আ.)-
সালেহ (আ.)-এর পেশাও ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
৭। লুত (আ.)
লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। এতে প্রতীয়মান হয় যে তিনিও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন চাষাবাদের মাধ্যমে।
৮। ইবরাহিম (আ.)
ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনী পাঠান্তে জানা যায় যে তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কখনো ব্যবসা, আবার কখনো পশু পালন করতেন।
৯। ইসমাইল (আ.)
ইসমাইল (আ.) পশু শিকার করতেন। তিনি ও তাঁর পিতা উভয়ই ছিলেন রাজমিস্ত্রি। পিতা-পুত্র মিলে আল্লাহর ঘর তৈরি করেছিলেন।
১০। ইয়াকুব (আ.)-
ইয়াকুব (আ.)-এর পেশা ছিল ব্যবসা, কৃষিকাজ করা ও পশু পালন।
১১। ইউসুফ (আ.)
ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেতন হিসেবে রাষ্ট্রীয় অর্থ গ্রহণ করতেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১০১)
১২।শোয়াইব (আ.)
শোয়াইব (আ.)-এর পেশা ছিল পশু পালন ও দুধ বিক্রি। পশু পালন ও দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর কন্যারা চারণভূমিতে পশু চরাতেন।
১৩। দাউদ (আ.)
দাউদ (আ.) ছিলেন রাজা ও নবী। সহিহ বুখারির ব্যবসা অধ্যায়ে রয়েছে যে দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন, হে আল্লাহ! এমন একটি উপায় আমার জন্য বের করে দিন, যেন আমি নিজ হাতে উপার্জন করতে পারি। অতঃপর তাঁর দোয়া কবুল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে লোহা দ্বারা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করার কৌশল শিক্ষা দেন। শক্ত ও কঠিন লোহা স্পর্শ করলে তা নরম হয়ে যেত। যুদ্ধাস্ত্র, লৌহ বর্ম ও দেহবস্ত্র প্রস্তুত করা ছিল তাঁর পেশা। এগুলো বিক্রি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
১৪। সোলায়মান (আ.)
সোলায়মান (আ.) ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর শাসক ও নবী। তিনি তাঁর পিতা থেকে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তিনি নিজেও অঢেল সম্পদের মালিক ছিলেন। ভিন্ন পেশা গ্রহণ করার চেয়ে নিজ সম্পদ রক্ষা ও তদারকি করাই ছিল তাঁর প্রদান দায়িত্ব। মানব-দানব, পশু-পাখি, বাতাস ইত্যাদির ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। তাঁর সাথি ঈসা ইবনে বরখিয়া চোখের পলক ফেলার আগে বিলকিসের সিংহাসন সোলায়মান (আ.)-এর সামনে এনে হাজির করেন।
১৫। মুসা (আ.)
মুসা (আ.) ছিলেন একজন রাখাল। তিনি শ্বশুরালয়ে মাদায়েনে পশু চরাতেন। সিনাই পর্বতের পাদদেশে বিরাট চারণভূমি মাদায়েনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। লোকজন সেখানে পশু চরাত। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মুসা (আ.)। আট বছর তিনি স্বীয় শ্বশুর শোয়াইব (আ.)-এর পশু চরিয়েছেন।
১৬। হারুন (আ.)
হারুন (আ.)-এর পেশাও ছিল পশু পালন। পশু পালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
১৭। ইলিয়াস (আ.)
ইলিয়াস (আ.)-এর পেশাও ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
১৮। আইউব (আ.)
আইউব (আ.)-এর পেশা ছিল গবাদি পশু পালন। তাঁর প্রথম পরীক্ষাটি ছিল গবাদি পশুর ওপর। ডাকাতরা তাঁর পশুগুলো লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। (আনওয়ারে আম্বিয়া, ই. ফা. বাংলাদেশ)
১৯। ইউনুস (আ.)
ইউনুস (আ.)-এর গোত্রের পেশা ছিল চাষাবাদ। সুতরাং কারো কারো মতে, তাঁর পেশাও ছিল চাষাবাদ।
২০। জাকারিয়া (আ.)
জাকারিয়া (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে মহানবী (সা.) বলেছেন, জাকারিয়া (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তাই তাঁর শত্রুরা তাঁর করাত দিয়েই তাঁকে দ্বিখণ্ডিত করে। (সহিহ বুখারি)
২১। ইয়াহইয়া (আ.)
ইয়াহইয়া (আ.) প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে তিনি জীবনের একটি সময় জঙ্গলে ও জনহীন স্থানে কাটিয়েছিলেন। আহার হিসেবে তিনি বৃক্ষের লতাপাতা ভক্ষণ করতেন। (আনওয়ারে আম্বিয়া)
২২। জুলকিফল (আ.)
জুলকিফল (আ.)-এর পেশা ছিল পশু পালন।
২৩। ইয়াসা (আ.)
ইয়াসা (আ.)-এর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
২৪। ঈসা (আ.)
ঈসা (আ.) ও মরিয়ম (আ.)-এর আবাসস্থল প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তাদের উভয়কে এক উচ্চ ভূমি প্রদান করেছিলাম, যা সুজলা ও বাসযোগ্য ছিল।’ (সুরা : আল মুমিনুন, আয়াত : ৫০)এই উচ্চ ভূমি হলো ফিলিস্তিন। তিনি ফিলিস্তিনে উৎপন্ন ফলমূল খেয়ে বড় হয়েছেন। তিনি ঘুরে ঘুরে অলিতে-গলিতে দ্বিনের দাওয়াতি কাজ করতেন। যেখানে রাত হতো, সেখানে খেয়ে না খেয়ে নিদ্রা যেতেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না।
২৫। রাসুল (সা.)
রাসুলুল্লাহ্ (সা.) শিশুকাল কাটিয়েছিলেন পবিত্র নগরী মক্কায়। কোরাইশের শীতকালে ইয়েমেন ও গ্রীষ্মে সিরিয়া ভ্রমণ ছিল দুটি অপরিহার্য বাণিজ্যিক ভ্রমণ। সর্দার হাশিম ইবনে আবদে মানাফ কোরাইশের ধনী-দরিদ্র সকলের মাঝে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সৃষ্টি করার আহ্বান জানান। ঠিক এই সময় এসে পড়ে ইসলামের বাণী। এছাড়াও কোরাইশের আকাশে ছিল তখন ধনাঢ্যতা ও শৌর্য-বীর্যের ফকফকা রোদ। এমন খাঁটি বাণিজ্যিক পরিবেশেই বেড়ে উঠেন মহানবী (সা.)। ১২ বছর বয়সে রাসুলুল্লাহ (সা.) চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার পথে একটি বাণিজ্যিক কাফেলায় অংশগ্রহণ করেন। পথিমধ্যে ‘বুহাইরা’ নামক এক খৃস্টান পাদ্রীর সাথে দেখা হলে তিনি শিশু মুহাম্মদকে ইহুদিদের থেকে সাবধানে রাখার পরামর্শ দেন। তাই আবু তালিব দ্রুত তাকে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন।যৌবনে উপনীত হবার পর মেষ চরানো এবং পরে ব্যবসার মাধ্যমে শুরু হয় মহানবীর (সা.) অর্থনৈতিক জীবন। তাঁর ব্যবসায়িক সুনাম ও ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার কারণে খাদিজা (রাজিআল্লাহু তায়ালা আনহা) তাকে প্রথমত ব্যবসা ও দ্বিতীয়ত স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সততা ছাড়াও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে বুদ্ধিমত্তা, দৈহিক শক্তি ও বিচক্ষণতা ইত্যাদি গুণের সমাবেশ ঘটেছিল।মহানবী (সা.) ছিলেন একজন সফল ও সৎ ব্যবসায়ী। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে।’ (আদ্দুররুল মানসুর, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২০) তিনি গৃহের কাজ নিজ হাতে করতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন। নিজের জুতা ও কাপড় সেলাই ও ধোলাই করতেন, গৃহ ঝাড়ু দিতেন। মসজিদে নববী নির্মাণকালে শ্রমিকের মতো কাজ করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘বর্শার ছায়ার নিচে আমার রিজিক নির্ধারণ করা হয়েছে—তথা গণিমতের মাল হলো আমার রিজিক।’ (কুরতুবি, ১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন