সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হিলফুল ফুজুল পৃথিবীর প্রথম শান্তি সংঘ


#মো আবু রায়হান

মহানবী (সা.)-এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে 'হিলফুল ফুজুল' প্রতিষ্ঠা। 'হিলফুল ফুজুল' অর্থ শান্তিসংঘ। নবুয়তপ্রাপ্তির ১৫ বছর আগে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি আরব সমাজের সব অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে তাঁর সমবয়সী কিছু যুবককে নিয়ে এ শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মহানবী (সা.) এমন একটি সময় আরব ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন আরব সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করছিল। এ সমাজে ছিল না কোনো নিয়মনীতি ও আইনের শাসন। গোত্রীয় কলহ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, সামাজিক শ্রেণিভেদ, নারী নির্যাতন, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া প্রভৃতি সমাজকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছিল। ঐতিহাসিকরা আরবের এই সময়কে 'আইয়ামে জাহেলিয়া' বা 'অন্ধকার যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। জাহেলিয়া যুগের এই রক্তপাত, অন্যায় ও অনাচার বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি সমাজের সব অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার জন্য সর্বদা চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবশেষে তাঁর মনে একটি অভিনব চিন্তার উদয় হলো। তিনি তাঁর সমবয়সী কতিপয় যুবককে নিয়ে 'হিলফুল ফুজুল' নামে একটি সংঘ গড়ে তুললেন। এ সংগঠন সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল।আরব সমাজের সব অন্যায় প্রতিরোধের লক্ষ্যে হিলফুল ফুজুল গঠিত হলেও সম্ভবত ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ওকাজ মেলার (মক্কার ওকাজ নামক স্থানে প্রতিবছর এই মেলা বসত) ঘোড়দৌড়, জুয়াখেলা ও কাব্য প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে পবিত্র জিলকদ মাসে মক্কার কোরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। মহানবী (সা.)-এর বয়স তখন ১৪ থেকে ১৫। আরবে পবিত্র জিলকদ মাস ছিল শান্তির মাস। এই মাসে আরবদেশে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই জিলকদ মাসে শুরু হওয়া এই যুদ্ধকে ‘হরবুল ফুজ্জার’ বা অন্যায় সমর বলা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর স্থায়ী এউ যুদ্ধের ভয়াবহতা বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর কোমল হৃদয়ে রেখাপাত করে। এই যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এই যুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন মহানবী (সা.)-এর বয়স ছিল ২০ বছর। মহানবী (সা.) তাঁর চাচার সঙ্গে এই যুদ্ধে হাজির হয়েছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দ্বিতীয় খণ্ড)দীর্ঘ পাঁচ বছর স্থায়ী এ যুদ্ধের ভয়াবহতা বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর কোমল মনকে মারাত্মকভাবে ব্যথিত করে তোলে। এ যুদ্ধে অনেক লোক প্রাণ হারিয়েছিল। যদিও তিনি অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি; কিন্তু এই যুদ্ধের বীভৎসলীলা দেখে বালক মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং আরববাসীদের এরূপ ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে ভাবতে থাকেন। আরবে শান্তি বজায় রাখার জন্য তিনি একটি শান্তিসংঘ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সমমনা নিঃস্বার্থ কিছু উৎসাহী যুবক ও চাচা জুবাইরকে নিয়ে তিনি এ শান্তিসংঘ গঠন করেন। এ সংঘের চারজন বিশিষ্ট সদস্য ফজল, ফাজেল, ফজায়েল ও মোফাজ্জেলের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল 'হিলফুল ফুজুল'।

এ সংঘের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ –

ক. সামাজিক ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
খ. যুদ্ধ বন্ধ করে সম্প্রীতি গড়ার চেষ্টা করা।
গ. অন্যায় ও অবিচার থেকে মানুষকে রক্ষা করা।
ঘ. নিঃস্ব, বিধবা ও অভাবীদের পাশে দাঁড়ানো।
ঙ. বিদেশি বণিকদের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া।
চ. সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।
ছ. সর্বোপরি গোত্র, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণে কাজ করাই ছিল এ সংগঠনের উদ্দেশ্য।
এই শান্তিসংঘ প্রায় ৫০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এভাবে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুল বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কল্যাণী সেবাসংঘের মর্যাদা লাভ করে। আর এর মধ্য দিয়ে মহানবী (সা.) নবী হওয়ার আগেই শান্তির অগ্রদূত হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...