হিজরতের পটভূমি ও বিশ্বইতিহাসে প্রভাব




#মো. আবু রায়হান
ইসলামের ইতিহাসে হিজরত যুগান্তকারী ঘটনা। বৈশ্বিক ইতিহাসেও হিজরত সর্বাধিক তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা। ‘যোসেফ হেল’ যথার্থই বলেছেন, ‘Hijrat is the Greatest Turning Point in the History of Islam’অর্থাৎ হিজরত ইসলামের মোড় পরিবর্তনকারী মহান ঘটনা।ইসলামের ইতিহাসে বৃহৎ দিগন্তের উন্মোচন করে। এটি দ্বীন ও মানবতার বৃহত্তম স্বার্থে ত্যাগ, বিসর্জনের এক সাহসী পদক্ষেপ।

হিজরত
হিজরত' শব্দটি হিজরান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হিজরত শব্দের আভিধানিক অর্থ ছেড়ে দেওয়া, বর্জন করা। অর্থাৎ অসন্তুষ্টিচিত্তে কোনো কিছু ত্যাগ করা। to depart, to shift, abandonment, to give up one’s own land, to migrate from one place to another place সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচলিত অর্থে দেশ ত্যাগ করাকে হিজরত বলা হয়। শরিয়তের পরিভাষায় দারুল কুফর তথা কাফিরদের দেশ ত্যাগ করে দারুল ইসলাম তথা মুসলমানদের দেশে গমন করার নাম হিজরত (রুহুল মা'আনি)। মোল্লা আলী কারি (রহ.) মিশকাত শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিরকাতে বলেন, ধর্মীয় কারণে কোনো দেশ ত্যাগ করাও হিজরতের অন্তর্ভুক্ত। “Leaving home and place for the sake of God is and settling in other place is called Hijrat” উল্লেখ্য, যারা বাণিজ্যিক উন্নতি কিংবা চাকরির সুযোগ-সুবিধা লাভের নিয়তে দেশান্তরিত হয়েছে, তারা শরিয়তের দৃষ্টিতে মুহাজির বলে গণ্য হবে না।প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষকে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র যেতে হয়। এটাই মানুষের চিরাচরিত রীতি। মক্কার জীবনে দীর্ঘ ১৩ বছর ধৈর্য ধারণ করার পর মহানবী (সা.) যখন দেখলেন, কাফিররা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন তিনি শান্তির আশায় হেফাজত করার লক্ষ্যে সাহাবাদের হাবশায় হিজরতের অনুমতি দিলেন। ৬১৫ সালে মুহাম্মাদ (সা.) এর নির্দেশে হযরত ওসমান বিন আফফান ও তার স্ত্রী রোকাইয়াসহ মোট ১৫ জন ( ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী ) মুসলমান আবসিনিয়ায় গমণ করেন।এটাই ইসলামের প্রথম হিজরত। তাঁদের অনেকে মক্কায় পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার খবর শুনে ফেরত এসেছিলেন। পরে যখন দেখা গেল, খবরটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট, তখন নবুয়তের সপ্তম বছর জাফর (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৮৬ জন পুরুষ ও ১৭ জন নারী সাহাবা দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরত। পরে তাঁরা সপ্তম হিজরিতে সেখান থেকে মদিনায় হাজির হয়েছিলেন।ইসলামের সবচেয়ে আলোচিত হিজরত হলো, মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত। হিজরত বলতে ৬২২ সালের ২১ জুন হতে ২ জুলাইয়ের মধ্যে নবী মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের মক্কা থেকে মদীনায় গমন করাকে বোঝানো হয়। এ হিজরতের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ঐতিহাসিক আকাবা নামক স্থানের শপথের মাধ্যমে। ৬২০ সালে আকাবার প্রথম শপথে মদিনার ৬ জন , ৬২১ সালে আকাবার দ্বিতীয় শপথে ১২ জন ইসলাম ও মহানবী (সা.)-কে সাহায্য করার শপথ নেন। আর ৬২২ সালে আকাবার তৃতীয় শপথে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী মহানবী (সা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁরা মক্কার মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। মহানবী (সা.) সাহাবাদের মহররম মাস থেকে মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দিলেন। মদিনায় সর্বপ্রথম হিজরত করেছেন মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)।

হিজরতের পটভূমি / কারণ

মক্কার কাফিররা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সামাজিকভাবে বয়কট করাসহ সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন করে ইসলামের আওয়াজ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। অঙ্কুরেই ইসলাম নামের বৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। হাতে গোনা যে কয়জন সাহাবি ইমান এনেছিলেন, তাঁরা কেউই কাফিরদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রেহাই পাননি। কোনো কোনো সাহাবি দৈহিকভাবে এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যে ইতিহাসে এর নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনো ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিয়ে কখনো বা প্রচণ্ড উত্তপ্ত মরুভূমির পাথর-বালিতে টানাহেঁচড়া করে সাহাবিদের তারা অতিষ্ঠ করে তোলে। নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা দিন দিন চরম থেকে চরমতর হচ্ছিল। দৈহিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন খোদ মহানবী (সা.)। একপর্যায়ে মক্কার কাফিররা এই মহামানবকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুনভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে।জাতীয় সমস্যাবলি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও শলাপরামর্শ করার জন্য 'দারুন নদওয়া' নামে মক্কার কাফিরদের একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিল। সেখানে প্রত্যেক গোত্রের প্রধান ব্যক্তিরা জমায়েত হতো। শীর্ষস্থানীয় কাফিররা তাদের 'দারুন নদওয়া' বা 'মন্ত্রণাগৃহে' ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কর্মকৌশল ঠিক করতে পরামর্শসভার আয়োজন করে। কেউ কেউ পরামর্শ দিল : 'মুহাম্মদ (সা.)-কে শৃঙ্খলিত করে কোনো ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা উচিত।' কিন্তু অন্যরা মত প্রকাশ করল যে মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী-সাথিরা হয়তো আমাদের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং এর ফলে আমাদের পরাজয়ও ঘটতে পারে। তাই ওই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করা হলো। কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিল : 'তাঁকে নির্বাসিত করা উচিত।' কিন্তু তিনি যেখানে যাবেন, সেখানেই তাঁর অনুগামী বাড়তে থাকবে এবং তাঁর আন্দোলনও যথারীতি সামনে অগ্রসর হবে- এ আশঙ্কায় ওই পরামর্শও নাকচ করা হলো। অবশেষে আবু জাহেল পরামর্শ দিল : 'প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে যুবক মনোনীত করা হবে; তারা সবাই একসঙ্গে রাসুল (সা.)-এর ওপর হামলা করবে এবং তাঁকে হত্যা করে ফেলবে। এর ফলে তাঁর রক্তপণ সব গোত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর সবার সঙ্গে একাকী লড়াই করা হাশিমি গোত্রের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না।' এ অভিমতটি সবাই পছন্দ করল এবং শেষ পর্যন্ত এ কাজের জন্য একটি রাতও নির্দিষ্ট করা হলো।রাতেই আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে এই চক্রান্তের কথা তার রাসূলকে জানিয়ে দিলেন। আল্লাহ বলেন, (তরজমা) ‘(হে নবী!) আপনি ঐ সময়টি স্মরণ করুন, যখন কাফিররা চক্রান্ত আঁটছিল যে, তারা আপনাকে বন্দী করবে, অথবা হত্যা করবে কিংবা করবে দেশান্তর। তারা তাদের ষড়যন্ত্র করছিল আর আল্লাহ আপন কৌশল করছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী।–(সূরা আনফাল আয়াত- ৩০) আল্লাহ নবীজীকে নির্দেশ দিলেন, রাতে স্বীয় গৃহে শয়ন না করে তাঁর স্থানে হযরত আলী রা.কে রাখতে। এভাবে নবীজীর অপেক্ষার প্রহর শেষ হল, জিবরীল আ. হিজরতের নির্দেশ সম্বলিত আসমানী বার্তা নিয়ে এলেন। আয়াত নাযিল হল, (তরজমা) ‘আর (হে নবী) আপনি বলুন, হে আমার রব! আমাকে প্রবেশ করান কল্যাণের সাথে এবং আমাকে বের করান কল্যাণের সাথে। আর আমাকে আপনার পক্ষ হতে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি।’(সূরা বনী ইসরাইল আয়াত- ৮০)

হিজরতের ঘটনা

হিজরতের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাড়িতে আপন চাচাতো ভাই আলী (রা.)-কে নিজ বিছানায় রেখে যান। কিছুটা রাত্রি হয়ে আসলে চল্লিশ জন ঘাতক নবীর গৃহকে ঘিরে ফেলল। তারা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর সব কিছু স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্য করে ভাবল- শয্যায় যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে রয়েছেন তিনিই স্বয়ং নবী। এই ফাঁকে কাফিরদের চোখে ধূলো দিয়ে মহানবী (সা.) ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি তখন সূরা ইয়াসীনের নিন্মোক্ত আয়াতসমূহ পড়ছিলেন-“ইয়াসীন! জ্ঞানের ভান্ডার কুরআনের কসম, নিশ্চয়ই তুমি রাসূল। তুমি সঠিক পথের ওপর আছ। এ কুরআন মহাপরাক্রান্ত করুনাময়ের নাযিল করা, যাতে তুমি এমন একটি জাতিকে সাবধান করে দিতে পার যাদের পূর্বপুরুষদের সাবধান করা হয়নি। পলে তারা অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। তাদের অধিকাংশ লোকই আল্লাহর আযাবের যোগ্য তাই তারা ঈমান আনছে না। আমি তাদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দিয়েছি। সেই বেড়িতে তাদের থুতনি পর্যন্ত শ্রংখলিত হয়ে গেছে। এ জন্য তারা মাথা উঁচু করে রয়েছে। আমি তাদের সামনে একটি প্রাচীর এবং পেছনে আরেকটি প্রাচীর দাঁড় করিয়ে তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি। তাই তারা দেখতে পায় না।” এই আয়াত কয়টি পড়তে পড়তে তিনি তাদের প্রত্যেকের মাথায় ধূলি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর নিজের ইচ্ছামত একদিক চলে গেলেন। ভোর হওয়ার পর অবরোধকারী মুশরিকরা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে রাসূলের কক্ষে প্রবেশ করল। তখন হযরত আলী (রা.) গা থেকে চাদর সরিয়ে তাদের প্রশ্ন করলেন, “তোমরা কি চাও?” তারা বলল, “মুহাম্মদকে চাই। তিনি কোথায়?”আলী (রা.) বললেন, “তোমরা কি তাঁকে আমার কাছে আমানত রেখে গিয়েছিলে যে, আমার কাছে তাঁর অবস্থান জিজ্ঞাসা করছ? তিনি এখন ঘরে নেই।”এ কথা শুনে তাদের চেহারা ক্ষোভে লাল হয়ে গেল এবং ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করায় চরমভাবে অনুতপ্ত হলো। পূর্ব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে তারা রাসূলকে ধরতে নতুন পরিকল্পনা নিল। তারা মদীনা যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দিল এবং এসব পথে প্রহরী নিয়োগ করল। পায়ের চি‎‎হ্ন দেখে অবস্থান শনাক্ত করতে পারদর্শী ব্যক্তিদের ডেকে আনা হলো। যে ব্যক্তি মহানবীর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারবে তার জন্য একশ’ উট পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। এদিকে আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)-এর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। যাতে তিনি তাঁর সঙ্গে হিজরত করতে পারেন। আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে মহানবী (সা.) মদিনার পথে রওনা হন। রওনা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজি বললেন, হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার প্রতিপালকের কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, আমি কখনো বের হতাম না।সাহাবাদের হিজরতের দুই মাস পর মহানবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার হিজরত করেন। হিজরতের সময় মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর ও তাঁর গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা ও পথনির্দেশক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত দুয়ালিও ছিলেন। তিনি বাইয়াতে আকাবার তিন মাস পর ২৭ সফর বৃহস্পতিবার রওনা দেন। জাবালে সাওর বা গারে সাওর। এই সাওর পর্বতের একটি গুহায় হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আত্মগোপন করেছিলেন। সাওর পাহাড়টি মক্কার দক্ষিণে কুদাই মহল্লার অন্তগত বর্তমানে পরিকল্পিত আল হিজরা এলাকায় অবস্থিত। তিন দিন সাওর নামক পর্বতে গোপন থাকার পর সোমবার পহেলা রবিউল আউয়াল আবার রওনা দেন। সাওর পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে গুহায় ছিলাম, আমি মুশরিকদের পদচারণা প্রত্যক্ষ করছিলাম, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের কেউ যদি পা উঠায় তাহলেই আমাদের দেখে ফেলবে, তিনি বললেন, আমাদের দু’জন সম্পকে তোমার কী ধারণা? আমাদের তৃতীয় জন হলেন- আল্লাহ। অর্থাৎ তিনি আমাদের সাহায্যকারী। ’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম।১২ রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি কুবা নগরীতে পৌঁছেন। ১৪ দিন অবস্থান করার পর তিনি সেখানে মসজিদে কুবা প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর তিনি মদিনায় গমন করেন। (ইব্ন কাছির, আল বিদায়া, খণ্ড-৩, পৃ. ১৮৮) রাসূল (সা.) মদীনার নিকটবর্তী ‘সানিয়াতুল বিদা’ নামক স্থানে পৌঁছলে শিশু-কিশোর ও যুবকরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে এল। শিশুরা নবীজির উদ্দেশে গান গেয়ে মদীনার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল। তারা যে গানটি গেয়েছিল তা ছিল এ রকম-
তালা'আল বাদরু 'আলাইনা, মিন সানিয়াতিল-ওয়াদা'
ওয়াযাশ শুকরু 'আলাইনা, মা দা'আ লিল্লাহি দা'

ফলাফল/ প্রভাব

হিজরতের ফলেই হযরত ওমর রা. এর শাসনামলে যখন মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র পঞ্জিকা প্রণয়নের কথা উঠে আসে তখন তাঁরা সর্বসম্মতভবে হিজরত থেকেই এই পঞ্জিকার গণনা শুরু করেন। যার ফলে চান্দ্রমাসের এই পঞ্জিকাকে বলা হয় ‘হিজরী সন’। The Hegira from which dates the Mohammedan Calendar .( Syed Ameer Ali ,A Short History of the Saracens p.10)মুমিন মুসলমানের জীবনে হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষের প্রভাব ব্যাপক। এ সনের গুরুত্বও অত্যধিক। বিশেষ করে মুসলমানের জন্য ঈমানের অন্যতম রোকন ও ইবাদত রোজা, ঈদ, হজ ও কুরবানি ও জাকাত- এ হিজরি তারিখের উপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বছরের তারিখ ও ক্ষণ গণনা করেই এ ইবাদতের সময় নির্ধারণ করতে হয়।শুধু তা-ই নয়, কোনো নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে কিংবা কেউ তালাকপ্রাপ্ত হলে চাঁদের সময় হিসাব করেই তাদের ইদ্দত পালন করতে হয়। সন্তান-সন্তুতির জন্ম ও দুধ পানের হিসাবও চন্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী ধরতে হয়।ইসলামের জন্য রাসূল (সা.) এবং প্রাথমিক যুগের সকল সাহাবাদের অনন্য ত্যাগ ও জীবন-সংগ্রামের নগদ ফলাফল হিজরতের মাধ্যমে লাভ হয়।হিজরত-পরবর্তী সময়েই রাসূল (সা.) এর প্রশিক্ষনের ভিত্তিতে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।মদীনার নাম ইয়াসরিব থেকে মদীনাতুন নবী নামকরণ করা হয়।হিজরতের মাধ্যমেই ইসলামের ইতিহাসে নিগ্রহের যুগ শেষ হয়ে সমৃদ্ধির যুগের সূচনা হয়।হিজরত মানুষকে আশান্বিত করে যে, শত কষ্ট ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানুষের জন্য আশার এক আলো রয়েছে।মদীনায় মুহাজির ও আনসারদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সকল মুসলমানকে ভিন্ন প্রেক্ষাপট থাকা স্বত্ত্বেও এক কালিমার ছায়াতলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে শিক্ষা প্রদান করে।হিজরতের মাধ্যমেই ইসলাম পৃথিবীর বুকে একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ, অসাম্য ও অন্যায় হতে মানবতাকে মুক্ত করার সংগ্রামের সূচনা হয়। হিজরতের পর মদিনাকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাজধানী করা হয়। এতে মদিনার মর্যাদা ও গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বিভিন্ন গোত্র নিজেদের স্বার্থ ভুলে গিয়ে ইসলামের খাতিরে এক জাতিতে পরিণত হয়। ‘সবাই ভাই-ভাই’ এ ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি বৃহৎ মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল— যার কাছে পরবর্তীকালে পরাক্রমশালী রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।বিশ্ব ইতিহাসেও সবচেয়ে তাৎপর্যবহ, গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা হল এই হিজরতের ঘটনা।The Hijrat, with which Makkah period ended and the Madinese period began, began a tourning point in the life of Muhammad ( P.K Hitti , History of the Arabs,p.116)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল