ওহুদ যুদ্ধ ও মুসলমানদের অগ্নিপরীক্ষা
#মো. আবু রায়হান
ওহুদ যুদ্ধ ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩ মার্চ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) ওহুদ পর্বতের সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়।মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই দুই পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে হযরত মুহাম্মদ (সা) ও আবু সুফিয়ান। ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত প্রধান যুদ্ধসমূহের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। এর পূর্বে ৬২৪ সালে এই দুইপক্ষের মধ্যে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
যুদ্ধের পটভূমি-
বদরের যুদ্ধে মক্কাবাসীগণের পরাজয় ও অপমানের যে গ্লানি এবং তাদের সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় লোকদের হত্যার যে দুঃখভার বহন করতে হয়েছিল তারই কারণে তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধীভূত হচ্ছিল। এমনকি তারা তাদের নিহতদের জন্যে শোক প্রকাশ করতেও নিষেধ করে দিয়েছিল এবং বন্দীদের মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতেও নিষেধ করেছিল, যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখ যাতনার কাঠিন্য সম্পর্কে ধারণা করতে না পারে। অধিকন্তু তারা বদর যুদ্ধের পর এ বিষয়ে সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল যে, মুসলিমগণের সঙ্গে এক ভীষণ যুদ্ধ করে নিজেদের কলিজা ঠান্ডা করবে এবং নিজেদের ক্রোধ ও প্রতিহিংসার প্রক্ষোভ প্রশমিত করবে। এ প্রেক্ষিতে কালবিলম্ব না করে যুদ্ধের জন্য তারা সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণও শুরু করে দেয়। এ কাজে কুরাইশ নেতৃবর্গের মধ্যে ইকরামা ইবনু আবু জাহল, সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া, আবু সুফিয়ান ইবনু হারব এবং আব্দুল্লাহ ইবনু রাবীআহ খুব বেশী উদ্যোগী ও অগ্রগামী ছিল। তারা এ ব্যাপারে প্রথম যে কাজটি করে তা হচ্ছে, আবু সুফিয়ানের যে কাফেলা বদর যুদ্ধের কারণ হয়েছিল এবং যেটাকে আবু সুফিয়ান বাঁচিয়ে বের করে নিয়ে যেতে সফলকাম হয়েছিল, তার সমস্ত ধনমাল সামরিক খাতে ব্যয় করার জন্যে আটক করে রাখা। ঐ মালের মালিকদের সম্বোধন করে তারা বলেছিল, ‘হে কুরাইশের লোকেরা, মুহাম্মাদ (সা) তোমাদের ভীষণ ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের বিশিষ্ট নেতাদের হত্যা করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে যু্দ্ধ করার জন্যে এ মালের মাধ্যমে সাহায্য কর। সম্ভবত আমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারব।’ কুরাইশরা তাদের এ কথা সমর্থন করে। সুতরাং সমস্ত মাল, যার পরিমাণ ছিল এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তা সবই বিক্রয় করে দেয়া হয়।
ওহুদ প্রান্তর-
ওহুদ মদিনা থেকে তিন মাইল উত্তরে একটি পাহাড়ের নাম। ওহুদ উপত্যকা প্রান্তর একটি স্থান। ইহুদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পৃথক, একক। যেহেতু উহুদ পাহাড় অন্যান্য পাহাড় থেকে পৃথক তাই এটিকে উহুদ নামে নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে উহুদে পার্শ্বে, উহুদের শহীদগণের কবর রয়েছে। সেখানে হযরত হারুন (আ.) এর কবর রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, হযরত মুসা ও হারুন (আ.) হজ বা উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কায় সফর করেন। আসার সময় ওহুদের কাছে এসে হযরত হারুন (আ.) অসুস্থ হয়ে যান। এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। তার দাফনও সেখানে সম্পন্ন হয়। নবী করীম (সা.) কোনো অভিযান শেষ করে ফিরে আসার সময় ওহুদের পাহাড় দেখে বলতেন, ‘ওই পাহাড়টা আমাদের ভালোবাসে আমরাও তাকে ভালোবাসি।’ (সহীহ বোখারী)।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
ঘরে ঘরে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। কিনানা ও তিহামা গোত্রের লোকেরা একেবারে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। হাবশিরা বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, তাঁদের তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। তাই ওয়াহশি নামের এক হাবশি ক্রীতদাসকে মুসলমানদের হত্যার বদলে মুক্তির প্রলোভন দেওয়া হয়। ৬২৫ সালের ১১ মার্চ ৩,০০০ সৈনিক নিয়ে গঠিত মক্কার বাহিনী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মদিনার দিকে যাত্রা করে। এই বাহিনীর সাথে ৩,০০০ উট ও ২০০টি ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাসহ মক্কার ১৫জন নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে।তাদের কাজ ছিল গানে গানে যোদ্ধাদের মনোবল চাঙা রাখা।তারা সরাসরি মদিনা আক্রমণ না করে শহরের নিকটে আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে কিছুটা ডানে উহুদের নিকটবর্তী আয়নাইনে শিবির স্থাপন করে।যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মাদ (সা) এর কাছে পৌছায়। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অনেকে নিয়োজিত হয়। যুদ্ধের জন্য গৃহিতব্য পদক্ষেপ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন,আল্লাহর শপথ আমি একটি ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে কতগুলি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আরো দেখি যে আমার তলোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে ঢুকিয়েছি।এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন যে কিছু সাহাবি নিহত হবে, তলোয়ারের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মের অর্থ মদিনা শহর।পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। মুহাম্মাদ (সা) সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা। কারণ মদিনা সুরক্ষিত শহর ছিল এবং প্রতিপক্ষ নিকটবর্তী হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরা ছাদের উপর থেকে ইট পাটকেল ছুড়তে পারত। অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু সাহাবি ভিন্নমত দেন। তাদের দাবি ছিল এভাবে শহরের ভেতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুর মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না।এর ফলে মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল এক হাজার। এর মধ্যে ১০০ জন বর্ম পরিহিত ছিলেন এবং ৫০ জন ছিলেন অশ্বারোহী। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। এগুলো হলো মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির। মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। তারা শাওত নামক স্থানে পৌঁছানোর পর যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানান আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তিনি তাঁর ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করেন। তাদের দল ত্যাগের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী কারণ পাওয়া যায়। যেমন-
(ক) মেজর জেনারেল আকবর খান রচিত তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ডিফেন্স স্ট্রেটেজি ইন ইসলাম’-এ বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের পরিকল্পনা ছিল মুহাম্মদ (সা.)-কে এমন বুঝানো যাতে তিনি ওহুদে যাওয়ার সর্ব সাধারণের ব্যবহৃত পথ অনুসরণ করেন এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার পূর্বেই কাফেরদের ফাঁদে পড়ে সমূলে ধ্বংস হন। মুহাম্মদ (সা.) উবাইয়ের পরিকল্পনা মোতাবেক ওহুদ যাত্রার পথ গ্রহণ করেননি। এ জন্যই উবাই তার অনুসারীদেরসহ মুসলমানদের দল ত্যাগ করে।
(খ) ইতিহাসবিদ ডব্লিউ মন্টোগুমারী ওয়াট তার ‘মুহাম্মদ এট মদিনা’ বইতে উল্লেখ করেন যে, মুহাম্মদ (সা.) ইচ্ছা করেই ইহুদিদের পরিহার করেছিলেন কারণ তারা ছিল অবিশ্বাসী এবং আবদুল্লাহ বিন উবাইর দুষ্কর্মের সহযোগী। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা সমস্যা সৃষ্টি এবং বিশ্বাসঘাতকতা করার সম্ভাবনা ছিল।
(গ) মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শাফি তার ‘তফসিরে মারেফুল কুরআন’-এ বর্ণনা করেন যে, মুহাম্মদ (সা.) আবদুল্লাহ বিন উবাই এবং তার অনুসারীদের পরামর্শ অনুযায়ী মদিনা নগরীতে যুদ্ধ না করার কারণে দলত্যাগ করেছিল। বাকি ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা ওহুদের দিকে যাত্রা করেন। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর তিনটি পতাকা ছিল। প্রধান পতাকাবাহী ছিলেন হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের এবং অপর দুটি আউস ও খাজরাজ বংশের দুই দলপতির হাতে।গিরি গুহায় তিরন্দাজ নিয়োগ-
হযরত হামজাকে পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক এবং মুসাব বিন উমায়েরকে পতাকা বহনকারী হিসেবে পর্বতের পাদদেশে মোতায়েন করেন। মুহাম্মদ (সা.) ধারণা করেন যে, শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনী পার্শ্ব ভাগ দিয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) ইবনে নোমান-এর নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজের একটি দল আইনীন পর্বতের গিরিপথে মোতায়েন করেন এবং তাদেরকে নিম্ন লিখিত নির্দেশ দেন :
(১) আইনীন পর্বতের দিকে অগ্রগামী শত্রুকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা।
(২) শত্রুকে আইনীন পাহাড়ের ঝরনা ব্যবহার করতে না দেয়া।
(৩) যে কোনো পরিস্থিতিতে এই গিরিপথ দখলে রাখা।
তিনি নির্দেশ হিসেবে বলেন,তোমরা আমাদের পিছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে আমরা গনিমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনও তোমরা আমাদের সাথে যোগ দেবে না।
যুদ্ধের বর্ণনা-
মল্লযুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের তলহা আক্রমণে এলে হযরত আলী তাকে বধ করলেন। তলহার ভাই ওসমান আক্রমণ করলে হযরত হামজা তাকে সংহার করলেন। কুরাইশরা তাদের বীরদের পরাজয়ে বিচলিত হয়ে সংঘবদ্ধ আক্রমণ করল। হামজা, আলী, আবু দুজানা, জিয়াদ, জুবায়ের প্রমুখ সাহাবি বীর বিক্রমে যুদ্ধ করলেন। কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনী দুই-দুবার গিরিপথে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। ওহুদে যেন বদরের পুনরাবৃত্তি ঘটল। কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে লাগল। এ সময় মুসলিমগণ গনিমত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হলো। গিরিরক্ষী তিরন্দাজদের ১২ জন বাদে বাকি ৩৮ জন যুদ্ধ শেষ মনে করে স্থান ত্যাগ করে সম্পদ সঞ্চয়ে মত্ত হলো। নবীজির নির্দেশ উপেক্ষা করার মাশুল তাঁদের দিতে হলো। যখন তিরন্দাজরা গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন, তখন অমুসলিম বাহিনী গিরি অতিক্রম করে মুসলমানদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দিল।মুসআব ইবনে উমায়ের ও নবীজির চাচা হামজা শহীদ হলেন।কাফেরদের আক্রমণের তীব্রতা অপ্রস্তুত মুসলমানদের ছিন্নভিন্ন ও বিপর্যস্ত করে দেয়। মুসলমান সৈন্যরা রসুল (সা) থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। মাত্র ১২ জন আনসার এবং একজন মুহাজির তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ রসুলের সঙ্গে ছিলেন। এ যুদ্ধে রসুল (সা) এর দান্দান মুবারক শহীদ হয়। এ মুষ্টিমেয় সাহাবি রাসুল (সা) চারপাশে মানব বর্ম সৃষ্টি করেন। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে একে একে ১২ জন আনসার শাহাদাতবরণ করেন। অতঃপর বীর তালহা তলোয়ার ধারণ করেন। তার শরীরে সত্তরের অধিক আঘাত ছিল এবং তার হাত কাঁধ থেকে ঝুলে পড়েছিল। তিনি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাফের সৈন্যদের পরাজিত করেন। উহুদ প্রান্তরে কোরায়েশরা নির্মমভাবে হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহিদ করেছিল, তাকে আহত করেছিল।অমুসলিমদের আক্রমণে হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) ও নবীজির চাচা হযরত হামজা (রা.) শহীদ হন। হযরত মুসআব ইবনে ওমায়ের (রা.)-এর দেহ অবয়ব নবীজির সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল। হযরত মুসআব ইবনে ওমায়ের (রা.) শহীদ হলে ভুলক্রমে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিহত হয়েছেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, এটা নিছকই গুজব। তবে নবীজি (সা.) আহত হয়েছিলেন। শুধু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করার কারণে নিশ্চিত জয়ী হওয়া যুদ্ধে মুসলমানরা হেরে যান। এই আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবি শাহাদাতবরণ করেন। তাঁদের সমাধি বদর প্রান্তরেই অবস্থিত। যাঁদের মধ্যে অধিক সংখ্যকই ছিলেন আনসার, অর্থাৎ তাঁদের পঁয়ষট্টি জন লোক শহীদ হয়েছিলেন, খাযরাজ গোত্রের একচল্লিশ জন এবং আউস গোত্রের চবিবশ জন।একজন ইহুদী নিহত হয়েছিল এবং মুহাজির শহীদদের সংখ্যা ছিল মাত্র চারজন। কুরাইশদের নিহতদের সংখ্যা নিয়ে কথা ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ছিল বাইশ জন। কিন্তু আসহাবে মাগাযী এবং আহলুসসিয়ার এ যুদ্ধের যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং যাতে যুদ্ধের বিভিন্ন স্থানে নিহত মুশরিকদের যে আলোচনা এসেছে তাতে গভীরভাবে চিন্তা করে হিসাব করলে এ সংখ্যা বাইশ নয়, বরং সাঁইত্রিশ হয়। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী।শুধু আবু সুফিয়ান, জুবায়ের ইবনে মুতএম ও হাকেম ইবনে হিজাম ছাড়া কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই নিহত হলো। তাঁরা তিনজনই পরে মুসলমান হয়েছিলেন।
পরাজয়ের কারণ-
নেতার আদেশ লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলার অভাবই ছিল উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের প্রধান কারণ। বিজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে মুসলিম বাহিনী বিপুল উৎসাহে সামরিক আদেশ রক্ষার পরিবর্তে শত্রুদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কর্তব্যজ্ঞান অপেক্ষা তাদের লুণ্ঠনপ্রীতি প্রবল হয়ে দেখা দেয়। তারা যদি তাদের নিজ নিজ স্থানে দৃঢ় থাকত, তাহলে খালিদ-বিন-ওয়ালিদ পশ্চাৎভাগ হতে মুসলমানদের আক্রমণ করার সুযোগ পেতেন না এবং যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হতো। রণক্ষেত্রে অসময়ের প্রবল বায়ুপ্রবাহ মুসলিম সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট বিপর্যস্ত করেছিল। এ বায়ুপ্রবাহের ফলে বিচ্ছিন্ন মুসলিম বাহিনী শত্রু মিত্র শনাক্ত করে সংঘবদ্ধ হতে পারেনি।মহাবীর খালিদের রণদক্ষতা ও চাতুর্য শত্রুপক্ষের বিজয়কে সম্ভব করেছিল। মুসলিম সেনাদল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ত্যাগ করে লুটতরাজে ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ-বিন ওয়ালিদ তাদের ওপর মরণপণ আক্রমণ চালান। ফলে মুসলিম সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে।
শিক্ষণীয়-
আল কোরআনে যে কয়টি যুদ্ধের আলোচনা হয়েছে তার মাঝে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে উহুদের যুদ্ধ নিয়ে। সেখানে তোলে ধরা হয়েছে উহুদের শিক্ষণীয় অনেক দিক।ওহুদ যুদ্ধে যে সমস্ত শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের ১২১ নং আয়াত থেকে শুরু করে ১৬০ নং আয়াতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে মুসলমানদেরকে রসূলের কথা অমান্য করা, মতভেদ করা এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। যাতে তারা ভবিষ্যতে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে সমস্ত বিষয় তাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে তা থেকে বিরত থাকে।নিম্নে কিছু দিকে নিয়ে আলোচনা করা হলো-
এক. সবকিছুর ভরসা এক আল্লাহ: উহুদের যদ্ধে নবী করীম(সা.) যখন দেখলেন, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা কবিতা দিয়ে কাফেরদের মাঝে উম্মাদনা সৃষ্টি করছে তখন নবী করীম(সা.) এই দোয়া পড়েন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছ থেকেই শক্তি সঞ্চয় করি, তোমার নামেই যুদ্ধ পরিচালনা করি এবং তোমার দ্বীনের জন্যই লড়াই করি। আমার জন্য আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট-তিনি উত্তম অভিভাবক।’ এই দোয়ার প্রতিটি শব্দ আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে বান্দার সম্পর্ককে নিবিড় করে।
দুই. অমুসলিমদের জন্য বদদোয়া না করা: উহুদের যুদ্ধে আহত হয়ে নবী করীম (সা.) বলেন, ওরা কেমন নিজেদের মাঝে প্রেরীত নবীকে আঘাত করে। তখন কোরআনের আয়াত নাজিল হয়। যাতে বলা হয়েছে, তাদের তওবা কবুল করা বা তাদেরকে শাস্তি দেয়া আল্লাহর ইচ্ছায়। এখানে আপনার কোনো দখল নেই।
তিন. দায়িত্বশীলের নির্দেশ মান্য করার গুরুত্ব: উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের বাহ্যিক কারণ মনে করা হয় তীরান্দাজ বাহিনী নিজেদের স্থান ত্যাগ করা। অথচ তাদের বলা হয়েছিলো কোনো অবস্থাতেই ওই স্থান ত্যাগ করা যাবে না। এর দ্বারা আমীর বা নেতৃত্বে নির্দেশ মানার গুরুত্ব বুঝে আসে। সকল বিষয়ের প্রকৃত গুরুত্ব আমীর বা নেতার উপলব্ধিতেই থাকে। তাই অন্যদের দৃষ্টিতে ভিন্ন কিছু মনে হলেও সকলের উচিত নেতার নির্দেশকেই একবাক্যে মেনে নেয়া।
চার. প্রশিক্ষণের গুরুত্ব: রাসূল (সা.) আমাদের মতোই মানুষ। আর মানুষ মাত্রই মরনশীল। তাই তিনি যেকোনো মুহূর্তে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম, যারা নিজেদের জীবনের চেয়ে তাকে ভালোবাসতেন হঠাৎ তিনি বিদায় নিলে তারা সহ্য করতে পারবেন না। তাই তাদের উপলব্ধিকে জাগ্রত করার জন্য রাসূল (সা.) এর মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা হলো। যেন তাদের উপলব্ধিতে থাকে যে তিনি মৃত্যুবরণ করতে পারেন। তাছাড়া আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল, দুনিয়ার প্রতি লোভের ক্ষতি ইত্যাদিও ওহুদের যুদ্ধ থেকে শেখা যায়।
ওহুদের যুদ্ধের পর মুমিনদের প্রশিক্ষণের জন্যে আল্লাহ বাণী পাঠান-তার একাংশে বলা হয়; - ‘মন ভাংগা হয়ো না, চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ো না। তোমারই বিজয়ী থাকবে যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হও। এখন যদি তোমাদের উপর কোন আঘাত এসে থাকে, ইতি পূর্বে অন্য দলের উপরও অনুরূপ আঘাত এসেছে। এটা তো কালের পরিবর্তন যা আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি।এটা এজন্য এসেছে যে আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে কারা খাঁটি মুমিন এবং তোমাদের মধ্যে থেকে কিছু শহীদ তিনি গ্রহণ করতে চান। যালিমদেরকে আল্লাহ মোটেই পছন্দ করেন না। এই পরীক্ষার মাধ্যমে খাঁটি মুমিনদেরকে আলাদা করে কাফিরদেরকে ধ্বংস করতে চান। তোমরা কি ভেবেছো যে তোমরা এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি যে তোমাদের মধ্যে এমন কারা আল্লাহর পথে লড়াই করতে প্রস্তুত এবং কারা ছবর অবলম্বন কারী।( সুরা আলে ইমরান,আয়াত - ১৩৯-১৪২)
ফলাফল
প্রথম দিকে মুসলিমরা সুবিধাজনক স্থানে থাকলেও এক পর্যায়ে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কুরাইশদের হাতে চলে যায়। বিশৃখল অবস্থায় পড়ে যাওয়া মুসলিমরা এরপর পর্বতে জমায়েত হতে সক্ষম হয়। কুরাইশরা এরপর আর অগ্রসর হয়নি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ীদের তিনদিন অবস্থানের তৎকালীন রীতি পালন না করে ফিরে যায়। ফলে শেষপর্যায়ে মুসলিমদের তুলনামূলক বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও কুরাইশদের সুবিধাজনক অবস্থান সত্ত্বেও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন