জালিমের কারাগারে আলেম ওলামা
#মো. আবু রায়হান
পৃথিবীতে বহু ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ইসলামের সেবা করে ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা(রহ.) ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি ইসলামের জ্ঞান ভান্ডারে যে অবদান রেখে গেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ তার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।ইমাম আজমের পূর্ব পুরুষরা আদিতে কাবুলের অধিবাসী হলেও ব্যবসায়িক সূত্রে তারা কুফাতে নিবাস গড়েন। তার পিতা সাবিত ছিলেন একজন তাবেয়ি। প্রসিদ্ধ মতানুসারে তিনি ৬৯৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ৮০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম ছিল নোমান। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আবু হানিফা উপনামে সুখ্যাতি লাভ করেন। ইসলামী ফিকহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত চারটি সুন্নি মাযহাবের একটি “হানাফি মাযহাব”-এর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। ৭৬৩ আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার নিজস্ব কারণ ছিল, আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।প্রতিদিন তাকে কারাগার থেকে বের করে প্রকাশ্যে দশটি করে চাবুক মারা হতো। চাবুকের আঘাতে তার শরীর থেকে রক্ত বের হতো। সে রক্তে কুফার মাটি রঞ্জিত হতো। পানাহারের কষ্টসহ বিভিন্নভাবে ৭০ বছর বয়সের বৃদ্ধ ইমামকে নির্যাতন করা হয়। অবশেষে জোর করে বিষ পান করানো হয়। ৭৬৭ সালের ১৪ জুন মোতাবেক ১৫০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। আবু হানিফার জানাযায় অনেক লোক সমাগম হয়েছিল। ইতিহাসবিদ খাতিবের পক্ষে বলা হয় তার জন্য লোকজন মৃত্যুর ২০ দিন পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিল। পরবর্তীতে, অনেক বছর পর বাগদাদের পাশে আধামিয়াতে আবু হানিফ মসজিদ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় আবু হানিফার নামে।
ইমাম বুখারী পুরো নাম হলো মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ বিন বারদিযবাহ , তার নাম মুহাম্মদ। উপনাম হলো আবু আবদুল্লাহ। আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদীস তার উপাধি। তিনি ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার, ১৯৪ হিজরীতে ৮১০ সালে খোরাসানের বুখারাতে (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম। বুখারা তার জন্মস্থান বলে তাকে বুখারী বলা হয়। একজন বিখ্যাত হাদীসবেত্তা ছিলেন। তিনি "বুখারী শরীফ" নামে একটি হাদীসের সংকলন রচনা করেন, যা মুসলমানদের নিকট হাদীসের সবোর্ত্তম গ্রন্থ বিবেচিত হয়। ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয় নি। বুখারার তৎকালীন আমীরের সাথে তার মতবিরোধ হয়েছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমীর স্বীয় ইমাম বুখারিকে রাজ দরবারে এসে সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য প্রস্তাব করলো। ইমাম বুখারী তার মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেড়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমীরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোকে ইলমে হাদীসের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিষ্কার বললেন,আমীর যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীসের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তার সন্তানদেরকে আমার পাঠ্যস্থান মসজিদে পাঠান । এতে আমীর ইমাম বুখারীর প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং বুখারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য আমীরের নিজস্ব কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমীরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান। বুখারা থেকে বের হওয়ার সময় ইমাম আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেন যে, হে আল্লাহ্! সে আমাকে যেভাবে অপমান করে বের করে দিলো তুমিও তাকে অনুরূপ লাঞ্চিত করো। মাত্র এক মাস পার হওয়ার পূর্বেই খুরাসানের আমীর খালেদ বিন আহমাদের বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাকে ক্ষমতা ছাড়া করলো। পরবর্তীতে বাগদাদের জেলে থাকা অবস্থায় সে মৃত্যু বরণ করে।বুখারী সমরকন্দের খরতঙ্গ জনপদেই ৬২ বছর বয়সে হিজরী ২৫৬ সালের ঈদুল ফিতরের রাত্রিতে বুখারী মৃত্যু বরণ করেন। ঈদের দিন যোহরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর অসীয়ত মোতাবেক তিনটি সাদা কাপড় দিয়ে তাঁকে কাফনে জড়ানো হয়।তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দাফন করার পর তাঁর কবর থেকে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। বেশ কিছু দিন এই অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। লোকেরা তাঁর কবর থেকে মাটি নেওয়া শুরু করে দেয়। অতঃপর বিষয়টি নিয়ে মানুষ ফিতনায় পড়ার আশঙ্কায় প্রাচীর দিয়ে মজবুতভাবে কবরটি ঢেকে দেয়া হয়।
ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বল আবু আবদুল্লাহ আল-শাইবানী (১৬৪-২৪১ হিজরী) ছিলেন একজন বিখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ইসলামি আইন এবং হাদিস বিশারদ। ইসলামের প্রচলিত চার মাযহাবের একটি হাম্বলী মাযহাব তারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গঠিত। মুসলিম বিশ্বে ইমাম আহমদ শাইখুল ইসলাম উপাধিতে পরিচিত।ইমাম আহমদের সংকলিত হাদিসগ্রন্থ মুসনাদকে তার মহতী কীর্তি গণ্য করা হয়।‘কুরআন আল্লাহ তা’আলার বাণী, কোন সৃষ্ট বস্ত্ত নয়।’’ কিন্তু জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের আবির্ভাবে এ বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটানো হয়, শুরু হল ‘‘কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্ত্ত’’ এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রচারণা, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে আববাসীয় খলীফা হারুনুর রশীদ এবং পরবর্তী খলীফা মামুনুর রশীদ প্রভাবিত হলেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা হল সকলকে বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, ‘‘কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্ত্ত’’, এ বিশ্বাসের কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। বাধ্য হয়ে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় প্রায় সকলেই ঐক্যমত পোষণ করলেন শুধুমাত্র দু’জন দ্বিমত পোষণ করেন, ইমাম আহমাদ (রহ.) ও মুহাম্মাদ বিন নূহ (রহ.)। নির্দেশ দেয়া হল তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য। গ্রেফতার করে আনার পথে মুহাম্মদ বিন নূহ (রহ.) ইন্তেকাল করেন, আর ইমাম আহমাদ (রহ.) দু’আ করেছিলেন যেন খলীফা মামুনের সাথে সাক্ষাৎ না হয়। ইমামকে কারাবাস দেয়া হল, প্রায় ২৮ মাস কারাগারে আবদ্ধ হয়ে থাকলেন এবং খলীফা মু‘তাসিম এর নির্দেশে ইমামকে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ না করায় বেত্রাঘাত করা হল। হাত বেঁধে নিষ্ঠুরভাবে কষাঘাত করা হয় । আঘাতে রক্ত ঝড়তে থাকে, গায়ের কাপড় পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে যান, আবার জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে একমত কিনা? একমত না হলে আবার আঘাত শুরু হয়। এভাবে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। এর কারণ শুধু একটিই তিনি কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী এবং বিদ’আতী বিশ্বাস বর্জনকারী। পরিশেষে খলীফা আল মুতাওয়াক্কিল সঠিক বিষয় উপলব্ধি করায় গোটা মুসলিম জাহানে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত অনড় , অটল একক ব্যক্তি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-কে কারামুক্ত করেন এবং তাঁকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেন। ২৪১ হিজরী ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার সকল মাখলুককে ছেড়ে মহান খালিক এর কাছে পাড়ি জমান। ইমাম (রহ.)-এর জানাযায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয় যে, ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়ার্রাক (রহ.) বলেন : জাহেলী যুগে কিংবা ইসলামী যুগে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। খোলা মরুভূমিতে প্রথম জানাযা সম্পন্ন হয় যাতে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৬-৮ লক্ষ, কেউ কেউ বলেন দশ লক্ষ, আর নারীর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। এ ছাড়াও কয়েকদিন পর্যন্ত জানাযা চলতে থাকে।জানাযার এ বিড়ল দৃশ্য প্রমাণ করে ইমাম আহমাদ সত্যিই সত্যিই আহ্লুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের ইমাম।
হিজরি দ্বিতীয় সহস্রাব্দের ধর্ম সংস্কারের মহান বিপ্লবী ও পুরোধা মুজাদ্দিদে আলফেসানি (রহ.)।ইতিহাসের এ মহান কিংবদন্তি ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের সিরহিন্দে ৯৭১ হিজরির ১৪ শাওয়াল, (১৫৬৪ ইং) শুক্রবার রাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাখদুম শায়খ আবদুল আহাদ (রহ.) ছিলেন প্রখ্যাত সুফি শায়খ আবদুল কুদ্দুস গঙ্গোহী (রহ.)-এর শীর্ষ খলিফা। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর ২৮তম অধস্তন বংশধর।হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানি (রহ.) যখন ৯৭১ হিজরিতে ভূমিষ্ঠ হন, তখন ছিল সম্রাট আকবরের স্বর্ণযুগ। আলফেসানি(রহ.) যখন মাত্র ১৭ বছর বয়সে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের পর উম্মাহকে ধর্মদ্রোহিতার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে ৯৮৮ হিজরিতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন সম্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহির প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত তুঙ্গে।দ্বীনে এলাহির মূল উপাদান ছিল অগ্নিপূজা, সূর্যপূজা, দরবারে প্রবেশ করতে তাঁকে সম্মানি সিজদা করা, নামাজ পড়তে নিষেধাজ্ঞা, পর্দা রহিতকরণ, সুদ-ঘুষ এবং জুয়ার বৈধতা, গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অনৈসলামিক দিবসের প্রচলন, শূকর হালাল বলে ঘোষণা, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি, ব্যভিচারের সাধারণ অনুমতি, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর পরিবর্তে কালেমা হিসেবে আকবর খলিফাতুল্লাহর ব্যাপকহারে প্রচলন। এগুলোই ছিল দ্বীনে এলাহির মৌলিক উপাদান। এটাকে হিন্দুধর্মের নতুন সংস্করণ ছাড়া আর কী বা বলা যায়? মুসলিম উম্মাহ তখন অত্যন্ত নাজুক মুহূর্তে অতিক্রম করেছে। উম্মাহর এমন ক্রান্তিকালে ধর্মদ্রোহিতার প্রতিরোধে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন টগবগে যুবক আহমদ সিরহিন্দী। এ কাজে তিনি একটি অত্যন্ত চমৎকার কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। তা হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন রাঘব বোয়াল মন্ত্রী-আমলা এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তাঁদের ইসলামের সঠিক শিক্ষায় দীক্ষিত করা। তাঁদের মাধ্যমেই যেন সম্রাটের অন্তরালোক উদ্ভাসিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে যেসব নীতিভ্রষ্ট লোকের পাল্লায় পড়ে তিনি বিপথগামী হয়েছেন, তাঁদের স্বরূপও তাঁর সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তিনি এ পথেই এগিয়ে চললেন। রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমেই তাঁর সংস্কার কার্যক্রমের সূচনা। তাঁর সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আকস্মিক ১০১৪ হিজরি (১৫৪২ ইং) সম্রাট আকবরের মৃত্যু ঘটে। এরপর ক্ষমতায় সমাসীন হন আকবরপুত্র জাহাঙ্গীর। তখন মুজাদ্দিদে আলফেসানির বয়স ৪৩ বছর। নতুন সম্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহি যে হালে পানি পায়নি, তা তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দেখলে বোঝা যায়। দ্বীনে এলাহি গ্রহণ করেছিল মাত্র ১৮ জন নির্বোধ! এদিকে তাঁর গগনচুম্বী সফলতা ও জনসম্পৃক্ততা স্বার্থান্বেষী ও নামধারী মূর্খ আলেমদের(!) চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। মুজাদ্দিদে আলফেসানির বিরুদ্ধে তারা আদাজল খেয়ে নামে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা তাঁকে কাফের ফতোয়া দিয়ে দেয়। আর তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট কথা রটিয়ে উদয়াস্ত সম্রাটকে খেপিয়ে তুলতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, সম্রাটও তাদের পাতানো ফাঁদে দ্রুতই পা দেয়। তাই সম্রাট তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে গোয়ালিয়ার কারাগারে পাঠিয়ে দেন।তাঁর কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক ওজস্বী উপস্থাপনা ও চরিত্র-মাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে জেলখানার বন্দিরা পরিণত হতে লাগল একেকজন সাক্ষাৎ আল্লাহর অলিতে। এভাবে কেটে গেল পুরো এক বছর দুই মাস। সম্রাট জানতে পারলেন, নবাগত এই বন্দির সাহচর্যে পশুগুলো মানুষ আর মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অন্তরালোকে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হলো। তিনি মুজাদ্দিদে আলফেসানি (রহ.)-কে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে রাজ দরবারে নিয়ে আসার নির্দেশ প্রদান করেন। হজরত শায়খ (রহ.) দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর রাজ দরবারে অবস্থান করেন। এর মধ্যে সম্রাটসহ সবার মধ্যে আমুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এবং সবার মাঝে পূর্বে কৃত গোনাহের দরুন অনুশোচনা জাগে।তাঁর জীবনঘড়ি যখন ৬৩-তে পৌঁছল, তখন তিনি বললেন, সম্ভবত আমি আর বাঁচব না। কারণ রাসুল (সা.)-এর বয়সও ছিল ৬৩ বছর। ২৮ সফর ১০৩৪ হি. ১৬২৪ ইং রোজ সোমবার বা মঙ্গলবার ৬৩ বছর বয়সে দ্বীনের এই কীর্তিমান মহাপুরুষ ইহকালের মায়া ত্যাগ করে পরকালের পথে পাড়ি জমান। মৃত্যুকালে তাঁর কণ্ঠে অনুরণিত হচ্ছিল একটি ফার্সি কবিতার স্তবক, যার ভাবার্থ হলো, আজ ওই প্রিয়তমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে, যাঁর জন্য আমি পুরো দুনিয়াকে উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত।
সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬ - ২৫ আগস্ট ১৯৬৬) হলেন একজন মিশরীয় ইসলামী চিন্তাবিদ এবং বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠক। তিনি মিশরের ইসলামী আন্দোলনের প্রধান সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন দলের মুখপত্র ইখওয়ানুল মুসলিমিন'এর সম্পাদক ছিলেন। তাকে তৎকালীন সরকার ফাঁসির আদেশ দেয় এবং এভাবেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সালের ৯ অক্টোবর মিসরের উসইউত জেলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম সাইয়েদ, কুতুব তার বংশীয় উপাধি।তার পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিশরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তার বাবার নাম হাজি ইবরাহীম কুতুব; তিনি চাষাবাদ করতেন।গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কুরআন হেফয করেন। পরবর্তীকালে তার বাবা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।সাইয়েদ কুতুব তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষা শেষ করে কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ওই মাদরাসা থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।১৯৫৪-এর ২৬ অক্টোবর আলেকজান্দ্রিয়ার মানশিয়া নামক এলাকায় বক্তব্য প্রদানকালে জামাল আব্দুন নাসেরের উপর আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। এই ব্যর্থ আক্রমণের দায়ভার চাপানো হয় ব্রাদারহুডের উপর। একই সাথে রাষ্ট্রীয় আদেশ মতে ব্রাদারহুডের সাময়িকী- ইখওয়ানুল মুসলিমুন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ব্রাদারহুডের নেতাদের আটক শুরু হয়। আটকের কাতারে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। আদালত তাঁকে ১৫ বছর কারাদণ্ডের হুকুম দেয়।দশবছর চলে যায় বন্দীখানায়। তারপর ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম আরেফ-এর মধ্যস্থতায় ব্রাদারহুডের অনেক নেতাকে আদালত মুক্তি দান করে। মুক্তিপ্রাপ্তদের মাঝে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পেলেও চিকিৎসার অভাবে তাঁর শরীর একদম ভেঙে পড়েছিল।শরীরের এই দুরবস্থা সত্ত্বেও তিনি চুপসে থাকেননি। معالم في الطريق নামের আলোড়ন-জাগানো বইটি লেখেন তখন। বইটির শক্ত ভাষা সেনাবাহিনীর উপর পরামাণু হয়ে অবতীর্ণ হলো। কেনই-বা হবে না, ক্ষুব্ধ সাহিত্যক ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন বন্দী দশবছর স্বচক্ষে বন্দীশালার পাশবিকতা দেখেছেন। কে পারবে শব্দ গেঁথে অনুভূতির সুন্দর-অসুন্দরকে তাঁর মতো তুলে ধরতে?যাইহোক, সাইয়েদ কুতুব মাত্র একবছর ছিলেন জেলের বাইরে। أعضاء التنظيم السر অর্থাৎ গোপন সংস্থার সদস্য বলে আবার ধর-পাকড় শুরু হয়। এখনকার জঙ্গি অপবাদের মতো অনেকটা। প্রায় বিশ হাজারের মতো আটক করা হয়। পঁচাত্তর জনকে সরকার উৎখাতের অপবাদে ফাঁসানো হয়। যাদের বেশির ভাগই ছিলেন ভার্সিটির প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার। তাদের মাঝে ছিলেন সাহিত্যিক ও গবেষক সাইয়েদ কুতুবও।আদালতে সরকারের ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা সাইয়েদ কুতুবকে বলেন, আপনি তো ব্রাদারহুডের সাথে নতুন যুক্ত হয়েছেন, বিচারপতির সামনে দুটি তুষ্টকথা উচ্চারণ করুন, আপনাকে মুক্তি দিয়ে দিবেন তিনি।তাঁর কথার উত্তরে সাইয়েদ কুতুব বলেন, আকিদার ক্ষেত্রে গোপনকরণ শোভা পায় না। আর একজন নেতার জন্য তুচ্ছতা গ্রহণও অসম্মানজনক।শেষমেশ ফাঁসির রায় শোনানো হয়। মূলত আব্দুন নাসের চেয়েছিলেন সাইয়েদ কুতুবকে আগে অপদস্ত করবেন, পরে মুক্তি দেবেন অথবা তাঁর ফাঁসির আদেশ রহিত করে সাজা কমিয়ে আনবেন। কিন্তু কে চায় কার রহমত? সাইয়েদ কুতুব হলেন আত্মমর্যাদার উপর সুদৃঢ় একজন ব্যক্তি। শুরু থেকেই সবাই এ ব্যাপারে জ্ঞাত।আহমাদ ফাররাগ নামের এক অফিসার এক সাক্ষাতে তাঁকে বলেন, যেন তিনি ছোট করে একটি ওজরনামার মতো কিছু লিখে দেন, অফিসার নিজ দায়িত্বে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। অফিসারের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সাইয়্যেদ কুতুব তখন বলেছিলেন, যেই শাহাদাত আঙুল আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করে আসমানের দিকে উত্থিত হয়, স্বেচ্ছাচারীর সমর্থনে ওজরনামা লিখতে সে আঙুল কোনোভাবেই ব্যবহৃত হবে না।সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসির কাষ্ঠে ওঠানোর আগে ওখানে ফুয়াদ আল্লাম নামে এক অফিসার ছিলেন। ফুয়াদ আল্লামও একই প্রস্তাব রেখেছিলেন সাইয়েদ কুতুবের কাছে। বলেছিলেন, জনাব, আসলেই আপনাকে মুক্তি দানের অভিপ্রায় ছিল, আপনি মুখে একটু ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন মাত্র। তখনও কুতুবের প্রত্যাখানমূলক সুদৃঢ় জবাব ছিল। বলেছিলেন, আল্লাহর রাস্তায় কাজ করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলছি, এ তো সৌভাগ্য, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে কেন আমার এ সৌভাগ্যকে আমি বিনষ্ট করব?অফিসার আবার বলেন, জনাব, শুধু মিনতি করবেন একটু, আমি এখনই সরকারকে জানিয়ে দেবো। সাইয়েদ কুতুব উত্তরে বলেন, কেন মিনতি করব? যদি আমি সৎভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকি, তাহলে আমি এই সিদ্ধান্তেই সন্তুষ্ট। আর যদি অন্যায়ভাবে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে থাকি, তাহলে বাতিলের কাছে মিনতি করার নীচুতা থেকে আমি অনেক ঊর্ধ্বে!২৯ আগস্ট ১৯৬৬ সালে ফজরের সময় সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেওয়া হয়।ফাঁসির আগে তিনি বলে গেছেন, ‘রক্তে সিঞ্চিত না হলে কোনো চেতনার স্থায়িত্ব আসে না।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন