বায়তুল মাল ইসলামি কোষাগার

 


#মো.আবু রায়হান

বায়তুল মাল একটি আরবি শব্দ যার অর্থ- অর্থের ঘর , ধন ভাণ্ডার, কোষাগার,ধনাগার House of money, House of Wealth ।ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে বলা হয় বায়তুল মাল। কিন্তু এর দ্বারা শুধু সে ইমরাতকেই বোঝায় না, যেখানে সরকারি ধনসম্পত্তির কাজকারবার পরিচালনা করা হয়; বরং ইসলামী রাষ্ট্রের যে বিভাগটি রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের খাতগুলোর নির্বাহ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে, ব্যাপক অর্থে তাকে ‘বায়তুল মাল’ বলা হয়। বায়তুলমাল বলতে সরকারের অর্থ সম্বন্ধীয় কর্মকাণ্ড বুঝায় না। বরং বিভিন্ন উৎস হতে অর্জিত ও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত ধন-সম্পদকেই বায়তুল মাল বলা হয়।

মদিনা নগরীতে মহানবী সা:-এর পবিত্র হাতে প্রথম যেদিন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়, মূলত সেদিন থেকেই বায়তুল মালের সূচনা হয়। এর মূল নাম ছিল ‘বাইতু মালিল মুসলিমিন’ বা ‘বাইতু মালিল্লাহ’। পরবর্তীতে মুসলিমিন শব্দটি বাদ দিয়ে এটিকে কেবল ‘বায়তুল মাল’ নাম রাখা হয়। তখন এই কোষাগারে কোনোরূপ ধনসম্পদ সঞ্চয় করে রাখা হতো না। তার সুযোগও তখন ছিল না। কারণ তখন সাধারণ নাগরিক ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আয় ছিল অতি সামান্য।ফলে রাসূলুল্লাহ সা:-এর হাতে কোনো সম্পদ আসার সাথে সাথেই তিনি তা অভাবীদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।সুতরাং জনসাধারণ পর্যায়ে কোষাগারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়নি।আবু বকর (রা.) এর সময়েও কোষাগার ছিল না। আবু বকর এমন একটি বাড়ি রেখেছিলেন যেখানে সমস্ত টাকা রসিদে রাখা হয়েছিল। হযরত আবু উবায়দাহ (রাযি.)-কে এর নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ করা হয়। সমস্ত অর্থ তৎক্ষণাৎ বিতরণ করা হওয়ায় সাধারণত কোষাগারটি খালি থাকত। আবু বকরের (রা.) মৃত্যুর সময় সরকারী কোষাগারে একটি মাত্র দিরহাম ছিল।খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর এই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার নামকরণ ‘বায়তুল মাল’ করা হয়। তিনি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। (ইমাম তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক : ২/৫১৯) ওমর রা:-এর খেলাফতকালে যখন মিসর এবং ইরাক থেকে খারাজ (ভূমিকর) ও জিজিয়া প্রভৃতি আসতে শুরু করে।ওমর (রা.) তাঁর পরামর্শক পরিষদের একটি সভা ডেকে এই অর্থ নিষ্পত্তি সম্পর্কে সাহাবাগণের মতামত চেয়েছিলেন। উসমান ইবনে আফফান পরামর্শ দিয়েছেন যে পরিমাণটি ভবিষ্যতের প্রয়োজনের জন্য রাখা উচিত। ওয়ালিদ বিন হিশাম পরামর্শ দিলেন বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠার। তখন ওমর কেন্দ্র মদীনা এবং প্রদেশগুলোয় বায়তুল মালের শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। আবদুল্লাহ ইবনে ইকরামাহ রা:কে ‘আমিরু খাজানা’ (গভর্নর অব দ্য স্টেট ব্যাংক) নিযুক্ত করে তার অধীনে আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও মুইকিব কে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেন। বায়তুল মালের জন্য ‘রেজিস্ট্রার’ এবং ‘দিওয়ান’ প্রণয়ন করা হয়। প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক বায়তুল মাল স্থাপন করা হয়। স্থানীয় ব্যয় মেটানোর পরে প্রাদেশিক কোষাগারগুলিকে উদ্বৃত্তের পরিমাণ মদীনা কেন্দ্রীয় কোষাগারে প্রেরণ করা হত। বায়তুল মাল' নামে রাজকীয় কোষাগারের জন্য একটি পৃথক বিল্ডিং নির্মিত হয়েছিল।

বায়তুল মালের মালিক

বায়তুল মাল’ রাষ্ট্রের সব মুসলিমের সাধারণ সম্পত্তি। ‘আল হাদিয়া’ নামের ফিকহ গ্রন্থে বলা হয়েছেÑ বায়তুল মালের সম্পত্তি মুসলিম জনসাধারণেরই সম্পত্তি। বায়তুল মালে সঞ্চিত রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদে সব নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত। রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সাধারণ মানুষ কেউই একচেটিয়া এর মালিক হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাণীতে সে কথাই ঘোষিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের দানও করি না, বারণও করি না, আমি তো বণ্টনকারীমাত্র। আমাকে যেরূপ আদেশ করা হয়েছে, আমি জাতীয় সম্পদ সেভাবেই দিয়ে থাকি।

বায়তুলমালের অর্থের উৎস-ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বায়তুলমালের অর্থ সংস্থানের উৎসগুলি নিন্মরূপ :

১। অর্থ সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত। ২। সদাকাতুল ফিতর। ৩। কাফফারাহ। ৪। ওশর। ৫। খারাজ। ৬। গণীমতের মাল ও ফাই। ৭। জিজিয়া। ৮। খনিজ সম্পদের আয়। ৯। নদী ও সমুদ্র হতে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চামাংশ। ১০। ইজারা ও কেরায়ার অর্থ । ১১। মালিক ও উত্তরাধিকারহীন সম্পদ। ১২। আমদানী ও রফতানী শুল্ক। ১৩। রাষ্ট্রের মালিকানা ও কর্তৃত্বধীন জমি, বন ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফা। ১৪। শরীয়াহ মোতাবেক আরোপিত কর এবং ১৫। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের অনুদান ও উপটৌকন।

বায়তুল মাল ব্যয়ের খাত- রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন,বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ, লা-ওয়ারিশ শিশুদের প্রতিপালন , অমুলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান , করযে হাসানা প্রদান , সামাজিক কল্যাণ - সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন হতে পারে এমন সব কাজে বায়তুলমাল হতেই অর্থ ব্যয় করার বিধান রয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই অর্থেই জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করা হতো। সরাইখানা নির্মাণ, শিক্ষাবিস্তার, পানির নহর খনন প্রভৃতি তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য। এ যুগেও শিক্ষার সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তার, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ পদ্ধতির ব্যাপক সম্প্রসারণ, পথিকদের সুবিধার ব্যবস্থা সবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিনামূল্যে নির্দিষ্ট একটা স্তর পর্যন্ত শিক্ষাদান, রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট ও সেতু নির্মাণ, দিঘী-পুকুর খনন সবই সমাজকল্যাণের আওয়াভুক্ত। মুসাফিরখানা স্থাপন, ভিক্ষাবৃত্তির উচ্ছেদ, গরমৌসূমে কাজের বিনিময়ে খাদ্যের যোগান, পুষ্টিহীনতা দূর, শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতিও সরকারের দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে বায়তুল মালের অর্থ ও সম্পদ হবে সবচেয়ে বড় সহায়ক। কোন নাগরিক যখন দারিদ্র হয়ে পড়বে, বৃদ্ধ হয়ে উপার্জন ক্ষমতা হারাবে তখন তার যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রের উপর নাগরিকদের এই অধিকার ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক। রাসূলের (সা.)-এর পর খুলাফায়ে রাশেদীনও (রা) এই দাবী পূরণে যত্নবান ছিলেন।

বায়তুল মাল প্রধানত তিন প্রকার-

ক. বায়তুল মাল আল খাস
খ. বায়তুল মাল আল আস
গ. বায়তুল মাল আল মুসলেমিন


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল