সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যে যুদ্ধের কারণে কুরআন সংকলন করতে হয়েছিল



#মো. আবু রায়হান

ইয়ামামার যুদ্ধ ৬৩২ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সৌদি আরবের ইয়ামামা নামক স্থানে মুসলিম ও স্বঘোষিত নবী মোসায়লামার পক্ষের লোকদের মধ্যে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ রিদ্দার যুদ্ধের একটি অংশ ছিল।৬৩২ সালে মহানবীর ইন্তেকালে হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত লাভ করেন । তার খিলাফাতের পর বেশ কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়। ফলে রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর আঘাত আসে। বেশ কিছু আরব গোত্র বিদ্রোহ করে এবং কয়েকজন ব্যক্তি নবুওয়ত দাবি করে। তাদের মধ্যে মোসায়লামা ছিল অন্যতম । বিভিন্ন গোত্রের তরফ থেকে বক্তব্য আসে যে তারা শুধু মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অনুগত ছিল এবং তার মৃত্যুর পর মিত্রতা শেষ হয়েছে। বিদ্রোহ গোত্রগুলো যাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। আবু বকর (রা.) তাদের দাবি অস্বীকার করেন এবং বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন। এসব ঘটনার ফলে রিদ্দার যুদ্ধের সূচনা হয়।
খলিফা আবু বকর বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করার জন্য ১১টি সেনাদল গঠন করেন।মোসায়লামাতুল কাজ্জব ছিল বনু হানিফা গোত্রের লোক। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের বিরুদ্ধে খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) যে কটি অভিযান পরিচালনা করেন সেগুলোর মধ্যে ইয়ামামার যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে মোসায়লামা ও তার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের ফলে ভ- নবীদের উৎপাত বন্ধ হয়ে যায়। এ যুদ্ধে মোসায়লামার সৈন্য সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার। পক্ষান্তরে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম।
উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হওয়ার একপর্যায়ে হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) রণকৌশল হিসেবে মোসায়লামাকে আক্রমণ করেন এবং সে প্রাণ রক্ষার্থে নিকটস্থ এক বাগানে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থা দেখে তার বাহিনীর সৈন্যরাও দৌড়ে গিয়ে বাগানে আশ্রয় নেয় এবং সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা বাগানের প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। অতঃপর একজন মুসলমান দুঃসাহসিকভাবে প্রাচীর টপকে বাগানের ভিতরে প্রবেশ করেন এবং ভিতর থেকে দরজা খোলেন। মুসলিম বাহিনী দ্রুত বাগানে প্রবেশ এবং তাদের হত্যা করতে থাকে। ওয়াহশী ও তার এক সঙ্গীর হাতে মোসায়লামাতুল কাজ্জব নিহত হন। বাগানে ভ- নবী ও তার অনুসারী সৈন্যদের রক্তের সয়লাব বইতে থাকে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী বনু হানিফার একুশ হাজার লোক মারা যায়। তাদের মধ্যে সাত হাজার লোক আকরাবা রণাঙ্গনে নিহত হয়, সাত হাজার মৃত্যু বাগানে নিহত হয় এবং সাত হাজারকে হত্যা করা হয় পলায়নকালে। বাকিরা হয়তো পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অপরদিকে মুসলমান শহীদদের সংখ্যা ছিল এক হাজার, তাদের মধ্যে কালামুল্লাহ শরীফের হাফেজের সংখ্যা ছিল অধিক এবং মোহাজেরীন ও আনসারের সংখ্যা ছিল ৩৬০।

ইয়ামামার যুদ্ধের পর আবু বকর (রা) কুরআন সংকলনে ভূমিকা রাখে। মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশায় কুরআনের বিভিন্ন অংশ সাহাবীদের কাছে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় লিখিত ছিল। ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০০ জন হাফিজ নিহত হন। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওফাতের পূর্বে কুরআন পরিপূর্ণ গ্রন্থরূপে সংকলিত হয়নি, কারণ তাঁর ওফাত পর্যন্ত কুরআনের অবতরণ-প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। অবতীর্ণ অংশসমূহ তখন চামড়া, গাছের বাকল, পাথর, চওড়া হাড়ের খন্ড ইত্যাদিতে লিপিবদ্ধ করা হতো। তবে রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর জীবদ্দশায় আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের সমুদয় আয়াতের বিন্যাসক্রম ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং তিনি ও তাঁর বহু সাহাবী সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেছিলেন। যাঁরা কুরআন মুখস্থ করেন তাঁদের বলা হয় হাফিজ। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফিজ শহীদ হওয়ায় হযরত ‘উমর (রা.) কুরআনের সঠিক সংরক্ষণ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন । তাই কোরআন সময়ের প্রয়োজন এবং তা একটি মাসহাবে লিপিবদ্ধ থাকা দরকার।হযরত ওমর (রা.) তাঁর এ চিন্তার কথা খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-কে বলেন। এ কথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) ইতস্ততা বোধ করলেন এবং বললেন, যে কাজ রসুলুল্লাহ (সা.) করেননি, তা আমি কীভাবে করতে পারি। এতে হযরত ওমর (রা.) বলেন, এটি তো অতি উত্তম কাজ। অতঃপর হযরত আবু বকর (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে অহি লেখক হযরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.)-কে তলব করেন এবং বলেন, আপনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে অহি লিখতেন, উমর (রা.) আমাকে একটি কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। আপনার মতও যদি তার মতো হয় তা হলে আমি সে কাজ করার অনুমতি দান করব। তা না হলে নয়। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) হযরত উমর (রা.)-এর প্রস্তাবটি পেশ করেন। প্রথমে হযরত জায়দ (রা.) এ মতের প্রতি সমর্থন দেননি এবং বললেন, যে কাজ আল্লাহর রসুল (সা.) করেননি তা আমি কীভাবে করতে পারি। কিন্তু হযরত উমর (রা.) তাকে এই কথা অনুপ্রাণিত করেন যে, এটি তো উত্তম কাজ। হযরত জায়দ (রা.) বলেন, আমাকে যদি পাহাড় উঠানোর নির্দেশ দেওয়া হতো সম্ভবত তা এত কঠিন হতো না, যা এ খেদমত আনজাম দিতে অনুভব করছি।অতঃপর হযরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.) এ দায়িত্ব পালনে সম্মত হন এবং তিনি গাছের ছাল, কাপড়ের টুকরা, খেজুরের পাতা, বকরি ও উটের পাঁজরে হাড় এবং লোকের কাছ থেকে কোরআন উদ্ধার করে একত্রিত করেন। রসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করেন, সে সময় তিনি যে কোরআন রেখে যান তা কিতাবী অর্থাৎ লিখিত আকারে একস্থানে ছিল না। তবে কোরআনের আয়াতসমূহ এবং সূরাগুলো বর্তমানের মতো বিন্যাস্ত ছিল কিন্তু সেগুলো বিক্ষিপ্তভাবে নানা স্থানে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, যার বিবরণ আগে প্রদত্ত হয়েছে। খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইয়ামামা যুদ্ধের পরবর্তী বিক্ষিপ্ত সব অংশ জমা করে সেগুলোকে কিতাব আকারে সাহাবিদের দ্বারা লেখান। যার দায়িত্বে ছিলেন জায়দ ইবনে সাবেত (রা.)। প্রথম খলিফার এটিই ছিল সবচেয়ে বড় কীর্তি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

মো.আবু রায়হানঃ আজ ২০ রমজান ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের ১৪৩৩ তম বার্ষিকী।আজ থেকে ১৪৩৩ বছর আগে হিজরতের ৮ম বছরে ২০ রমজান তথা ৬৩০ খৃস্টাব্দে রাসুল (সা.) মক্কা বিজয় করেন। ইতিহাসে এই ঘটনা মক্কা বিজয় বা ফতেহ মক্কা নামে খ্যাত।২০ রমজান শুধু মক্কা বিজয়ই হয়নি বরং প্রিয় নবি স্বমহিমায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন।তাই ২০ রমজান ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে।শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী হলো মক্কা বিজয়ের এ ঘটনা। পৃথিবীর আরম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত যত যুদ্ধ ,বিজয় অভিযান, হয়েছে এসব যুদ্ধ ও অভিযানে একদল বিজয়ী হয়েছে আরেক দল পরাজয়কে বরণ করেছে। এসব যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন দিগ্বিজয়ী ইতিহাসের মহানায়কেরা। তাদের মধ্যে হিটলার,আলেকজেন্ডার,আর নেপোলিয়ান বেনাপোর্টের বিজয় অভিযানগুলো ছিল রক্তপাতের ইতিহাস,মানুষের রক্তে হাত রঞ্জিত হবার ইতিহাস।একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়। ঐতিহাসিকদের মতে মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় যদিও আল কুরআনে হুদাইবি য়ার সন্ধিকেই ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলে উল্লেখ করা হয়েছ...