সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শ্যাম্পুর আবিস্কারক একজন বাঙ্গালি শেখ দীন মুহাম্মদ


#মো.আবু রায়হান
ইংরেজরা‘শ্যাম্পু’র পুরো কৃতিত্ব নিলেও এ প্রসাধনীর উদ্ভাবক শেখ দীন মুহাম্মদ।শেখ দীন মুহাম্মদের কাছেই ব্রিটেনের মানুষ প্রথমে জানতে পারে, চুলের পরিচর্যা কীভাবে করতে হয়। পয়সা খরচ করে সে সময় দীন মোহাম্মদের কাছে অভিজাত ইংরেজরা আসত শ্যাম্পু করতে।আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে ভারতে শেখ দীন মুহাম্মদ জন্ম গ্রহন করেন।শেখ দীন মুহাম্মদের জন্ম পলাশি যুদ্ধের দুবছর পর ১৭৫৯ সালে ভারতের পাটনায়। সে সময় পাটনা বাংলার অধীনে ছিল।নবাবী আমল প্রায় শেষ, মীর জাফর, মীর কাসিম এরা নামে মাত্র নবাব বনে আছেন। মুগল সম্রাটও প্রায় ক্ষমতাহীন। বড় হতে হতে দীন মুহাম্মদ শিখে ফেললেন মুগল আমলের সব রসায়ন বিদ্যা, সাবান, সুগন্ধি, তেল সবকিছু বানাবার কৌশল। সাথে উপরি হিসাবে কিছু চিকিৎসাবিদ্যাও। মাত্র ১০ বছর বয়েসে তিনি সেনাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং ক্যাপ্টেন গডফ্রে ইভান বেকারের অধীনে কাজের সুযোগ পান। ১৭৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাপ্টেন বেকারের বাহিনীতে থাকেন। ঐ বছর ক্যাপ্টেন বেকার সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিলে,কেউ কেউ বলে করতে বাধ্য হন, আর ফিরে যান ব্রিটেনে। শেখ দীন মুহাম্মদও পদত্যাগ করেন এবং 'তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু' ক্যাপ্টেন বেকারের সাথে ব্রিটেনে চলে যান।বেকার পরিবারের সাথেই তিনি ১৭৮৪ সালে চলে যান আয়ারল্যান্ডের কর্কে। ইংরেজি শেখার জন্য ভর্তি হন স্কুলে, সেখানে পরিচয় আইরিশ কিশোরী জেইন ডেলির সাথে। সুন্দরী জেইনের প্রেমে পড়ে যান দীন মুহাম্মদ, কিন্তু জেইনের পরিবার অমত করায় দুজনে ১৭৭৬ সালে পাশের শহরে পালিয়ে যান এবংবিয়ে করেন। ততোদিনে দীন মুহাম্মদ খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন।দীন মুহাম্মদের গল্পের পরের অধ্যায় লন্ডনে। ১৮১০ সালে সেখানে মুহাম্মদের পরিবার চলে আসার পরে একটা কফি হাউস দিয়ে শুরু করেন শেখ মোহাম্মদ। এরপর রেস্তোরাঁ খোলেন তিনি ।এটাই ছিলো ইংল্যান্ডের প্রথম ভারতীয় খাবার দাবারের রেস্তোরা। লন্ডনের জর্জ স্ট্রিটে খোলা হিন্দুস্তান কফি হাউজ নামের এই দোকানটি অবশ্য খুব ভালো চলেনি, অল্পদিন পরেই লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। দুশো বছর পরে ভারতীয় তথা বাঙালি খাবারের কী জয়জয়কার হবে ইংল্যান্ডে, শেখ দীন মুহাম্মদ জানতে পারেননি, লালবাতি জ্বেলে রেস্তোরার ব্যবসা বাদ দিয়ে লন্ডন ছেড়ে চলে যান।লন্ডনে রেস্তোরার ব্যবসাতে সাফল্য না পেলেও দীন মুহাম্মদের ভাগ্য ফিরে যায় ব্রাইটনে।
দীন মুহাম্মদের গোসলখানা 
১৮১৪ সালে সপরিবারে এই শহরে বসতি স্থাপনের পর দীন মুহাম্মদ খুলে বসেন তার স্নানাগার। সেসময়কার একটি স্থানীয় পত্রিকায় তার দোকানের বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এভাবে:The Indian Medicated Vapour Bath (type of Turkish bath), a cure to many diseases and giving full relief when every thing fails; particularly Rheumatic and paralytic, gout, stiff joints, old sprains, lame less, aches and pains in the joints
এই সুগন্ধি স্নানাগারে খদ্দেররা পেতেন দীন মুহাম্মদের তৈরী করা মাথার চুলে মাখাবার তেল- সেই তেল দিয়ে খদ্দেরদের চুলে মাথায় মালিশ করে দেয়া হতো। তেল মালিশের এই কাজটাকে হিন্দুস্তানী ভাষায় বলায় হতো চ্যাম্পু করা, আর সেই শব্দটিই সাগর পেরিয়ে মুহাম্মদের স্নানাগারে গিয়ে হয়ে যায় শ্যাম্পু।দূর দূরান্ত থেকে লোকজন কেবল দীন মুহাম্মদের দোকানে শ্যাম্পু করাতে ছুটে আসতো। শ্যাম্পু করে রোগবালাই দূর হয়, এই বিশ্বাসে হাসপাতাল থেকে রোগীদের পাঠানো হতো ব্রাইটনে। আর তেল মালিশ করে করেই দীন মুহাম্মদ পেয়ে যান ড: ব্রাইটন খেতাব। জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে যাওয়া এই মালিশ-চিকিৎসার সুবাদে খোদ ইংল্যান্ডের রাজা ৪র্থ জর্জ ও ৪র্থ উইলিয়ামের শ্যাম্পু সার্জন হিসাবে মুহাম্মদ নিয়োগ পান। ১৮৫০ এর পরে তেলের বদলে সুগন্ধি সাবান দিয়ে চুল ধোয়ার রীতি চালু হয়, কিন্তু রয়ে যায় শ্যাম্পু নামটি। নানাদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে দীন মুহাম্মদ ১৭৯৪ সালে The Travels of Dean Mahomet বা দীন মুহাম্মদের সফর নামা নামের বই লিখেন।বইটিতে সেনাবাহিনীতে তাঁর সময় উল্লেখ করেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় শহর ও সামরিক প্রচারের বর্ণনা করেন। বইটি চেঙ্গিস খান, তৈমুর এবং বিশেষ করে প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের প্রশংসা নিয়ে শুরু হয়। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং স্থানীয় ভারতীয় শাসকদের সঙ্গে সামরিক সংঘাতের একটি সিরিজ বর্ণনা করা হয়। শেখ দীন মুহাম্মদের বইয়ে ঢাকার বিবরণও আছে। দীন মুহাম্মদের ১৭৮৩ সালের ঢাকা ঘুরে যাওয়ার বিস্তারিত রয়েছে তাঁর বইয়ে। ভারতবর্ষ নিয়ে ইউরোপে তখন কৌতুহলের কমতি নেই, তাই বইটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। শুধু তাই নয়, একজন এশিয়ান হিসেবে ইংরেজিতে প্রথম বই লিখে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেছিলেন তিনিই প্রথম।তিনি প্রথম ইউরোপে ভারতীয় রন্ধনশৈলী ও শ্যাম্পু গোসলখানা প্রবর্তন করেন।ইউরোপে তিনি চিকিৎসামূলক মালিশও প্রবর্তন করেন। ইংল্যান্ডে আজকে যে ইন্ডিয়ান ফুডের জয় জয়কার দেখি সেটার প্রবর্তকও তিনিই। দীন মুহম্মদ প্রথম প্রজন্মের বাঙালি প্রবাসী তিনি চিরস্থায়ীভাবে পশ্চিমের জীবনকে পালটে দিয়েছিলেন। যদিও আমরা আমাদের এই কীর্তিমানকে কখনো মনে রাখিনি, কখনো স্মরণও করিনি। তিনি ১৮৫১ সালে ৯২ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে মারা যান। Mahomed died on 24 February 1851 (aged 91–92) at 32 Grand Parade, Brighton. He was buried in a grave at St Nicholas Church, Brighton, in which his son Frederick was later interred. Frederick taught fencing, gymnastics and other activities in Brighton at a gymnasium he built on the town's Church Street.গত বছর দীন মোহাম্মদের ২৬০তম জন্মদিন ছিল। তাঁকে স্মরণ করে গুগল ডুডলে বিশেষভাবে সম্মান জানানো হয় ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...