সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুহাম্মদ (সা.) এর পরিবার পরিজন




#মো আবু রায়হান
বংশ ধারা : মুহাম্মদ (সা.) বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব বিন হাশেম বিন আবদে মানাফ বিন কুসাই বিন কিলাব বিন মোররা বিন কাআব বিন লুয়াই বিন গালেব বিন ফেহের (তাঁর উপাধি ছিল কোরাইশ। এখান থেকে কোরাইশ বংশের প্রচলন) বিন মালেক বিন নজর বিন কানানা বিন খোজাইমা বিন মোদরাকা বিন ইলিয়াস বিন মুজার বিন নেজার বিন মাআদ বিন আদনান। (এ পর্যন্ত সব ঐতিহাসিকের ঐক্য আছে। এ বংশলতিকা হযরত ইসমাইল ও ইব্রাহিম (আ.) হয়ে হযরত আদম (আ.) পর্যন্ত পৌঁছেছে।)
নাম : মুহাম্মদ (সা.)।
উপনাম : আবুল কাসেম।
পিতা : আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব (আবদুল মুত্তালিবের দশ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ)।
মাতা : আমেনা বিনতে ওহ্হাব।
দাদা : আবদুল মুত্তালিব বিন হাশেম।
দাদি : ফাতেমা বিনতে আমর।
নানা : ওয়াহাব বিন আবদে মানাফ।
নানি : বোররা বিনতে ওমজা।
জন্মস্থান : মক্কা (বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত)।
জন্ম সাল- ৫৭০ খ্রি.। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মাঝে অনেক মতভেদ রয়েছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুফাসসির ও মুফতি জনাব শফি সাহেব (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া গ্রন্থে লিখেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। অপরদিকে আর-রাহীকুল মাখতুমের লেখক আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী লিখেন, রাসুলের (সা.) জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। তবে সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, নবী করিম (সা.) রবিউল আউয়াল মাসেই জন্মগ্রহণ করেছেন। যদিও তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু এ মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন এ ব্যাপারে কোন ঐতিহাসিকের মতভেদ নেই।
গোত্র : কোরাইশ।
বংশ : হাশেমি।
জন্ম সময় : রাত অতিবাহিত হয়ে প্রত্যুষে।

নবীপত্নীগণ- মহানবী (সা.)-এর এত বেশি বিয়ে আজকের যুগে অস্বাভাবিক মনে হলেও তত্কালীন আরব জগতে এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আল্লাহর নবীর জন্য (একাধিক বিয়ের ব্যাপারে) যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে তাঁর কোনো বাধা নেই। আগের নবীদের ক্ষেত্রে এটাই ছিল আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম। আল্লাহর আদেশ নির্ধারিত, অবধারিত। (সুরা : আল আহজাব, আয়াত : ৩৮) যেমন দাউদ (আ.)-এর ছিল ১০০ জন পত্নী, ৩০০ জন উপপত্নী। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর ছিল ৩০০ পত্নী এবং ৭০০ জন উপপত্নী।ইব্রাহিম (আ.)-এর তিনজন, ইয়াকুব (আ.)-এর চারজন, মুসা (আ.)-এর চারজন স্ত্রী ছিলেন।হিন্দুদের গ্রন্থ মনুসংহিতায় পাঁচজন স্ত্রী থাকার কথা উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণের ছিল শত পত্নী ও উপপত্নী। (মনুসংহিতা, অধ্যায় : ৯, শ্লোক : ১৮৩) তত্কালীন আরবেও এমন বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল।কিন্তু মুহাম্মদ (সা.)-এর বিয়ে প্রায় সবগুলোই মানবিক, একটি কোরআনের আয়াতের বাস্তবায়ন, দু-একটি ইসলামী শরিয়া বাস্তবায়ন। কেউ কেউ ছিলেন মহানবী (সা.)-এর বৃহত্তর পরিবারের সদস্য, ফুফাতো বোন অথবা চাচাতো বোন। অনেক বিধবা-অসহায় নারীকে তিনি নিজ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। একজন বাদে কেউই কুমারী ছিলেন না; বরং মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে অনেকের বিয়ে হয়েছিল, যাঁদের অনেক সন্তান ছিল, তা নিয়েই।
১. হযরত খাদিজা (রা.) : নবী করিম (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী। তিনি বিধবা, তবে বিদুষী, ধনী নারী ছিলেন। পবিত্র মক্কায় তিনি ‘তাহেরা’—অর্থাৎ পবিত্র বলে পরিচিত ছিলেন। নবী (সা.)-এর চেয়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের বড় ছিলেন তিনি। নবুয়তের প্রথম জীবনে নবী (সা.)-এর দাওয়াতের কাজে তিনি বিশেষভাবে পাশে দাঁড়ান। খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যু পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নবী (সা.)-এর একমাত্র স্ত্রী। মক্কা থেকে মদিনায় ইতিহাসখ্যাত হিজরতের মাত্র তিন বছর আগে হযরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল হয়। এ সময় নবী করিম (সা.-)এর বয়স ছিল ৪৯ বছর। খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন। এঁদের অনেকেই ছিলেন বিধবা বা যুদ্ধে স্বামীহারা অথবা স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা দুস্থ। কোনো বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আল্লাহর সরাসরি নির্দেশে। ইসলাম ধর্মে খাদিজার মর্যাদা অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে অনেক উপরে। তিনি প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি। মুহাম্মদ (সা) এর সাথে প্রথম নামায তিনিই পড়েছিলেন। ইসলাম ধর্ম অনুয়ায়ী বর্ণিত আছে যে, ফেরেশতা জিবরাইল মুহাম্মদ (সা) কে বলেন, "আপনি তাকে (খাদিজা) আল্লাহ ও আমার পক্ষ থেকে দেওয়া সালাম পৌঁছিয়ে দিন।"বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে বলা হয়েছে, "পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহিলা হলো মরিয়ম বিনতে ইমরান ও খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ।" আরো বলা হয়েছে, " জান্নাতে তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি প্রাসাদের সুসংবাদ দিন।"খাদিজা সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা) বলেন, "মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তখন সে আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফির (অবিশ্বাসী) ছিলো, তখন সে ছিলো মুসলিম। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে নি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে।"
২. সাওদা বিনতে জামআ (রা.) : সাওদা বিনতে জামার পিতা যা’মা ইবনে কাস মক্কার কুরাইশ গোত্রের আমির ইবনে লুআই বংশের ছিলেন। তার মাতা আল-সামস্ বিনতে কাস মদিনার বংশের বনু নাজযার। তিনি ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে যারা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন তিনি তাদের অন্যতম ছিলেন।তিনি আস-সাকরান ইবনে আমরকে বিয়ে করেন। তাদের ছেলে আবদুর রহমান ইবনে সাকরান জালুলা যুদ্ধে নিহত হন।সাকরানের মৃত্যুর পর নবী (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
৩. আয়েশা (রা.) : আবু বকর (রা.)-এর কন্যা। কেবল আয়েশা (রা.)-ই কুমারী মেয়ে ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর বিয়ে হয়েছিল। তিনি ছিলেন তার তৃতীয় স্ত্রী। নবী (সা.)-এর ওফাতের সময় আয়েশা (রা.)-এর বয়স ছিল আঠারো বছর। নবী (সা.)-এর বহু হাদিস আয়েশা (রা.)-এর মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছেছে। তাঁর প্রখর স্মরণশক্তি এ কাজে সহায়ক হয়েছিল। আয়েশা (রা.)- বিবাহ পরবর্তী সমস্ত জীবনে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। যখন তিনি অসুস্থ হলেন এবং মৃত্যু নিকটবর্তী হওয়ার আশঙ্কা করলেন তখন তিনি তার স্ত্রীগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, পরবর্তী ক্রমে তিনি কার ঘরে থাকবেন? যখন তার স্ত্রীগণ বুঝতে পারলেন যে তিনি আয়েশা (রা.)-র সাথে থাকতে চাইছেন তখন তারাও তদানুযায়ী অনুমতি ও সম্মতি দিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি তার ঘরেই ছিলেন এবং তার এই সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীর বাহুতে মাথা রেখেই মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেন।
৪. হাফসা (রা.) : তিনি ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের মেয়ে। । প্রথমে খুনাইস ইবনে হুজাইফার সাথে হাফসার বিয়ে হয়। তবে পরে তিনি বিধবা হন। তার ইদ্দত সমাপ্ত হওয়ার পর তার বাবা উমর প্রথমে উসমান ইবনে আফফান ও পরে আবু বকরকে তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দেন। তবে তারা দুজনেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর মুহাম্মদকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি তা গ্রহণ করেন। এর ফলে উমর ইবনুল খাত্তাবের সাথে তার সম্পর্ক আরো শক্ত হয়।আবু বকরের খিলাফতের সময় সাহাবি জায়েদ ইবনে সাবিতকে কুরআনকে গ্রন্থাকারে সংকলনের দায়িত্ব দেয়া হয়। সংকলিত কুরআনটি হাফসা বিনতে উমরের নিকট সংরক্ষণের জন্য রাখা হয়েছিল। উসমান ইবনে আফফান খলিফা হওয়ার পর হাফসার নিকট রক্ষিত কুরআনটিকে প্রামাণ্য ধরে আরো কপি তৈরি করা হয়।[২] এছাড়া হাফসা বিনতে উমরের বর্ণিত হাদিসও রয়েছে।
৫. জয়নাব বিনতে খুজাইমা (রা.) : তিনি মদিনায় নিঃস্বদের জননী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম জীবনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তোফায়েল ইবনে হারিছের সঙ্গে। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে তোফায়েলেরই ভাই উবায়দাকে বিয়ে করেন তিনি। উহুদের যুদ্ধে উবায়দা শহীদ হন।হযরত জয়নব বিনতে খুজাইমা(রা) ছিলেন বিধবা, ইসলাম গ্রহনের ফলে আত্বীয়স্বজনকর্তৃক বিতাড়িতা পরিত্যাক্তা ও অসহয়া।একান্ত মানবিক এবং নৈতিক কারনে বিধবা ,দুস্থা,অনাথাকে আশ্রয় দেওয়ার লক্ষ্যে মহানবী(স) তাকে হিজরী তৃতীয়সালে বিবাহ করে উম্মুল মুমিনীন সম্মানে ভূষিত করেন।এই বিবাহের সময় মহানবী(স) এর বয়স ছিল ছাপ্পান্ন বছর,জয়নবের বয়সছিল উত্রিশ বা ত্রিশ বছর।কিন্তু বিবাহিত জীবনের ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়।
৬. সালামা (রা.) : তার প্রকৃত নাম ছিল "হিন্দ আল-মাখজুমিয়া"। প্রথম সন্তান সালামার নামের অনুসরণে তাকে উম্মে সালামা নামে অভিহিত করা হয়। মুহাম্মদ (সা) এর সাথে তার বিয়ের আগে উম্মে সালামার আবু সালামা আবদুল্লাহ ইবনে আবদ-আল-আসাদ আল-মাখজুমির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। আবু সালামার চার সন্তান উম্মে সালামা গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন: সালামা, উমর, যয়নব ও রুকাইয়াহ। উহুদের যুদ্ধে তার স্বামী মারাত্মকভাবে আহত হন এবং শেষাবধি সকল প্রকার চিকিৎসা ও পরিচর্যা সত্বেও মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় উম্মে সালামার সন্তান সংখ্যা চার্ এই অসহায অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে মুহাম্মাদ (সা) তাকে বিবাহ করেন। এ সময় উম্মে সালামা বয়স ২৭ এবং রাসুলুল্লাহ'র বয়স ৫৭ বৎসর।ধারণা করা হয় মৃত্যুকালে তাৎর বয়স ছিল ৮৪ বৎসর। রাসুলুল্লাহ'র স্ত্রীদের মধ্যে তারই সর্বশেষে ইন্তেকাল হয়। মদীনায় জান্নাতুল বাকীতে তার কবর অবস্থিত।
৭. জয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) : তিনি ছিলেন নবী (সা.)-এর ফুফাতো বোন। নবী (সা.) প্রথমে তাঁর এই বোনকে তাঁর পালকপুত্র জায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দেন। এই বিয়েতে গোড়া থেকেই জয়নাব (রা.)-এর আপত্তি ছিল। ফলে তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। জায়েদ (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে জয়নব (রা.) সম্পর্কে ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব, গোত্রগত মর্যাদা ও আনুগত্যে শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগ উত্থাপন করেন।মহানবী (সা.)-কে ওহির মাধ্যমে জানানো হয় যে জায়েদ (রা.) জয়নব (রা.)-কে তালাক দিয়ে দেবেন। অতঃপর আপনি তাঁর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবেন। একদা হযরত জায়েদ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে এসব অভিযোগ পেশ করতে গিয়ে হযরত জনয়বকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মহানবী (সা.) যদিও ওহির মাধ্যমে অবগত হয়েছিলেন।পরে তাঁদের পারিবারিক জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। জয়নাব (রা.)-এর আপত্তিতে এ বিয়ে সংঘটিত হওয়ায় এবং পরে বিচ্ছেদ ঘটায় নবী (সা.)-এর মনে কিছুটা অনুশোচনা আসে। এ থেকে জয়নাব (রা.)-কে নিজে বিয়ে করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও তত্কালীন আরবের কুসংস্কারের জন্য তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। জাহেলি যুগের প্রথা ছিল যে যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো পুত্রকে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করত, তাহলে এ পোষ্যপুত্র তার প্রকৃত পুত্র বলে গণ্য হতো। এ পোষ্যপুত্র সব ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদাভুক্ত হতো। তারা প্রকৃত সন্তানের মতো সম্পদের অংশীদার হতো এবং বংশ ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব নারীর সঙ্গে বিয়ে-শাদি হারাম, এ পোষ্যপুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এরূপ মনে করা হতো। বিয়েবিচ্ছেদ সংঘটিত হওয়ার পর ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা যেরূপ হারাম, অনুরূপভাবে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও হারাম বলে মনে করা হতো। পবিত্র কোরআনের সুরা আহজাবে আয়াত নাজিল হলে ইসলাম চিরতরে এ প্রথাকে বিলুপ্ত করেছে । মহানবী (সা.) পঞ্চম হিজরিতে মদিনায় জনয়বকে বিয়ে করেন। তখন রাসুল (সা.)-এর বয়স ছিল ৫৮ বছর, আর জনয়ব (রা.)-এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। এ বিয়ে হয়েছিল সরাসরি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন, আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন, তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো। তখন আপনি (আপনার) অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিয়েছেন (যে দত্তক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পত্নিত্বে বরণ করতে হবে)। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন, অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ করলাম। যাতে পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে মুমিনদের অন্তরে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব্ব না থাকে। (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৭) পালক ছেলে ও ঔরসজাত সন্তান সমতুল্য নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কুসংস্কার নির্মূল করার উদ্দেশ্যে নবী (সা.)-এর মাধ্যমে সেই বিধান বাস্তবায়ন করে দেখানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়। তখনই জয়নাব (রা.)-এর সঙ্গে নবী (সা.)-এর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
৮. জুওয়াইরিয়া (রা.) : একটি আরব গোত্রের সরদার হারিছের কন্যা। হযরত জুওয়াইরিয়ার (রা) প্রথম বিয়ে হয় তাঁরই গোত্রের ‘মুসাফি’ ইবন সাফওয়ান’ (জী শুফার) নামের এক ব্যক্তির সাথে। তিনি ছিলেন হযরত জুওয়াইরিয়ার (রা) চাচাতো ভাই এবং ‘জী আশ-শুফার’ নামে প্রসিদ্ধ। পিতা হারিস ও স্বামী মুসাফি’ উভয়ে ছিলেন ইসলামের চরম শত্রু। যুদ্ধে বন্দিনী হয়ে আসেন। মহানবী (সা.) যুদ্ধবন্দির সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ হন। উপহার হিসেবে গোত্রের সব বন্দি মুক্তি লাভ করে। তাঁর পিতা হারিছও ইসলাম গ্রহণ করেন।
৯. উম্মে হাবিবা (রা.) : উম্মে হাবিবা নামে অধিক পরিচিত রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান মহানবী (সা.)-এর চাচা আবু সুফিয়ানের কন্যা। প্রথমে উবায়দুল্লাহ বিন জাহাশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দুজনই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আফ্রিকার হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে উবায়দুল্লাহ খ্রিস্টান হয়ে যান। উবায়দুল্লাহ থেকে উম্মে হাবিবাকে মুক্ত করতে তিনি হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির মাধ্যমে চাচাতো বোন উম্মে হাবিবা (রা.)-কে বিয়ে করেন।
১০. সাফিয়া (রা.) : তিনি ছিলেন নবীদেরই বংশধর। হজরত মুসা (আ.)-এর ভাই হজরত হারুন (আ.)-এর অধস্তন বংশধারার কন্যা। প্রথমে কিনানা ইবনে আবিলের স্ত্রী ছিলেন তিনি। কিনানার মৃত্যুর পর মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
১১. মায়মুনা (রা.) : তার প্রকৃত নাম ছিল বাররাহ, কিন্তু মুহাম্মাদ তার নাম পরিবর্তন করে মায়মুনা রেখেছিলেন। তিনি প্রথমে মাসউদ বিন ওমরের স্ত্রী ছিলেন। সে তালাক দিলে আবু রিহামের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আবু রিহাম মারা যাওয়ার পর মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।নবী 'ওমরা' পালনের পর ফেরার পথে মক্কা নগরী থেকে ১০ মাইল দূরে শরিফ নামক স্থানে ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ করেছিলেন। তখন মুহাম্মাদ ( সা) এর বয়স ৫৮ এবং সম্ভবত মায়মুনার বয়স ৩০ বছরের কিছু কম বা বেশি ছিল।
১২.রায়হানা (রা) - এর পিতার নাম ছিল শামাউন। শামাউনের বিধবা কন্যা হযরত রায়হান (রাঃ) - কে দস্যুগণ অপহরণ করে দাসীরূপে বিক্রি করে। ইসকান্দারিয়ার শাসনকর্তা মুকাউকিস তাঁকে দাসী হিসেবে কিনে নিল এবং হযরত রাসূল (সঃ) - এর নিকট উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করেন। কোন কোন গ্রন্থকার উল্লেখ করা হয়েছে হযরত রাসূল (সঃ) তাকে সহধর্মিণী করে নিয়েছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও জীবনী লেখকের অভিমত এই যে, হযরত রাসূল (সঃ) তাঁকে বিয়ে করেননি, দাসী হিসেবেই রেখেছিলেন ।
১৩.মারিয়া যিনি মারিয়া আল-কিবতিয়া নামেই অধিক পরিচিত।মিসরের শাসক মুকাওকিসকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা)। মুকাওকিস অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে সে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। চিঠির সাথে কিছু উপঢৌকনও পাঠিয়েছিলেন। এই উপঢৌকনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মারিয়া কিবতিয়া(রা.)।মারিয়া কিবতিয়া(রা.) এর গর্ভে ইব্রাহিম নামে রাসুলুল্লাহ এর একজন সন্তানও জন্মেছিলেন।১৬ অথবা ১৮ মাস বয়সে ইব্রাহিম মৃত্যু বরণ করেন।
মহানবির সন্তানেরা- জীবনীকারদের কেউ কেউ বলেছেন, জয়নাব ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সব সন্তানের মধ্যে বড়। কেউ বলেছেন, রোকাইয়া ছিলেন সবার বড়, আবার কেউ বলেছেন, উম্মে কুলসুম ছিলেন সবার বড়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, রোকাইয়া ছিলেন সবার বড় এবং উম্মে কুলসুম ছিলেন সবার ছোট। (সূত্র : মুফতি শফি (রহ.), সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা. ২৭)
কাসিম : তিনি নবীজির প্রথম সন্তান। নবুয়তের পূর্বে তার জন্ম হয়েছে। কাসেম (তাঁর নামানুসারে মহানবী (সা.)-এর উপনাম হয়েছিল আবুল কাসেম)। তিনি কতদিন বেঁচে ছিলেন, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে; অনেকে বলেন, ১৭ মাস। নবীজি (সা.)-এর সন্তানদের মধ্যে তিনিই প্রথম মারা যান।
আব্দুল্লাহ : বলা হয়, তিনি মক্কায় বাল্যকালেই মারা গেছেন। তবে তার জন্ম কি নবুয়তের পরে না পূর্বে, এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কয়েকজন নবুয়তের পরে হওয়ার মতকে সহীহ বলেছেন। তার উপাধি ছিলো তাইয়িব ও তাহির (উত্তম ও পবিত্র)। তবে কারও মতে তাইয়িব ও তাহির হলো শেষ দুই সন্তানের উপাধি। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, না, দুটিই আবদুল্লাহ রা.-এর উপাধি। (যাদুল মায়াদ, খন্ড- ১, পৃষ্ঠা ১০৩)
জয়নব : মুহাম্মাদ (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির ১০ বছর পূর্বে, মুহাম্মাদের বয়স ৩০ বছর এবং মাতা খাদিজার বয়স ৪৫ বছরের সময় জয়নবের জন্ম হয়। যায়নাবের শৈশব সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। মুহাম্মাদের মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়নাবের বিয়ে হয়। তখন মুহাম্মাদ নবুয়ত পাননি, তবে ইবনে সা‘দ বলেছেন, মুহাম্মাদ তখন নবুয়ত প্রাপ্ত।যাই হোক স্বামী আবুল আস ইবন রাবি ছিলেন জয়নাবের খালাতো ভাই। মা খাদিজার আপন ছোট বোন হালা বিনত খুওয়াইলিদের ছেলে।জয়নব মুহাম্মাদ (সা) এর সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কিনা সেটা কিনা মতপার্থক্য রয়েছে। বংশবিদ্যা বিশারদদের একটি দলের মতে কাসিম প্রথম ও জয়নাব দ্বিতীয় সন্তান। ইবনুল কালবির মতে, যায়নাব প্রথম সন্তান। ইবনে সাদের মতে, যায়নাব মেয়েদের মধ্যে সবার বড়। ইবন হিশাম মুহাম্মাদের সন্তানদের ক্রমধারা এভাবে সাজিয়েছেন প্রথমে বড় ছেলে আল কাসিম, তারপর আত তাইয়িব ও আত তাহির এরপর বড় মেয়ে রুকাইয়া, তারপর যায়নাব তারপর উম্মে কুলসুম এরপর ফাতিমা।
নবীজি (সা.)-এর নবুয়তের সম্মানে ভূষিত হলে খাদিজা (রা.) ও তার সকল কন্যা ইসলাম তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন; কিন্তু আবুল আস শিরকের গলিতেই থেকে যান। নবীজি (সা.) তার অন্য দুই মেয়ে রুকাইয়া (রা.) ও উম্মে কুলসুমকে (রা.) আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবাহ ও উতাইবার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু কুরাইশের সামনে আল্লাহর বিধান পরিষ্কার হয়ে গেলে তারা বললো, তোমরা মুহাম্মদের সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যাও। তার মেয়েদের তার কাছে ফিরিয়ে দাও, তাদের নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে দাও। আবু লাহাবের ছেলেরা তাদের আহ্বানে সাড়া দেয় এবং মিলনের পূর্বেই তারা স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিনিময়ে উতবার সাথে এরপর আবান ইবনে সাঈদ ইবনে আস-এর কন্যাকে বিয়ে দেওয়া হয়। আর এই বিচ্ছেদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নবীজির মেয়েকে উতবার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে সম্মানিত করেন। তারা আবুল আসের কাছেও আসে এবং তাকেও বলে, তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে দাও, পরিবর্তে তুমি কুরাইশের যে-মেয়েকে চাও, বিয়ের ব্যবস্থা করবো। আবুল আস বললেন, আল্লাহর কসম, আমি স্ত্রীকে ছাড়তে পারবো না এবং আমার স্ত্রীর পরিবর্তে কুরাইশের অন্য কোনো মেয়েকেও আমি চাই না। নবীজি (সা.) তার প্রশংসা করতেন।নবীজি (সা.) যয়নবকে (রা.) তার কাছে ফিরিয়ে দেন প্রথম বিয়ের ভিত্তিতেই এবং নতুন কিছুই আরোপ করেন নি। (ইবনে হিশাম, খন্ড- ২, পৃষ্ঠা ৬৫১-৬৫৯) এভাবে এই সম্মানিত পরিবারটি আবার মিলিত হলো, যদিও বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। দুই বছর পর অষ্টম হিজরিতে যয়নব রা. ইন্তেকাল করেন। তার গর্ভে দুটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে আলী ও উমামা (রা.)।
রুকাইয়া : রুকাইয়া রা. জন্মগ্রহণ করেন, তখন নবীজির বয়স ৩৩ বছর। মক্কায় থাকাকালে ওসমান ইবনে আফফান (রা.) তাকে বিয়ে করেন। আবু লাহাবের ছেলে উতবা মিলনের পূর্বে তাকে ছেড়ে দিলে এই বিয়ে সংঘটিত হয়। তিনি তার স্বামীর সাথে দুইবার হিজরত করেছেন, হাবশায় ও মদিনায়। উজ্জ্বল সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। নবীজি বদর যুদ্ধে যাত্রা করার প্রাক্কালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জন্য ওসমানকে (রা.) তিনি মদিনায় রেখে যান। বলে যান, নিশ্চয় যারা বদর যুদ্ধে শহীদ একজনের সমপরিমাণ সাওয়াব ও গনিমত তোমার জন্য থাকবে। (বুখারী, হাদিস ৩৬৯৮) এই অসুস্থতায়ই রুকাইয়া (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) এসেছিলেন বদর যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সুসংবাদ দিতে। এসে দেখেন, তার কবরের ওপরে মাটি সমান করা হচ্ছে। তার ঘরে এক ছেলে আব্দুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। তার নামেই ওসমান (রা.) উপনাম নিয়েছিলেন। তবে আব্দুল্লাহ ছয় বছর বয়সে মারা যান। এরপর ওসমান (রা.) তার ছেলে ‘আমর’-এর নামে উপনামে গ্রহণ করেন।
উম্মে কুলসুম : উম্মে কুলসুম (রা.)-এর নাম (কননা, উম্মে কুলসুম মানে কলুসুমের আম্মা।) জানা যায় না; তিনি এ-উপনামেই পরিচিত ছিলেন। নবীজি তাকে ওসমান (রা.)-এর কাছে বিয়ে দেন তার বড় বোন রুকাইয়া মারা যাওয়ার পরেই। এটা ছিলো তৃতীয় হিজরির ঘটনা। ওসমান (রা.)-এর স্ত্রী হিসেবেই তিনি আজীবন অতিবাহিত করেন। ৯ হিজরিতে আল্লাহ তাকে মৃত্যু দা করেন। নবীজি নিজে তার জানাযা পড়িয়েছেন, তার কবরের পাশে বসেছেন, এ-সময় চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিলো। দাফনের আগে তিনি সাহাবীদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের মধ্যে কি কেউ আছে গত রাতে সহবাস করে নি? আবু তালহা (রা.) বলেন, আমি। নবীজি বলেন, তুমি কবরে নামো। আবু তালহা (রা.) তার কবরে নামেন। (বুখারী, হাদিস ১২৮৫)ওসমানকে (রা.) যিন্নূরাইন (দুই জ্যোতির অধিকারী) উপাধি দেওয়া হয়। কেননা, তিনি নবীজির দুই মেয়েকে বিবাহ করেন। ওসমান (রা.)-এর স্ত্রী থাকাকালে উম্মে কুলসুমের কোনো সন্তান হয় নি।
ফাতিমা : তার জন্মসন সম্পর্কে নিশ্চিত জানা যায় নি। ইবনুল জাওযি (রহ.) বলেন, নবুয়তের ৫ বছর পূর্বে তার জন্ম হয়। ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেন, তার জন্ম হয়েছে নবীজির ৪১ বছর বয়সে। (৪৯ আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, খন্ড- ২, পৃষ্ঠা ৬৩)নবীজি তাকে আলী (রা.)-এর কাছে বিয়ে দেন। এই বিয়ে সংঘটিত হয় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। (বিস্তারিত জানতে দেখুন, লেখক কৃত ‘মিন মায়ীনিস সীরাত’, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২২৫) নবীজির কাছে তার আপনজনদের মধ্যে মধ্যে সবচে’ প্রিয় ছিলেন তিনি। নবীজি তার ক্ষোভে ক্ষুব্ধ হতেন, তার সন্তোষে সন্তুষ্ট হতেন। হাদিসে এসেছে, মিসওয়ার ইবনে মাখরামা বলেন, আলী (রা.) আবু জাহেলের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফাতেমা (রা.) তা শুনে ফেলেন। তারপর নবীজির কাছে এসে বললেন, আপনার সম্প্রদায় মনে করে, আপনার মেয়েদের কিছু হলেও আপনি ক্ষুব্ধ হন না। এ-দিকে আলী আবু জাহেলের মেয়েকে বিবাহ করতে যাচ্ছে। নবীজি (সা.) এ-কথা শোনামাত্রই দাঁড়িয়ে যান। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তার (ফাতিমা) উপস্থিতিতে নবীজিকে বলতে শুনেছি, আমি আবুল আসের কাছে এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। সে আমাকে কথা দিয়েছে এবং কথা রেখেছে। আর ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা। আমি তার কষ্ট অপছন্দ করি। আল্লাহর কসম, আল্লাহর নবীর মেয়ে এবং আল্লাহর শত্রুর মেয়ে এক ব্যক্তির কাছে একত্র হতে পারে না। এরপর আলী (রা.) তার প্রস্তাব বাতিল করেন। অন্য বর্ণনায় আছে, হিশাম ইবনে মুগীরা তার মেয়েকে আলী ইবনে আবু তালিবের কাছে বিয়ে দেবার অনুমতি চেয়েছেন। কিন্তু নবীজি বলে দেন, অনুমতি দেবো না, অনুমতি দেবো না, অনুমতি দেবো না। যদি আবু তালিবের ছেলে চায়, তাহলে আমার মেয়েকে তালাক দিয়ে তার মেয়েকে বিয়ে করুক। কারণ, ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা। তার সংশয় আমাকে সংশয়ে ফেলে। তার কষ্ট আমাকে কষ্ট দেয়। (বুখারী, হাদিস ৩৭২৯)ফাতেমা (রা.) হলেন এই উম্মতের নারীদের সর্দার। ফাতিমা (রা.) ইন্তেকাল করেন নবীজির মৃত্যুর ছয় মাস পরেই। তিনি জননী ছিলেন তিনটি ছেলে সন্তানের হাসান, হুসাইন ও মুহসিনে। মুহসিন ছোট থাকতেই মারা যান। এবং দুই মেয়ে সন্তানের উম্মে কুলসুম ও যয়নব। নবীজির জন্য ফাতেমা ছাড়া আর কোনো উত্তরসূরি ছিলো না। তাই তার সম্মানিত বংশধারার বিস্তার হয়েছে শুধু দুই দৌহিত্র হাসান ও হুসাইনের (রা.) মাধ্যমে। হাসান (রা.) সম্পর্কিত বংশধারাকে বলা হয় হাসানি এবং হুসাইন (রা.) সম্পর্কিত বংশধারাকে বলে হুসাইনি। ফাতেমা (রা.)-এর মেয়ে উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেছিলেন ওমর (রা.)। তার ঘরে যায়েদ ও রুকাইয়া নামে দুটি সন্তান হয়। তবে তাদের দুজনের কোনো উত্তরসূরি হয় নি। তারপর তার বিবাহ হয় আউন ইবনে জাফরের সাথে। তার মৃত্যুর পরে বিবাহ হয় আউনের ভাই মুহাম্মদ ইবনে জাফরের সাথে। তিনিও মারা গেলে তাদের আরেক ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সাথে বিবাহ হয় তার। তার স্ত্রী থাকাকালেই তিনি ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয় ভাই মুহাম্মদ ইবনে জাফরের ঔরসের একটি ছোটো মেয়ে ছাড়া এই তিনজন থেকে তার আর কোনো সন্তান হয় নি তার। সুতরাং সেদিক থেকেও তার কোনো ওয়ারিস নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর পরে তার বোন যয়নব বিনতে ফাতেমাকে বিয়ে করেন। তার কয়েকটি সন্তান হয়। (আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, খন্ড- ২, পৃষ্ঠা ৬৬)
ইবরাহিম : ইবরাহিম (রা.) জন্ম গ্রহণ করেন অষ্টম হিজরির যিলহজ মাসে। তার মাতা হলেন মারিয়া কিবতিয়া (রা.)। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো এক রাতে আমার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। আমার পিতৃপুরুষের নামে তার নাম রেখেছিলাম ইবরাহিম। তারপর নবীজি তাকে উম্মে সাইফ-এর কাছে অর্পণ করলেন; যিনি ছিলেন আবু সাইফ নামক এক কামারের স্ত্রী। (মুসলিম, হাদিস ২৩১৫) নবীজি প্রায়ই মদিনার উঁচু ভূমিতে যেতেন, যেখানে ইবরাহিমের দুধ মায়ের বাড়ি। সেখানে গিয়ে ইবরাহিমকে দেখতেন, তাকে চুমু দিতেন, তারপর ফিরে আসতেন।আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, নবীজির মতো সন্তানদের প্রতি এতোটা মমতাবান আমি আর কাউকে দেখি নি। তিনি বলেন, মদিনার উঁচু এলাকার এক ঘরে ইবরাহিম দুধপান করতো। নবীজি সেখানে যেতেন, আমরাও তার সাথে থাকতাম। তিনি ঘরে প্রবেশ করতেন এবং সেই ঘর তখন ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকতো। কারণ তার দুধপিতা ছিলেন লোহার কর্মকার। তিনি ইবরাহিমকে কোলে নিতেন, চুমু দিতেন, তারপর ফিরে আসতেন। (মুসলিম, হাদিস ২৩১৬) অন্য বর্ণনায় আছে, তাকে চুমু দিতেন এবং তার ঘ্রাণ নিতেন। (বুখারী, হাদিস ১৩০৩)ইবরাহিমের জীবনসীমা দীর্ঘ হয় নি, মারা গেছেন দুধপানের বয়সেই। নবীজি বলেছেন, ইবরাহিম আমার সন্তান, সে স্তন্যপানের সময়েই মারা গেছে। তার দুইজন দুধমা আছেন, যারা জান্নাতে তার দুধপানের মেয়াদ পূর্ণ করবে। (মুসলিম, হাদিস ২৩১৬) ইবরাহিম (রা.)-এর শেষ মুহূর্তগুলোর প্রকৃতি সহীহ বুখারীতে স্পষ্ট বিবৃত হয়েছে। আনাস (রা.) বলেন, আমরা ইবরাহিমকে দেখতে গেলাম। এর খানিক পরেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। নবীজির দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। তা দেখে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বললেন, আল্লাহর রাসুল, আপনি কাঁদছেন? তিনি বলেন, হে আউফের ছেলে, এটাই তো দয়া। তারপর বললেন, চোখ অশ্রু ঝরায়, হৃদয় বিষণ্ন হয়। আমার প্রতিপালক যে কথায় সন্তুষ্ট, তা-ই আমরা বলি। ইবরাহিম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যথিত। (বুখারী, হাদিস ১৩০৩) তার মৃত্যুর দিন সূর্যে গ্রহণ লেগেছিলো। লোকজন বলাবলি করলো, ইবরাহিমের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। নবীজি বললেন, চন্দ্রে বা সূর্যে কারো মৃত্যুর কারণে গ্রহণ লাগে না। কারো বেঁচে থাকার কারণেও না। তোমরা গ্রহণ দেখলে নামাজ পড়ো, আর দোয়া করো। (মুসলিম, হাদিস ৯১৫)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...