মুতার যুদ্ধ যেখানে শহীদ হন তিন সেনাপতি



#মো.আবু রায়হান
মহানবী (সা) এর জীবদ্দশায় মুসলমানরা যেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন মুতার যুদ্ধ ছিল সেসবের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী। এই যুদ্ধই খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশসমূহ জয়ের দার খুলে দেয়। অষ্টম হিজরীর জমাদিউল আউয়াল অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ বা সেপ্টেম্বর মাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।মুতা বর্তমানে জর্ডানের বালকা এলাকার নিকটবর্তী একটি জনপদ। এই জায়গা থেকে বায়তুল আকসা মসজিদের দূরত্ব মাত্র দুই মানযিল বা ৩২ মাইল । মুতার যুদ্ধ এখানেই সংঘটিত হয়েছিল।

হজ্জ থেকে ফিরে এসে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্ন গোত্রীয় নেতাদের অনুরোধে নানা স্থানে ইসলামের দূত প্রেরণ করলেন। কোনো কোনো স্থানে মুসলিম দূতের প্রতি অশোভন ও বিরোধমূলক আচরণ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী বিভিন্ন স্থানে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেন। ইবনে হিশাম ও ওয়াকিদীর মতে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) হোদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরের পর থেকে মক্কা বিজয় (৬৩০ খ্রি.) পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোট ১৭টি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। রাসুল (সা) উত্তরদিকে যে তিনটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, মুতার যুদ্ধ তন্মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। রোমের কায়সারের গবর্ণর শরহাবিল ইবনে আমর গাস্সানি মুতা নামক স্থানে মুহাম্মদ (সা.) প্রেরিত মুসলিম রাজদূত হারেছ ইবনে ওমায়ের আযদীকে হত্যা করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রদূত বা সাধারণ দূতদের হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। এটা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল, এমনকি এর চেয়েও গুরুতর মনে করা হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তখন বাধ্য হয়ে অষ্টম হিজরিতে একদল সৈন্য মুতাভিমুখে পাঠিয়ে দিলেন। রাসুল (সা) যায়েদ ইবনে হারেসা (রা) -কে এই সেনাদলের সেনাপতি মনোনীত করেন। এরপর বলেন যে, যায়েদ যদি নিহত হন তবে জাফর যদি শহিদ হন, তবে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা সিপাহসালার নিযুক্ত হবেন।রাসুল (সা) মুসলিম সেনাদলের জন্যে সাদা পতাকা তৈরী করে তা হযরত যায়েদ ইবনে হারেসার কাছে দেন। সৈন্যদলকে তিনি ওসিয়ত করেন যে, হারেছ ইবনে ওমায়েরে হত্যাকান্ডের জায়গায় তারা যেন স্থানীয় লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তো ভালো যদি ইসলাম গ্রহণ না করে তবে আল্লাহর দরবারে সাহায্য চাইবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। তিনি আরো বলেন, আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহর পথে, আল্লাহর সাথে কুফুরকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, খেয়ানত করবে না, কোন নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং গীর্জায় অবস্থানকারী দুনিয়া পরিত্যাগকারীকে হত্যা করবে না। খেজুর এবং অন্য কোন গাছ কাটবে না, কোন অট্টালিকা ধ্বংস করবে না।
মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা
মাআন নামক এলাকায় দুই রাত অতিবাহিত করার পর মুসলিম বাহিনী শত্রুদের প্রতি অগ্রসর হলেন। বালকার মাশারেফ নামক জায়গায় তারা হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদের মুখোমুখি হলেন। শত্রুরা আরো এগিয়ে এলে মুসলমানরা মুতা নামক জায়গায় গিয়ে সমবেত হন। এরপর যুদ্ধের জন্য সৈন্যদের বিন্যস্ত করা হয়। ডানদিকে কোতাবা ইবনে কাতাদা আজরিকে এবং বামদিকে ওবাদা ইবনে মালেক আনসারী (রা.)-কে নিযুক্ত করা হয়।
যুদ্ধ
সর্বপ্রথম রাসুল (সা) এর প্রিয় পাত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছ (রা.)পতাকা গ্রহণ করেন। যায়েদের নেতৃত্বে সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার এবং অন্যদিকে রোমানরা ছিল লক্ষাধিক।অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ ধরনের বীরত্বের পরিচয় মুসলমান ব্যতীত অন্য করো ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি।হযরত যায়েদ-এর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে নেন হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সাদাকালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর আঘাত করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে তার ডানহাত কেটে গেলে তিনি বাঁ হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত এভাবে পতাকা ধরে রাখেন।ইমাম বোখারী (রহ) নাফে-এর মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) (রা.)একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মুতার যুদ্ধের দিনে হযরত জাফর শহীদ হওয়ার পর আমি তার দেহে আঘাতের চিহ্নগুলো গুণে দেখেছি। তার দেহে তীর ও তলোয়ারের পঞ্চাশটি আঘাত ছিল। এ সব আঘাতের একটিরও পেছনের দিকে ছিল না উভয় বর্ণনায় সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য নিরসন এভাবে করা হয় যে, তীরের আঘাতের সংখ্যাসহ ৯০টি।বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত জাফর (রা.)-এর শাহাদাত বরণের পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) পতাকে গ্রহণ করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সামনে অগ্রসর হন। তিনি ওজস্বিনী ভাষায় সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে আমার কওম! আল্লাহর কসম! তোমরা যেটাকে অপছন্দ কর, নিশ্চয় তোমরা সেটা অন্বেষণের জন্যই বের হয়েছ। আর তা হ’ল ‘শাহাদাত’। আমরা মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করিনা সংখ্যা দ্বারা, শক্তি দ্বারা বা আধিক্য দ্বারা। আর আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করিনা কেবলমাত্র এই দ্বীনের স্বার্থ ব্যতীত। যার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। অতএব সামনে বাড়ুন। নিশ্চয় এর মধ্যে কেবলমাত্র দু’টি কল্যাণের একটি রয়েছে। হয় বিজয় নয় শাহাদাত। অতঃপর সকলে বললেন, অবশ্যই, আল্লাহর কসম! ইবনু রাওয়াহা সত্য বলেছেন’। এরপর তিনি সকলের উদ্দেশ্যে স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা পাঠ করেন’।
‘ওরে মন খুশী বেজার যেভাবে হোক
মোকাবেলা কর। যুদ্ধের আগুন জ্বেলেছে ওরা
বর্শা রেখছে খাড়া। জান্নাত থেকে
কেনরে তুই থকতে চাস দূরে?
এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। তার চাচাতো ভাই গোশত লেগে থাকা একটা হাড় তার হাতে দেন। তিনি এক কামড় খেয়ে ছুঁড়ে ফেলেন। এরপর লড়াই করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেনাপতি যায়েদ এবং পরে জাফর ও আবদুল্লাহ শহীদ হন। মুসলমানদের এ বিপর্যয়ের মুখে মহাবীর খালিদ সেনাপতিত্ব গ্রহণ করলেন। তাকে পেয়ে মুসলিম সৈনিকদের মনে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা ফিরে এলো। রণনিপুণ খালিদ যুদ্ধের অবস্থানদৃষ্টে পশ্চাদপসরণই উপযুক্ত মনে করলেন। বুদ্ধিমান খালিদের এ সিদ্ধান্ত মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়কে সম্ভব করেছিল। ইতোমধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রেরিত একটি সাহায্যকারী সেনাদল মুতায় এসে পৌঁছল। শক্তিমান খালিদের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী এবার প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রুদের ওপর আঘাত হানল এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিল। মুতার ময়দানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড়ল। এদিকে রাসুল (সা) রণক্ষেত্রের খবর লোক মারফত পৌঁছার আগেই ওহীর মাধ্যমে পান। তিনি বলেন, যায়েদ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি শহীদ হন। এরপর জাফর পতাকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি শহীদ হন। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও শহীন হন। রাসুল (সা) চোখ এ সময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এরপর পতাকা গ্রহণ করেন আল্লাহর তলোয়ার সমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার।
সাইফুল্লাহ উপাধি
মুতার যুদ্ধের পর নবীজী খালিদ-বিন ওয়ালিদকে বীরত্বের জন্য 'সাইফুল্লাহ' (আল্লাহর তরবারি) উপাধি দান করলেন।মুতার যুদ্ধে তিনি এতটাই বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন যে তাঁর হাতে ৯টি তরবারি ভেঙে যায়। এ প্রসঙ্গে সহিহ বুখারিতে স্বয়ং খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুতার যুদ্ধে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙেছে। এরপর আমার একটি ইয়ামানি তলোয়ার অবশিষ্ট ছিল।’ (সহিহ বুখারি, মুতার যুদ্ধ অধ্যায় : ২/৭১১)
হতাহতের সংখ্যা
মুতার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর মাত্র ১২ জন শহীদ হন’ (ইবনু হিশাম ২/৩৮৮-৮৯)। রোমক বাহিনীর হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও একা খালেদ বিন অলীদের যেখানে নয় খানা তরবারি ভেঙ্গেছিল’ (বুখারী হা/৪২৬৫), তাতে অনুমান করা চলে কত সৈন্য তাদের ক্ষয় হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এটাই ছিল ‘খন্দক’ যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।এতেই শত্রু সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
মুতার যুদ্ধের প্রভাব

যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুতা অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো, সেটা সম্ভব না হলেও এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের সুনাম সুখ্যাতি বহু দূর বিস্তার লাভ করে। সমগ্র আবর জগত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কেননা, রোমকরা ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আবরব মনে করতো যে, রোমকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। কাজেই, উল্লোখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তিনহাজার সৈন্য এক লাখ সৈন্যের মোকাবেলায় আরবের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, ইতিপূর্বে পরিচিতি সকল শক্তির চেয়ে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আলাদা। মুসলমানদের চিরশত্রু জেদী ও অহংকারী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু সংখ্যক গোত্র মুতার যুদ্ধের পর ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব গোত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গোত্র হচ্ছে, বনু ছালিম, আশজা, গাতফান, জিবান ও ফাজারাহ।মুতার যুদ্ধের প্রাক্কালে রোমকদের সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়েছিল এর ফলেই পরবর্তীকালে মুসলমানদের বিজয় গৌরব দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল