সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তাবুক যুদ্ধ/ তাবুক অভিযান ( ৬৩০ খ্রি.)


#মো. আবু রায়হান

তাবুক যুদ্ধ/ তাবুক অভিযান ( ৬৩০ খ্রি.) ছিল রাসূল (সা )-এর জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং যা রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। তৎকালীন সময়ের অর্ধেক পৃথিবীর একচ্ছত্র শাসক রোম সম্রাটের সিরিয় গবর্ণরের বিরুদ্ধে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে পরিচালিত ‘মুতা’ অভিযানে এক অসম যুদ্ধে রোমকদের পিছুটানের ফলে আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রভাব বিস্তৃত হয়। তাতে যুগ যুগ ধরে রোমকদের শাসন-শোষণে নিষ্পিষ্ট আরবদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরিত হয়। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী রোম শাসিত শাম রাজ্যের জন্য তা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়। আল্লাহ তাআলা এ যুদ্ধের প্রক্কালে কুরআনে উল্লেখ করেন, ‘যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য কোনো জাতিকে নিয়ে আসবেন। আর তোমরা কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা তাওবা, আয়াত ৩৯)আলোচ্য আয়াত তাফসিরে এসেছে, ‘তাবুক যুদ্ধের পটভূমিতে নাজিল হয়েছে এ আয়াত। যুদ্ধের নির্দেশ আসার পরও যারা নানা কারণে পিছিয়ে পড়েছিল, এই আয়াতে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।তাবুক মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। মদিনা থেকে এটি ৬৯০ কিলোমিটার দূরে এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে ৬৯২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের ও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবম হিজরির রজব মাসে এই যুদ্ধ শুরু হলেও রমজানে কিছু খণ্ড যুদ্ধ হয়। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ৩/১৬২৭)মদীনার সাবেক আউস নেতা ও খৃষ্টান ধর্মীয় গুরু আবু আমের আর-রাহেব হোনায়েন যুদ্ধের পর সবদিক দিয়ে নিরাশ হয়ে অবশেষে সিরিয়ায়(শাম) চলে যান। কেননা এটি তখন ছিল খৃষ্টানদের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে গিয়ে তিনি রোম সম্রাটকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে মদীনার মুনাফিকদের সাথে তিনি পুরা যোগাযোগ রাখেন এবং তাদেরকে দিয়ে তিনি মসজিদে ক্বোবার অদূরে ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ করান মসজিদের মুখোশে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে। রোম সম্রাটকে তিনি বুঝাতে সক্ষম হন যে, মদীনায় মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তার একটি বিরাট দল রয়েছে। যারা বাহ্যিকভাবে মুহাম্মাদের দলে মিশে আছে। বাইরে থেকে রোমকরা হামলা করলেই তারা ঘুরে দাঁড়াবে এবং রোমকদের সহজ বিজয় লাভ হবে। উল্লেখ্য যে, ওহোদ যুদ্ধে শহীদ এবং ফেরেশতারা যার লাশ গোসল করান, সেই বিখ্যাত ছাহাবী হানযালা ছিলেন এই ফাসেক আবু আমেরের পুত্র। আবু আমের আমৃত্যু গোমরাহী ও খৃষ্টবাদের উপরে অবিচল ছিলেন রাসূল(সা) তার লকব দেন ‘আবু আমের আল-ফাসেক’।একদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতা অন্যদিকে আবু আমেরের এই প্ররোচনা রোম সম্রাটকে উৎসাহিত করল। পূর্ণরূপে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই উঠতি ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করে দেবার সংকল্প নিয়ে তিনি ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততি শুরু করেন। যাতে রোম সাম্রাজ্য সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোনরূপ ফিৎনা বা বিদ্রোহ দেখা দেবার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।রোমানদের দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)-কে হত্যার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে। (আর-রহিকুল মাখতুম, পৃ. ৩৫৪) আল্লামা ওহবা আজ-জুহাইলি (রা.)-এর মতে, ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রোমান ও আরবের কাফেরদের সমন্বয়ে ঘটিত যৌথ বাহিনীর রণপ্রস্তুতিই এই যুদ্ধের মূল কারণ।’ (তাফসিরে মুনির) নবী করিম (সা.) মক্কা বিজয় ও হুনায়েনের যুদ্ধ শেষে যখন মদিনায় ফিরে এলেন, এর কিছুদিন পর শাম (সিরিয়া) থেকে ফিরে আসা কতিপয় বণিক দলের কাছ থেকে খবর পেলেন, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে শাম ও আরব সীমান্তে তারা এক বিশাল বাহিনী মোতায়েন করছে। এ খবরে মদিনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়; যদিও সাহাবায়ে কেরাম এযাবৎ বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তবু এ সবই ছিল আরব উপদ্বীপের ( জাজিরাতুল আরব) ভেতরে। কোনো বহিঃশত্রু বা রাজকীয় বাহিনীর মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তা ছাড়া রোম ছিল তৎকালীন দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি। মহানবী (সা.) ফয়সালা করলেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের অপেক্ষা না করে মুসলমানরা নিজেরাই আগে তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। সুতরাং তিনি মদিনার সব মুসলিমকে এ যুদ্ধে শরিক হওয়ার নির্দেশ দিলেন। এটা ছিল এক কঠিন পরীক্ষা।প্রথমতঃ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বহু যুদ্ধের পর এটা ছিল মুসলমানদের কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সময়।দ্বিতীয়ত, এটা ছিল মদিনাবাসীর প্রধান খাদ্য খেজুর পাকার সময়। সারা বছরের খেজুর তাদের তখনই সংগ্রহ করতে হতো। এ সময় বাগান ছেড়ে যাওয়াটা তাদের জন্য ছিল কঠিন কাজ।তৃতীয়ত, এটা ছিল আরব অঞ্চলে তীব্র গরমের সময়।চতুর্থত, তাবুকের সফর ছিল অনেক দীর্ঘ ও দুর্গম। প্রায় পুরো পথই ছিল দুর্গম মরুভূমি।যদি আশু লাভের সম্ভাবনা থাকতো এবং যাত্রাপথও সংক্ষিপ্ত হতো, তবে তারা অবশ্যই আপনার সহযাত্রী হতো, কিন্তু তাদের নিকট যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হল। আর তারা এমনই শপথ করে বলবে, আমাদের সাধ্য থাকলে অবশ্যই তোমাদের সাথে বের হতাম, এরা নিজেরাই নিজেদের বিনষ্ট করছে, আর আল্লাহ জানেন যে, এরা মিথ্যাবাদী।' (সুরা তাওবা : আয়াত ৪২)পঞ্চমত, মদিনায় তখন খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।ষষ্ঠত, তাদের যুদ্ধসরঞ্জাম ও বাহন পশুরসংখ্যা ছিল খুব কম।সর্বোপরি তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়া ছিল অনেক কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ।


জিহাদ ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা

(১) আবুবকর ছিদ্দীক(রাঃ) তাঁর সর্বস্ব এনে হাযির করলেন। আল্লাহ ও রাসূল ব্যতীত তার পরিবারের জন্য কিছুই ছেড়ে আসেননি। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি জিহাদ ফান্ডে দানের সূচনা করেন।
(২) ওমর ফারূক(রাঃ) তার সমস্ত মাল-সম্পদের অর্ধেক নিয়ে এলেন।
(৩) ওছমান গণী(রাঃ) পরপর পাঁচবারে হাওদাসহ ৯০০ উট, গদি ও পালান সহ ১০০ ঘোড়া, প্রায় সাড়ে ৫ কেজি ওযনের কাছাকাছি ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা, প্রায় ২৯ কেজি ওযনের কাছাকাছি ২০০ উক্বিয়া রৌপ্য মুদ্রা দান করেন। স্বর্ণমুদ্রাগুলি যখন রাসূলের কোলের উপরে তিনি ঢেলে দেন, তখন রাসূল(ছাঃ) সেগুলি উল্টে-পাল্টে বলতে থাকেন,‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ওছমানের কোন ক্ষতি করবে না’। এই বিপুল দানের জন্য তিনি ‘তাবুক যুদ্ধের রসদ যোগানদাতা’ খেতাব প্রাপ্ত হন (ইবনু খালদূন)।
(৪) আব্দুর রহমান বিন আওফ(রাঃ) ২০০ উক্বিয়া রৌপ্যমুদ্রা দান করেন।
(৫) আববাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিব বহু মাল-সামান নিয়ে আসেন।
(৬) আছেম বিন আদী ৯০ অসাক্ব অর্থাৎ প্রায় ১৩,৫০০ কেজি খেজুর জমা দেন। এতদ্ব্যতীত ত্বালহা, সা‘দ বিন ওবাদাহ, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ প্রমুখ প্রচুর মাল-সম্পদ দান করেন। এভাবে এক মুদ, দুই মুদ করে কম-বেশী দানের স্রোত চলতে থাকে।
মহিলাগণ তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা অলংকার ছিল, রাসূল(ছাঃ)-এর নিকটে পাঠিয়ে দেন। কেউ সামান্যতম কৃপণতা করেননি।
এই সময় আবু আকবীল আনছারী (রাঃ) ২ সের যব রাসূল(ছাঃ)-এর খিদমতে পেশ করে বলেন, সারা রাত পরের ক্ষেতে পানি সেঁচে ৪ সের যব মজুরি হিসাবে পেয়েছি। তার মধ্যে ২ সের বিবি-বাচ্চার জন্য রেখে বাকীটা নিয়ে এসেছি’। দয়ার নবী তার হাত থেকে যবের থলিটি নিয়ে বললেন, তোমরা এই যবগুলো মূল্যবান মাল-সম্পদের স্ত্তপের উপরে ছড়িয়ে দাও’। অর্থাৎ এই সামান্য দানের মর্যাদা হ’ল সবার উপরে। সুবহানাল্লাহ।
যুদ্ধ যাত্রা
৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে নবী (সা.) তাবুক অভিমুখে বের হন। এটা ছিল তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান। এই সময় তিনি মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ আনছারীকে মতান্তরে সেবা‘ বিন আরফাতা -কে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করেন এবং হযরত আলীকে তাঁর পরিবারের দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে যান। সাধ্যমতো দান করলেও বিশাল এই সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য ও পানীয় পর্যাপ্ত ছিল না। তাই পথিমধ্যে খাবারের সংকট ও প্রচণ্ড খরতাপে খাবার পানির অভাব দেখা দেয়। বাহন সংকট থাকা সত্ত্বেও উট নহর করে খাদ্যাভাব পূরণ করতে হয়। গাছের ছাল-পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় নিরুপায় হয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে ছুটে আসে মুসলিম সৈন্যরা। তারা পানির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলে। নবী (সা.) আল্লাহর কাছে পানি প্রার্থনা করলে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। সব সৈন্য সেই পানি পান করে এবং পাত্রে সংরক্ষণ করে। যাওয়ার পথে হিজর এলাকা মুসলিম বাহিনীর সামনে পড়ে। এখানে সামুদ জাতি ধ্বংস হয়েছিল। তাদের পাহাড়কাটা ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ পড়েছিল। নবী (সা.) সেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন এবং কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলেন।
বিনা যুদ্ধে জয় লাভ
মুসলিম বাহিনীর তাবুকে উপস্থিতির খবর শুনে রোমক ও তাদের মিত্ররা এতই ভীত হয়ে পড়ল যে, তারা মুকাবিলার হিম্মত হারিয়ে ফেলল এবং তারা তাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তৎকালীন বিশ্বশক্তির এই বিনাযুদ্ধে পলায়নের ফলে সমস্ত আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির জন্য এমন সব অযাচিত রাজনৈতিক সুবিধাদি এনে দিল, যা যুদ্ধ করে অর্জন করা সম্ভব হ’ত না। যেমন- (১) আয়লার খৃষ্টান শাসনকর্তা ইউহান্নাহ বিন রু’বাহ রাসূল(ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে সন্ধি করেন এবং তাঁকে জিযিয়া প্রদান করেন।(২) অনুরূপভাবে আযরুহ ও জারবা -এর নেতৃবৃন্দ এসে জিযিয়া প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) তাদের প্রত্যেককে সন্ধির চুক্তিনামা প্রদান করেন, যা তাদের কাছে রক্ষিত থাকে। শুধুমাত্র জিযিয়ার বিনিময়ে তাদের জান-মাল-ইযযত ও ধর্মের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার গ্যারান্টি দেওয়া হয়।(৩) এরপর আল্লাহর রাসূল(ছাঃ) দূমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা উকায়দিরের নিকটে ৪২০ জন অশ্বারোহী সৈন্যের একটি বাহিনী সহ খালেদ বিন ওয়ালীদকে প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি বলে দেন যে,তুমি তাকে জংলী নীল গাভী শিকার করা অবস্থায় দেখতে পাবে’ সেটাই হ’ল। চাঁদনী রাতে দুর্গটি পরিষ্কার দেখা যায়, এমন দূরত্বে পৌঁছে গেলে হঠাৎ দেখা গেল যে, একটি নীল গাভী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গদ্বারে শিং দিয়ে গুঁতা মারছে। এমন সময় উকায়দির গাভীটাকে শিকার করার জন্য লোকজন নিয়ে বের হলেন। এই সুযোগে খালেদ তাকে বন্দী করে ফেললেন। এভাবে রাসূল(ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়।উকায়দির রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আনা হ’ল। অতঃপর ২০০০ উট, ৮০০ দাস, ৪০০ লৌহবর্ম ও ৪০০ বর্শা দেবার শর্তে এবং জিযিয়া কর প্রদানে স্বীকৃত হওয়ায় তার সঙ্গে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হ’ল। যেমন ইতিপূর্বে আয়লাহ, তাবুক, ও তায়মার সাথে সম্পাদিত হয়েছিল। একইভাবে রোমকদের মিত্র অন্যান্য গোত্রসমূহ তাদের পুরানো মনিবদের ছেড়ে মুসলমানদের নিকটে এসে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হ’ল। এভাবে একেবারেই বিনাযুদ্ধে এবং কোনরূপ জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই আল্লাহর গায়েবী মদদে মদীনার ইসলামী খেলাফতের সীমানা বিস্তৃত হয়ে রোম সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা জানতে পেরে কালবিলম্ব না করে সেখান থেকে তাঁর বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। এই যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এমন কিছু সাহাবিও ছিলেন, যাঁদের কাছে এ অভিযান অত্যন্ত কঠিন মনে হয়েছিল। শুরুর দিকে তাঁরা কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরাও সৈন্যদের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছিলেন। এর পরও হাতে গোনা কিছু সাহাবি এমন রয়ে গিয়েছিলেন, যাঁরা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে মুসলমান দাবিদার কিছু মোনাফিকও ছিল, যারা এই বিপৎসংকুল যুদ্ধাভিযান থেকে শুধু নিজেরাই গা বাঁচানোর চেষ্টা করেনি, অন্যদেরও অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
মদীনার পথে রাসূল(সা)
২০ দিন তাবুকে অবস্থানের[13] পর এবং স্থানীয় খ্রীষ্টান ও অন্যান্য গোত্রগুলির সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রোমক বাহিনীর সাথে কোনরূপ সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় ছাড়াই বিজয় সম্পন্ন ও সুসংহত করার পর আল্লাহর রাসূল(ছাঃ) মদীনার পথে রওয়ানা হ’লেন। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলূল সাধারণ মুসলমানদের এই বলে ধোঁকা দিয়েছিল যে, রোম সম্রাট হ’লেন অর্ধপৃথিবীর শাসক। তাঁর সুশিক্ষিত বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে মুহাম্মাদের এইসব নিঃস্ব বাহিনী ফুৎকারে উড়ে যাবে। আর ‘তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো যে, মুহাম্মাদ আর কখনোই মদীনায় ফিতে পারবে না। রোম সম্রাট তাদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেবে’।কিন্তু বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জয়ের পর যখন রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) ও তাঁর সাথীগণ সহাস্য বদনে মদীনায় ফিরে চললেন, তখন উক্ত মুনাফিক নেতার গোপন সাথী যারা ছিল, তারা প্রমাদ গুণলো এবং রাসূলকে পথিমধ্যেই হত্যার পরিকল্পনা নিল।
রাসুলকে হত্যার চেষ্টা
মুবারকপুরী বলেন, মদীনায় ফেরার পথে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) (ছাঃ) একটি সংকীর্ণ গিরিসংকট অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তার সাথে কেবল আম্মার বিন ইয়াসির ও হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ছিলেন। প্রথমোক্ত জন রাসূলের উষ্ট্রীর লাগাম ধরে সামনে হাঁটছিলেন এবং শেষোক্ত জন পিছনে থেকে উষ্ট্রী হাঁকাচ্ছিলেন। মুসলিম বাহিনী তখন পিছনে উপত্যকায় ছিল। ১২ জন মুনাফিক যারা এতক্ষণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, তারা মুখোশ পরে দ্রুত এগিয়ে এসে ঐ গিরিসংকটে প্রবেশ করল এবং পিছন থেকে অতর্কিতে রাসূলকে হত্যা করতে উদ্যত হল। হঠাৎ পদশব্দে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) পিছন ফিরে তাকান এবং তার সঙ্গী হুযায়ফাকে ওদের ঠেকানোর নির্দেশ দেন। হুযায়ফা তার ঢাল দিয়ে ওদের বাহনগুলির মুখের উপরে আঘাত করেন। ‘তারা চেয়েছিল সেটাই করতে, যা তারা পারেনি’ (তওবাহ ৯/৭৪)।
তাবুক যুদ্ধের গুরুত্ব
(১) এই যুদ্ধে বিশ্বশক্তি রোমকবাহিনীর যুদ্ধ ছাড়াই পিছু হটে যাওয়ায় মুসলিম শক্তির প্রভাব আরব ও আরব এলাকার বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
(২) রোমকদের কেন্দ্রবিন্দু সিরিয়া ও তার আশপাশের সকল খৃষ্টান শাসক ও গোত্রীয় নেতৃবৃন্দ মুসলিম শক্তির সাথে স্বেচ্ছায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে আরব এলাকা বহিঃশক্তির হামলা থেকে নিরাপদ হয়।
(৩) শুধু অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি হিসাবে নয়, সর্বোচ্চ মানবাধিকার নিশ্চিতকারী বাহিনী হিসাবে মুসলমানদের সুনাম-সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দলে দলে খৃষ্টানরা মুসলমান হয়ে যায় এবং যা খেলাফতে রাশেদাহর সময় বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিজয়ে সহায়ক হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...