স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা




#মো. আবু রায়হান

আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে আলেম-উলামার অবদান অবিস্মরণীয়। আলেমদের ভুমিকা সেইভাবে লেখা হয়নি। বরং স্বাধীনতার পর আলেমদের সব সময় নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে । ‘আলেম-উলামা ও টুপি-দাড়ি’ মানেই স্বাধীনতাবিরোধী নয়! বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মশক্তিতে ইসলামের সর্বজনীন বিস্তরণে আলেমসমাজের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। অথচ অজ্ঞতাবশত অনেকে ধর্মপ্রাণ মানুষকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করে। একইভাবে নাটক-সিনেমার ‘খল চরিত্র’ হিসেবে পোশাকি ব্যবহার দুঃখজনক।স্বাধীনতার যুদ্ধে শরিক ছিলেন দেশের শ্রদ্ধাভাজন আলেম সমাজও। সৈয়দ আবুল মকসুদের ভাষায়, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আলেম-ওলামা ও মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ভূমিকা স্মরণীয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ঘাতক দালাল, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি অন্য এক প্রজাতি। তারা ঘৃণার পাত্র। আলেম-ওলামারা ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষেরই অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন।’ (সৈয়দ আবুল মকসুদের কলাম, ‘দ্য সুপ্রিম টেস্ট’, প্রথম আলো (০৭-০৪-১৩ ইং)। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর-সৈনিক শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ্, দুদু মিয়া, মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন বাঙালি (নোয়াখালী), আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর (রহ), আল্লামা আসআদ মাদানী (রহ), আল্লামা লুত্ফুর রহমান বরুণী (রহ.), চরমোনাইর পীর ইসহাক (রহ.), আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী (রহ.),আল্লামা কাজী মু. তাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্ল্যাহ (রহ.), আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ.),প্রমুখ ছিলেন দাড়ি-টুপিধারী আলেম। ১১ এপ্রিল ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামার সঙ্গে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, ‘যারা দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাদের বিরাট ভূমিকা ছিল। তারাই প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। কাজেই আজকে যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেখানে তাদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। কারণ সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকেই এ যাত্রা শুরু হয়। ’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৪/০৪/২০১৭)১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছিল, তখন বাংলার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মোহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন এবং প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা নামক গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ লিখেছেন, হাশেম-সোহরাওয়ার্দী ও কিরণ শংকরের স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবির বেশ আগেই মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী তার প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করেন। এ নিরিখে তাকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা বলা যেতে পারে।বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা তর্কবাগীশ প্রমুখ দেওবন্দী আলেমের সংগ্রামী ও দ্রোহী অবদানের ইতিহাস কি মিথ্যা? ৫৪"র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভোট যুদ্ধে সোহরাওয়ারর্দীর পাশাপাশি ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, মাওলানা সিদ্দীক আহমদ এবং মাওলানা আতহার আলীর কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে কি? ৬ দফা আন্দোলনের অকুতোভয় সেনানী মাওলানা ওলীউর রহমানের কথা কী মুছে যাওয়ার ? ১৯৭১ সালে অনেক হকপন্থী আলেম স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, অনেক আলেম সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। শহিদ হয়েছেন। অনেকে সরাসরি যুদ্ধ করেননি ঠিক তবে লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। মানুষকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেছেন।মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা প্রসঙ্গে তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান তার বিশ্লেষণে একটা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সেই সময়ে ইসলামপন্থী দল বা সামাজিক সংগঠনগুলোকে তাদের ঝোঁক বা অনুসৃত ধারা অনুসারে ভাগ করেছেন। তিনি তার বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভূমিকা ও প্রভাব গ্রন্থের ২২নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সেই সময়ে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা ছয় ধারায় বিভক্ত ছিলেন। ১. বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম ২. বিভিন্ন সাধারণ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম ৩. সরকারি-আধা সরকারি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক আলেম ৪. কওমি সাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক আলেম, ৫. বিভিন্ন খানকাহ, সিলসিলা ও পীর-মুরিদী সংশ্লিষ্ট আলেম ৬. ইমাম, মুয়াজ্জিন ও ব্যক্তি পর্যায়ের আলেম, এ ধারাগুলোর মধ্যে ইসলামপন্থী দলে জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের বাইরে আলেম সমাজের এক বিশাল অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেন। এদের মধ্যে অনেকেই রণাঙ্গনে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত হন। ড. তারেক এম তওফীকুর রহমানের ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেমসমাজ: ভূমিকা ও প্রভাব (১৯৭২-২০০১)’ শীর্ষক থিসিসে স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের অবদানগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে। ড. তারেকের গ্রন্থ থেকে জানা যায়,পূর্বপাকিস্তানের ৯০ শতাংশ আলেম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। ১০ শতাংশ আলেম রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও তারা বেশীরভাগই স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে নির্লিপ্ত অবস্থানে ছিলেন। মাত্র ৩ শতাংশ আলেম স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে এবং বিপক্ষে সক্রিয় ছিলেন। এর মাঝে ১.৬% থেকে ১.৮% আলেম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন বা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষ নেন আর ১.২% থেকে ১.৪% আলেম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করেন বা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ নেন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ( ১৮৮০ - ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬) - যিনি মওলানা ভাসানী নামেও পরিচিত। ছয় দশক ধরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁর আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। ছিলেন বিংশতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।ভাসানী মজলুম জননেতা হিসাবে সমধিক পরিচিত। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ- পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, যুবক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ভাষা আন্দোলনে লড়াই করেছে।"তিনি সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হকের যৌথ নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে।স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।ভোটের বাক্সে লাথি মারো; বাংলাদেশ স্বাধীন করো’—এমন দীক্ষায় জাতিকে উজ্জীবিত করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মুজিবনগর সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর তিনি সভাপতি মনোনীত হন। মহান মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকার জন্য দেরাদুনে ভারতীয় জেনারেল রুদ্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ‘প্রোফেট অব ইনডিপেনডেন্স’ আখ্যায়িত করেছিলেন।রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীরা অনেকে এজন্য তাকে "লাল মওলানা" নামেও ডাকতেন। তিনি কৃষকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টির করা জন্য সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। তিনি পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো।১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা পাকিস্তানি নির্যাতনের প্রতিবাদ করে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ডাক দেন।
মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ.)
মহান স্বাধীনতার পক্ষে লড়াকু সৈনিক মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ.)। তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মাইজবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ ডিগ্রি জামাত-ই-উলা পরীক্ষায় মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ.) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অংশগ্রহণ করে ৯৮ শতাংশ নম্বরসহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দর্শন, বিজ্ঞান, আইন ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।১৯৭১ সালে শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ.) সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন।

মাওলানা ওলীউর রহমান
বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করার পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরা ছয় দফাকে ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছিলো, তখন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মাওলানা ওলিউর রহমান বই লিখেছেন, ছয় দফা ইসলামবিরোধী নহে’, ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ছয় দফা’, ‘জয় বাংলা ও কয়েকটি স্লোগান’ ইত্যাদি। আলেমদের নিয়ে তিনি ছয় দফার পক্ষে সমাবেশ করেছেন, সেখানে অতিথি হিসেবে নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুকে। ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর বুলেটে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শাহাদাত বরণ করেন পেশায় হোমিও ডাক্তার মাওলানা অলিউর রহমান। শহীদ বুদ্ধিজীবী সৃতিসৌধের ফলকে নাম থাকা এ বীর সেনানির লাশ খুঁজে পাওয়া না গেলেও তিনি ‘এপিটাফ’ রচনা করে রেখে গেছেন :
আমায় তোরা দিস গো ফেলে হেলায় ভরে পথের ধারে
হয়তো পথিক করবে দোয়া দেখবে যখন কবরটারে।’
মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ
মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন আমাদের অন্যতম জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও নেতা ছিলেন তিনি। দীর্ঘ এক দশক আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ। ১৯২২ সালে উপমহাদেশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের রক্তাক্ত অধ্যায় ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা বিদ্রোহে’ নেতৃত্ব দেন সেদিনের তরুণ বিপ্লবী আবদুর রশীদ। তার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেদিন সলঙ্গা হাটে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশি নির্যাতনে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি কারাবরণ করেন। আব্দুর রশিদ ২৪৩ দিন আত্মগোপন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ যুদ্ধে অংশ নেয়, এবং এই কারণে পাকিস্তানী হানাদাররা তার বাড়ি-ঘর সব জ্বালিয়ে দেয়।তাঁর সম্পর্কে ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল্লাহ লিখেছেন, বাংলদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে (১৯৭১ খ্রি.) মাওলানা তর্কবাগীশ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি ‘ওলামা পার্টি’ গঠন করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন ওই পার্টির সভাপতি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে মাওলানা তর্কবাগীশ সভাপতিত্ব করেন। এখান থেকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তাঁর সভাপতিত্বেই সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার প্রমুখ নির্বাচিত হন—(রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা, পৃষ্ঠা নম্বর ২০৪)।১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদের প্রথম সভাপতি হিসেবে মাওলানা তর্কবাগীশ সর্বপ্রথম বাংলায় যে সংসদীয় কার্যপ্রণালি প্রবর্তন করেন তা আজও চালু আছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা পুনরায় চালু করে মাওলানা তর্কবাগীশের পরামর্শে। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসা শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে তিনি রাখেন নজিরবিহীন ভূমিকা। এ ছাড়া রেডিও ও টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াতের নিয়মও চালু করান তিনি।
মাওলানা আবুল হাসান যশোরী
একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুহাদ্দিস, রাজনীতিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি জামিয়া ইসলামিয়া গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় হাদিসের অধ্যাপক (শায়খুল হাদীস) হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং যশোর রেল স্টেশন মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ ও শায়খুল হাদীস হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এবং তার মাদরাসার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন। তার মাদরাসার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তার যশোর রেল স্টেশন মাদ্রাসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে। শহীদ হন ২১ জন। যাদের মধ্যে একজন সম্মানিত আলেম হাবীবুর রহমান, ৫ জন ছাত্র এবং বাকীরা ছিল ওখানে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা। মাদরাসা প্রাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর রয়েছে। ওই হামলায় যাশোরী গুলিবিদ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরে ১৯৯৩ সালে যশোরী ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা মুহাম্মদ কামরুজ্জামান চিশতী
পুরান ঢাকার জুরাইনের পীর হিসেবে যিনি পরিচিত। কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের “মা” উপন্যাসে আজাদের মা সফিয়া বেগম তার ছেলে আজাদকে এই পুরান ঢাকার জুরাইনের পীরের নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। জুরাইনের পীরের বহু মুরীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিল এবং জুরাইনের পীর সাহেব নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তথ্য সূত্র: আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।

মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর
যিনি হাফেজ্জী হুজুর নামে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত, ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।তিনি ১৯৮১ ও ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ১.৭৯% ভোট পেয়ে তৃতীয় এবং ১৯৮৬ সালে ৫.৬৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলেন। হযরত মাওলানা মুহম্মাদুল্লাহ্ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) সে সময় পরিষ্কার বলেছিলেন, 'এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ, পাকিস্তানিরা জালেম'। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও উলামায়ে কেরাম, সৈয়দ মবনু)।হাফেজ্জি হুজুরের এই কথা শুনে অনেক আলেম দেশের টানে ও নির্যাতিত নারীদের পাকিস্তানী হানদার বাহিনীর লালসার হাত থেকে বাঁচাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু নিজে হাফেজ্জি হুজুরের সাথে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল পরবর্তী সময়ে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর হাতে বায়আত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে হাফেজ্জী হুজুরের মতো রাজাকারের শিষ্যত্বে এলেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, হাফেজ্জী হুজুর রাজাকার ছিলেন না। একাত্তরের যুদ্ধ আমরা জালেমদের বিরুদ্ধে করেছি, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়।

শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান (রহ)
তিনি ছিলেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সর্বপ্রথম খতীব (১৯৬৪-১৯৭৪) ও বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফতী এবং বহু উচ্চ মানসম্পন্ন ইসলামী গ্রন্থাবলীর রচয়িতা ও সংকলক।আমীমুল এহসান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে সৌদিআরব পাঠিয়ে দেয়।দেশ স্বাধীন হবার পর শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ. বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসাবে নিযুক্ত করেন। (তথ্য সূত্র: শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান (রহ) এর জীবন ও কর্ম)।

মুফতি মাহমুদ
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ পাকিস্তানের সেক্রেটারি মুফতি মাহমুদ সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিলেন। ২৬ মার্চের আগে তিনি ঢাকায় এসে এ অংশের নেতাদের বলে দিয়েছিলেন, ‘আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলুন, দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করুন।’ মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সে সময় আমার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও যুবকদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।মুফতি মাহমুদ (রহ.) ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহইয়া-ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। (কাইদে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ, আশফাক হাশেমী/সাপ্তাহিক কওমী ডাইজেস্ট, মুফতি মাহমুদ নাম্বার, পাকিস্তান)।

ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহ)
আল্লামা তাজুল ইসলাম ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম ইসলামী ব্যক্তিত্ব, মুফাসসিরে কোরআন, মুহাদ্দিস, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, জাতীয় আজাদী আন্দোলনের অন্যতম বীর সৈনিক।ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় কওমি মাদরাসা জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন তিনি। তাকে মধ্যপ্রাচ্যের আলেমরা একনামে চিনতেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, তার ফতোয়া শুনে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার অনেক বড় বড় আলেম মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. তার নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। (তথ্য সূত্র: ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ও উনার সাথীবর্গ)।

মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারী
তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। এ ব্যপারে মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ.) এর নিজ ভাষায় বণিত কথাকেই এখানে উপস্থাপন করছি: তিন বলেন; একাত্তরে স্বধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে হযরত হাফেজ্জী হুজুর বলেছেন, জুলুম আর ইসলাম কখনও এক হতে পারে না। বাঙালিরা মজলুম ; সুতরাং বাঙালিদের পক্ষে কাজ করো। হযরতের এই কথার আলোকে আমি আমার ভাই সামসুল হক সাহেরব সাথে মুক্তিযোদ্ধে অংশ নেই। এবং এটাকে আমার জন্য গর্বের বিষয় বলেই মনে করি যে, দেশমাতৃকার টানে আমি নিজেকে কাজে লাগাতে পেরেছি এবং অত্যাচারী, দখলদারদের তাড়াতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি।পাকিস্তানিদের জুলুম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতিকে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্যক্তি মুজিবের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমি একমত না হলেও যুদ্ধকালীন তার অবদান এবং তার পক্ষ থেকে সোনার বাংলা শ্মশান কেন? আন্দোলনের পক্ষে গৃহীত কর্মসূচি আমার খুব ভালো লেগেছে। এ সময়টার নেতৃত্ব নিয়ে আমার সবচে’ আফসোস হলো- তখন কোনো একজন ইসলামি নেতা মজলুম বাঙালির পক্ষে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেননি। আমাদের আলেম সমাজের মাঝে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা নিজস্ব ভালো লাগার বশে কিংবা দেশ, মাটি ও মানুষের টানেই যুদ্ধ করেছেন।৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতিসত্বা রক্ষার্থে অত্যাচারী, স্বৈরাচারী পাকিস্তানিশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সেখানে ইসলামি বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার কোনো দখল ছিল না। সুতরাং এখানে ইসলামি কোনো বিষয় টেনে ওজর খাটানো নিতান্তই কাপুরুষত্বের পরিচয়। যাকে আমি বরাবরই নিন্দা জানিয়েছি, যে কারণে আমি একজন ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তখন আমার স্বগোত্রীয় অনেকের কাতারে দাঁড়াতে পারিনি। বরং স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের পথকেই আমি বেছে নিয়েছিলাম। আরেকটি বিষয় স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন মেজর জিয়া। তার ঘোষক হবার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি নিজের কানে শুনেছি, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।

মাওলানা মোস্তফা আজাদ
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধ আলেম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি মাওলানা মোস্তফা আজাদ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্রযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার বাবা ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর। স্থানীয় যুবক, ছাত্রদের নিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করতে গ্রামের মাঠে ট্রেনিং দিয়েছেন তিনি। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ধলগ্রাম ইউনিয়নের সাধুহাটি গ্রামের মাঠে ট্রেনিং সেন্টার খুলেছিলেন মোস্তফা আজাদের বাবা। মুক্তিযুদ্ধে তার যুদ্ধের এলাকা ছিল মেজর অব. জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯ নং সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা ও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল)।মোস্তফা আজাদের ছেলে আরজাবাদ লালকুঠি বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা জুলকারনাইন বিন আজাদ বাবার বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘একাত্তরে তিনি লালবাগ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছিলেন। তিনি ও লালবাগ মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় হত্যা চলছিল, জুলুম নির্যান চলছিল। আমার আব্বা মাওলানা মোস্তফা আজাদ ২৫ মার্চ রাতেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। মাওলানা মোস্তফা আজাদ ২০১৮ সালে ইন্তেকাল করেন।
হাফেজ ক্বারী ইউসূফ
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগামী আলেম-মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম হাফেজ ক্বারী ইউসূফ এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। একাধিক আলেম জানান, ক্বারী ইউসূফ আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকায় বসবাস করতেন। বেশ কিছু বছর ধরেই তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন।
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ
হাফেজ্জী হুজুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফেরার পর ১৯৬৩ সালে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব নেন।১৯৭১ সালে বায়তুল মুকাররমের মুয়াজ্জিন ছিলেন, অত্যন্ত কাছ থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে অবলোকন করেছেন,শিকার হয়েছেন পাকসেনাদের অত্যাচার-নির্যাতনের।প্রতিবাদ করেছেন বর্বরতার।গ্রেফতার হয়েছেন, হয়েছেন নির্যাতিত , তবুও দেশের জন্য লড়াই করেছেন।১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর জুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম এলাকাও।ক্ষুদ্র, অসহায় ব্যবসায়ীদের উপর পাক বাহিনী যখন জুলুম-নির্যাতন করছিল, তখন মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ বীরবিক্রমে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এবং সরাসরি পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন।এক পর্যায়ে পাকবাহিনী মাওলানার উপর ক্ষীপ্ত হয়ে তাকে বেধরক প্রহার করে রক্তাক্ত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে। তাকে যাত্রাবাড়ি আর্মি ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতন করেন।তবুও তিনি পিছ পা হননি।দমে যাননি। লড়ে গেছেন দেশের জন্য।মাটি ও মানুষের জন্য। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী
১৯৭১ সালে এ দেশের নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানীর (রহ.) সাহেবজাদা জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভার সদস্য হযরত আসআদ মাদানী (র.)।তাদের গণনির্যাতন বন্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধের সময় বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে বিশেষ করে তার নেতৃত্বে কলকাতায় যে সভা ও সেমিনারগুলো অনুষ্ঠিত হয়, সে ইতিহাস আজও ভাস্বর হয়ে আছে।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনের কাজ করেন মাওলানা আসআদ মাদানী।তাদের গণনির্যাতন বন্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধের সময় বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে বিশেষ করে তার নেতৃত্বে কলকাতায় যে সভা ও সেমিনারগুলো অনুষ্ঠিত হয়, সে ইতিহাস আজও ভাস্বর হয়ে আছে।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনের কাজ করেন মাওলানা আসআদ মাদানী।রাজধানী দিল্লিতে বিশাল মহাসমাবেশসহ ভারতজুড়ে প্রায় ৩০০টি সমাবেশ করেন তিনি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার অপরিসীম সহযোগিতা ও দেখাশোনা, গণনির্যাতন বন্ধ করার জন্য তার বিরামহীন দুঃসাহসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার প্রাপ্তিতে তার অবদান স্বাভাবিকভাবে তাকে স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারী দূতের মহিমা দিয়েছে।স্বাধীনতা যুদ্ধের একপর্যায়ে পাক-হানাদার বাহিনীর সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে দমন-পীড়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যখন কুখ্যাত সপ্তম নৌবহর এ উপমাহাদেশে যাত্রা করে, তখন মাওলানা আসআদ মাদানী (র.) পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক মুসলমানদের নিয়ে দিল্লির রাজপথে মিছিল করেন এবং তার নেতৃত্বে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করা হয়।তিনি ছিলেন ভারতের মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ও ১৮ আগস্ট কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তের কনভেশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দু’দফায় দুটি রেজুলেশন পাস করেন তিনি।এছাড়া মাওলানা আসআদ মাদানী (র.) পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এলাকায় বাংলাদেশীদের জন্য শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থা করেন এবং জমিয়তের পক্ষ থেকে নিয়মিত রিলিফ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। ১ অক্টোবর ২০১৩ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রাখায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক প্রদান করে বিরল সম্মানে ভূষিত করে। তার পক্ষে এ সম্মান গ্রহণ করেন তার মেজ ছেলে মাওলানা মওদুদ মাদানী। এ সম্মান সব দেওবন্দি ওলামা-মাশায়েখের এবং এ দেশের সব মাদ্রাসার।

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে
১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার গঠিত হলে মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাইদ জালালাবাদী, মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাইদ জালালাবাদী, খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় পেরিয়ে চলে যান ভারতে, যোগাযোগ করেন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তাঁরই নির্দেশনায় মাওলানা জালালাবাদী ভ্রাতৃদ্বয় ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে’ কোরআন তেলাওয়াত-তাফসির পরিচালনার মাধ্যমে ‘শব্দ সৈনিকে’র ভূমিকা পালন করেন।বিগত ৩০ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখক মুহাম্মদ ফায়জুল হক 'স্বাধীন বাংলা বেতারে আলেম মুক্তিযোদ্ধা' শিরোনামে লেখাতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নিরীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা স্বাধীন বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা আলেম মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি, মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ বিন সাঈদ জালালাবাদী ইসলামের দৃষ্টিতে অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং মানুষকে ইসলামের আলোকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতেন।গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন :‘‘বাংলাদেশের যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ঘোষিত হলো তা ইসলামহীন সেক্যুলারিজম নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইসলামসংক্রান্ত অনুষ্ঠান একটু বেশিই যেন প্রচারিত হতো। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে বিশেষ কিছুই হতো না। কিন্তু কেন তা হতো? তা হতো এ জন্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান শ্রোতার কাছে ইসলামী অনুষ্ঠানের বিশেষ আবেদন ছিল। যার বিশেষ আবেদন থাকে, তার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশ কি সেদিন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হতে চেয়েছিল নাকি অসাম্প্রদায়িক হতে চেয়েছিল? সেদিন বাংলাদেশের ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে বাঙালি জনগণ চেয়েছিল অতীতের সাম্প্রদায়িক বিষ ধুয়ে-মুছে একটি সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতিপূর্ণ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে—সেক্যুলার হতে নয়।’’ (সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত বেহাত বিপ্লব ১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১৩, পৃ. ২২৮)।২৬শে মার্চ ১৯৭১ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে কবি আবদুস সালামের কণ্ঠে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে প্রচারিত ঘোষণাটিও (মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বেসামরিক ঘোষণা) শুরু হয়েছিল ইসলামী রীতিতে ‘নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লিয়ালা রাসুলিহীল কারিম’ দিয়ে এবং শেষ হয়েছিল কোরআনের আয়াত ‘নাছরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব’-এর মাধ্যমে। একই দিনে কলকাতা বেতার স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য প্রচারিত হয়। যার পরিসমাপ্তি হয় এভাবে, ‘May Allah bless you and help in your straggle for freedom. JOY BANGLA.’ অর্থাৎ এই মুক্তিসংগ্রামে আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়া করুন এবং সাহায্য করুন। জয় বাংলা। (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, খণ্ড-৩, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, হাক্কানী পাবলিশার্স, ২০১০, পৃষ্ঠা ১১ ও ২৩২)

হাটহাজারী মাদরাসা
পাকিস্তানিরা সর্বপ্রথম সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছিল চট্টগ্রামে, আর আলেমদের এই অংশের মূল ঘাঁটি ছিল সেখানেই। উপমহাদেশের অন্যতম ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা এবং পটিয়া মাদরাসা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দুটো দুর্গ। বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার প্রথম প্রথম পটিয়া মাদরাসা থেকেই করা হয়েছিল। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার নিরাপদ আশ্রয় ছিল এ মাদরাসাটি।মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হাটহাজারী মাদরাসা এতটাই শক্ত অবস্থানে ছিল যে, যুদ্ধ যখন শেষ হলো, মাদরাসার নোটিশ বোর্ডে ঘোষণা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই কথা লিখে—কোনো রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের কেউ আজ থেকে এ মাদরাসায় অবস্থান করতে বা ভর্তি হতে পারবে না।
আলেমদের সাত সেক্টর
মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব রহ.। আল্লামা আশরাফ আলি থানভি (রহ) এর অন্যতম খলিফা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করে সংঘটিত হয়েছিল, তেমনি মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব রহমতুল্লাহি আলায়হিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা থানভিধারার ভক্ত-মুরিদানকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তৎপরতা চালানোর জন্য সাতটা সেক্টরে ভাগ করে দিয়েছিলেন। থানভি সিলসিলার বাইরের অনেক আলেমও এ তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বরিশালের চরমোনাইয়ের মূল পীর সৈয়দ এসহাক (রহ) । হযরত আবদুল ওয়াহহাব (রহ) গঠিত বরিশাল সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন চরমোনাইয়ের ভক্ত-মুরিদেরা। সৈয়দ এসহাক রহ.-এর জামাতা মাওলানা ইউসুফ সাহেবকে বিচারক নির্ধারণ করে স্থানীয় রাজাকারদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। স্থানীয় যারাই মানবতাবিরোধী অপরাধ করত, ইউসুফ সাহেবের কাছে তাদের ধরে নিয়ে আসা হতো। তিনি তাদের উপযুক্ত ও কঠোর বিচার করে দিতেন।

এ রকম আর অনেক আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ রয়েছেন যাদের অবদান বাংলার মানুষ ভুলেনি। হয়ত ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম নেই, কিন্তু তাদের নাম রয়েছে মাানুষের মনে।২৫ মার্চের পর সেই সময়ের বড় মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। এত কিছুর পরও কি কেউ বলবেন আলেম সমাজ স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন, স্বাধীনতার শত্রু ছিলেন? আসল সত্য হল হক্কানি আলেম সমাজ স্বাধীনতার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু ছিলেন। আলেম ওলামা স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। নীরবে নিভৃতে বহু আলেম মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পটিয়া মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন পটিয়া মাদরাসার মুহতামীম আল্লামা দানেশ রহ। এ ঘটনা জানতে পেরে পাক বাহিনী নির্বিচারে বোমা হামলা করে। শহীদ হন আল্লামা দানেশ (রহ) সহ আরো অনেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের লেখা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইটির ৫৪,৫৫,১০২ পৃষ্ঠায় এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।২নং সেক্টরের যোদ্ধা মেজর কামরুল হাসানের লেখা ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’ বইটিতে কুমিল্লার মুরাদনগরের কাশিমপুরের পীর এবং বরিশালের মরহুম চরমোনাইয়ের পীর এসহাক রহমাতুল্লাহর নাম উল্লেখ করেছেন। যারা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং এ দেশের মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে অনেক আলেম কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শাহখুল হাদিস মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ (রহ.) প্রিন্সিপাল, মালিবাগ মাদ্রাসা, ঢাকা, শায়খুল হাদিস মরহুম তাজাম্মুল আলী সিলেট, মাওলানা আবুল হাসান যশোরী (রহ.), ময়মনসিংহের মরহুম মাওলানা আরিফ রাব্বানী, মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ, ঢাকা, মুফতি নুরুল্লাহ বি-বাড়িয়া, মরহুম মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, ঢাকাসহ প্রমুখ আলেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদিস কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ্‌র ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহর ভূমিকায় খুশি হয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রওশন আলী তাঁকে প্রশংসাপত্র ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ প্রদান করেছিলেন।একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধা ছাগলনাইয়ার মাওলানা মাকসুদ ভূঁইয়া, হাতিয়ার মাওলানা মোস্তাফিজ, চট্টলার কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন।মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ী জেলখানায় আটক বিহারীদের জয় বাংলার পক্ষে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ করায় প্রাণ দিতে হয়েছিল মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী দখলের পর বিহারীরা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর তার পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে বলে, ‘আভি শালা জয় বাংলা বোলো’। (দৈনিক সংগ্রাম ৭/১১/২০১৫)নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অমর সৃষ্টি ‘জোসনা ও জননীর গল্প’। এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোনো এক স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম মওলানা ইরতাজ আলী কাসিমপুরী, যিনি কাহিনিসূত্রে পূর্বাপর আলোচিত। তিনি পাকিস্তানি আর্মির অন্যায় ‘ধর্মান্তর’ প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ করে পরাধীন দেশে জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের ফলে নির্মমভাবে শহীদ হন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে হুমায়ূন আহমেদ এ তথ্য পেয়েছেন।
লুৎফুর রহমান বর্ণভী (১৯১৬ – ১৯৭৭) ছিলেন একজন বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত,লেখক, সম্পাদক ও ইসলামি বক্তা। তিনি হুসাইন আহমদ মাদানির শিষ্য ছিলেন। তিনি অরাজনৈতিক ইসলামি সংঘটন আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও জামিয়া লুৎফিয়া আনওয়ারুল উলুম হামিদনগর বরুণা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। লুৎফুর রহমান বর্ণভী ১৯১৬ সালে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানাধীন বরুণা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল হামিদ ও মাতা হালিমা। পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে কিছুকাল গাছবাড়ি জামিউল উলুম মাদ্রাসায় পড়ার পর ১৯৩৪ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ চলে যান। দেওবন্দে তিনি দাওরায়ে হাদিস (স্নাতক) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি হুসাইন আহমদ মাদানির হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং খেলাফত লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মৌলভীবাজারে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে ১০ বছর শিক্ষকতা করে তিনি নিজ গ্রাম বরুণায় জামিয়া লুৎফিয়া আনওয়ারুল উলুম হামিদনগর বরুণা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪০ এর দশকে তিনি তদানীন্তন ভারতের মুসলমানদের ঐক্য ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের প্রতিবাদে পল্টন ময়দানে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৭৭ সালের ১৭ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল