আন্দালুসিয়ান প্রতিভা
মো.আবু রায়হানঃআন্দালুসিয়া মধ্যযুগে মুসলিম শাসিত ইবেরিয়ান উপদ্বীপ বোঝানো হয়। বর্তমানে এটি স্পেন ও পর্তুগালের অংশ।সংক্ষিপ্তকালের জন্য ফ্রান্সের দক্ষিণের সেপ্টিমেনিয়া অঞ্চল এর অংশ ছিল এবং এটি পশ্চিম ইউরোপ ও ইতালিকে সংযুক্ত করেছিল। পুরো ইবেরিয়ান উপদ্বীপকে বোঝানো হলেও রিকনকোয়েস্টা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে এর সীমানা পরিবর্তন হয়েছে। ৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত এর আয়ুষ্কাল ধরা হয়।।অষ্টম শতকের প্রারম্ভে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর মধ্যযুগের প্রায় পুরোটা জুড়েই মুসলিমরা আন্দালুসিয়ার মূল শাসক ছিলেন । ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা স্পেন বিজয়ের দুই থেকে ৩০০ বছরের মধ্যেই স্পেনের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মুসলমান হয়েছিল; যা সংখ্যায় ৫০ লাখেরও বেশি। যাদের বেশির ভাগই স্পেনের স্থানীয় অধিবাসী ছিল। তাঁরা স্পেন শাসন করেন ৭৮০ বছর।বর্তমান ইউরোপের প্রবেশদ্বার জিব্রাল্টার থেকে কর্ডোবা, গ্রানাডা, মালাগা, আলমেরিয়া, সারাগোসা, টারাগোনা, বার্সেলোনা, টলেডো বর্তমান রাজধানী মাদ্রিদের নিকটবর্তী শহর এবং পিরেনিজ পর্বতমালা পর্যন্ত গোটা স্পেন ছিল মুসলমানদের বিজিত। আর সে সময়ে আন্দালুসিয়ার রাজধানী কর্ডোভা ছিল মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান।মুসলিম স্পেন অনগ্রসর ইউরোপে সভ্যতার আলো পৌঁছে দেয়। ইউরোপের ভাষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ ও রাজনীতিকে মুসলিমরা নানাভাবে প্রভাবিত করে। ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বলেন, ‘মুসলিম স্পেন মধ্যযুগীয় ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়গুলো লিখেছে।’ (ড. মুহাম্মদ ফরিদুদ্দিন ফারুক, স্পেনে মুসলিম ইতিহাস ও কীর্তি, পৃষ্ঠা. ৩১৩)। মুসলিম স্পেন যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন তখন ইউরোপ অজ্ঞতা-বর্বরতায় নিমগ্ন। লেনপুল উল্লেখ করেছেন : All Europe was then plunged in barbaric ignorance and savage manners’ তখন গোটা ইউরোপ বর্বর অজ্ঞতা ও বুনো ব্যবহারে নিমজ্জিত ছিল।আরবি ভাষা-সাহিত্য ও ধর্মীয় জ্ঞানের মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু হলেও ক্রমেই তার পরিধি বিস্তৃত হয়।আধুনিক দর্শন, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, উদ্ভিদ , প্রাণিবিজ্ঞান, রসায়ন,ও পদার্থবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মুসলিমরা।এছাড়া ধর্মীয় জ্ঞানের বহু শাখার বিস্তার ঘটে। হাদিস, ফিকাহ, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, কালাম, স্থাপত্য, মৃৎশিল্প, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদির ব্যাপকভাবে চর্চা হয়েছিল। মুসলিম শাসিত স্পেনকে বলা যায় মধ্যযুগে ইসলামী ভূখণ্ড ও ইউরোপের মধ্যকার সাংস্কৃতিক বিনিময়ের উন্মুক্ত দ্বার। স্পেনের মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে যারা ছিলেন-
ইবন রুশদ
আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবন রুশদ (১৪ এপ্রিল ১১২৬- ১১ ডিসেম্বর, ১১৯৮) ল্যাটিন নাম আভিরোস।ইবন রুশদ স্পেনের কর্ডোবায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার শহরের লোকপ্রসাশন সংক্রান্ত কাজ, বিশেষত বিচার ও ধর্মীয় বিষয়ে জড়িত থাকার কারণে সুপরিচিত ছিলো। তাঁর পিতামহ আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ (মৃত্যুঃ১১২৬)আল মোরাভি কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি(কাজি) একর্ডোবার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ছিলেন।তাঁর পিতা আবুল কাসিমও পরবর্তীতে কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি ছিলেন,১১৪৬ সালে আল-মোহাদ রাজবংশ আল-মোরাভিদের স্থলাভিষিক্ত হলে তাকে পদচ্যুত করা হয়।তার জীবনীকারদের মতে ইবন রুশদের শিক্ষাজীবন ছিলো অনন্যসাধারণ। হাদিসশাস্ত্র(নবী মুহম্মদ সা. এর আদর্শ) হতে শুরু করে, ফিকহ(ইসলামী বিচারব্যবস্থা), চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন।তিনি মালিকি ফিকহ শিখেছিলেন আল-হাফিজ আবু মুহম্মদ ইবন রিযক এর কাছে, হাদিসশাস্ত্রের পাঠ নিয়েছেন তাঁর পিতামহের এক শিষ্যের কাছে। তাঁর পিতামহও তাকে ফিকহ এর জ্ঞান দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ইমাম মালিকের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম মুয়াত্তার পাঠ দিয়েছিলেন। তিনি আবু-জা'ফর জারিম আল-তাজাইল এর নিকট চিকিৎসার জ্ঞান লাভ করেন, যিনি সম্ভবত তাঁকে দর্শন এর দীক্ষাও দিয়েছেন। তিনি দার্শনিক ইবন বাজা এর লেখনীর সম্পর্কেও অবগত ছিলেন, খুব সম্ভবত তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন অথবা তাঁর ছাত্রত্বেও থেকে থাকতে পারেন। তিনি নিয়মিতই সেভিল এ অনুষ্ঠিত দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ ও কবিদের সভায় উপস্থিত থাকতেন, এ সভা সেসময়কার বিখ্যাত দার্শনিক ইবন তুফায়েল ও চিকিৎসাবিদ ইবন যুহর অংশগ্রহণ করতেন। তিনি আশ'আরী মতের কালাম ধর্মতত্ত্ব পড়েছিলেন, যার সমালোচক হিসেবে পরবর্তী জীবনে তিনি অবতীর্ণ হন।
১১৬৯ সালে তাকে খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, যিনি ইবন রুশদের প্রতিভায় বিমোহিত হন। তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিয়োজিত হন এবং ইবন রুশদের বিভিন্ন গবেষণা কর্মে সাহায্য করেন। ইবন রুশদ পরবর্তীতে সেভিল এবং কর্ডোবায় বেশ কয়েকবার প্রধান বিচারপতির পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১১৮২ সালে তিনি রাজ চিকিৎসক এবং কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।.১১৮৪ সালে আবু ইউসুফের মৃত্যুর পরেও তাঁর রাজসভার সুদৃষ্টি বজায় থাকে, তবে ১১৯৫ সালে তিনি রাজসভার রোষে পতিত হন। তাঁর প্রতি বেশ কিছু অভিযোগ ছিলো—খুব সম্ভবত এর নেপথ্যে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিলো—এবং এ কারণে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।.১১৯৮ সালে, তাঁর মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বেই তাঁকে আবার সসম্মানে রাজসভায় ফিরিয়ে আনা হয়। একজন মুসলিম আন্দালুসীয় বহুবিদ্যাবিশারদ এবং আইনবিদ যিনি দর্শন ধর্মতত্ত্ব চিকিৎসাবিজ্ঞান জ্যোতির্বিজ্ঞান পদার্থবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান গনিত ইসলামি আইনশাস্ত্র এবং ভাষাবিজ্ঞানসহ বহু বিষয়ে লিখেছেন।তিনি শতাধিক বই এবং গবেষণাপত্রের রচয়িতা।তাঁর জীবনীকারক মজিদ ফখরি্র মতে তাঁর প্রাচ্যের পূর্বসূরীদের যে কারো তুলনায় তাঁর কাজ বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিচিত্ররকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করে- এর মধ্যে আছে দর্শন, ঔষধ-পথ্য, আইনবিদ্যা অথবা আইনতত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞান। প্রাচ্যবিদ আর্নেস্ট রেনান এর মতে ইবন রুশদের অন্তত ৬৭ টি স্বতন্ত্র রচনা বিদ্যমান; তন্মধ্যে ২৮ টি দর্শন, ২০ টি চিকিৎসাবিদ্যা, ৮ টি আইনবিদ্যা, ৫ টি ধর্মতত্ত্ব ও ৪ টি ব্যকরণ নিয়ে, এর সাথে আছে অ্যারিস্টটলের সিংহভাগ কাজের উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্লেটোর রিপাবলিক এর উপর বক্তৃতা।
ইবনে তোফায়েল
মুহাম্মদ বিন আবদুল মালিক বিন তোফায়েল (আনুমানিক ১১০৫ – ১১৮৫) গ্রানাডায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ইবনে তোফায়েল একাধারে একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, চিকিৎসক, উজির ও দরবারের কর্মকর্তা ছিলেন। ১১৬৩-১১৮৪ সাল পর্যন্ত ইবনে তোফায়েল মরক্কো ও স্পেনের সুলতান আবু ইয়াকুব ইউসুফের একজন মন্ত্রী ও চিকিত্সক হিসাবে কাজ করেন। এ সময়ে তিনি কবিতা, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে প্রচুর অবদান রাখেন। ১১৬০ বা ১১৭০ সালে ইবনে তোফায়েল ‘হাই ইবনে ইয়াকজান’ নামক বিখ্যাত উপন্যাসটি লিখেন। ১১৬৯ বা ১১৮২ সালে ইবনে তোফায়েল সুলতান আবু ইয়াকুব ইউছুফের দরবারে ইবনে রুশদকে আমন্ত্রণ করেন। এবং এরিস্টটলের বইগুলো ব্যাখ্যা করার জন্যে ইবনে রুশদকে অনুরোধ জানান। ইবনে রুশদ-এর বইগুলো ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। ১১৮৫ সালে ইবনে তোফায়েল মরক্কোতে মৃত্যু বরণ করেন।
প্রথম দার্শনিক উপন্যাস হাই ইবনে ইয়াকজান রচনার জন্য তিনি অধিক সমাদৃত। পাশ্চাত্য জগতে এটি ফিলোসফিকাল অটোডিডাকটাস নামে পরিচিত। মরদেহ ব্যবচ্ছেদের সমর্থক প্রথমদিককার চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি তা উপন্যাসে উল্লেখ করেন। হাই ইবনে ইয়াকজান’ আজ থেকে ৯০০ বছর আগের অর্থাৎ ১২ শতকে লেখা একটি উপন্যাস। এটি বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম দর্শনভিত্তিক উপন্যাস। ১২ শতকের উপন্যাস হলেও এই বইটি ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে (১৬৫০-১৮০০) প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিলো। যেসব বই ইউরোপে বিজ্ঞান বিপ্লব এবং ইউরোপকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল সেসব বইয়ের মধ্যে এই বইটি অন্যতম।
ইবনে খালদুন
ওয়ালী আল-দ্বীন আবদ আল-রাহমান ইবন মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবি বকর মুহাম্মদ ইবন আল-হাসান ইবন খালদুন (মে ২৭, ১৩৩২ খ্রিষ্টাব্দ – মার্চ ১৯, ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ) তিউনিসিয়ার তিউনিস শহরে তাঁর জন্ম। খালদুন হচ্ছে তার বংশগত উপাধি । তিনি ছিলেন একজন আরব মুসলিম পণ্ডিত।আমরা ছিলাম ইয়েমেনি আরব। স্পেন বিজয়ের শুরুর দিকে কারমোনায় (দক্ষিণ-পশ্চিম স্পেনের একটি জায়গা) চলে আসে আমার পরিবার। সেখান থেকে যায় সেভিল। একপর্যায়ে আমাদের পরিবার সেভিলের নেতৃস্থানীয় পরিবারগুলোর একটি হয়ে যায়। পরের চার শতক ধরে পরিবারের সদস্যরা উমাইয়া, আলমোরাবিয়া ও আলমোহাদ (মরক্কান) রাজবংশের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদ অধিকার করেছিলেন। পরিবারের অনেক সদস্য ছিলেন সেনাবাহিনীতেও। কেউ কেউ আল জালাকা (১০৮৬) যুদ্ধে শহীদও হয়েছেন। এই যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে খ্রিস্টানরা পরাজিত হয়। খ্রিস্টানদের স্পেন পুনর্দখল অভিযান ব্যাহত হয়। তবে ১২৪৮ সালে সেভিল ও করডোভার পতন ঘটে। পতনের ঠিক আগে আগে খালদুন পরিবার মরক্কোর উত্তর তীরের সাবাতায় (তিউনিসিয়ার কাছে) চলে গিয়েছিল। স্পেন থেকে আসা শরণার্থীরা স্থানীয় লোকজনের তুলনায় অগ্রসর ছিল। তাই খালদুন পরিবারের সদস্যরাও তিউনিসিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ লাভ করেন। আমার বাবা সেনাদলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তবে তিনি ধর্মতত্ত্ব, আইন ও ভাষা শিক্ষায় বেশি আগ্রহী ছিলেন বলে কর্মজীবন ত্যাগ করেন, বিশেষ করে তাঁর আরবি জ্ঞান ছিল অসাধারণ। কবিতা খুব ভালো বুঝতেন। আমার মনে আছে, অনেক বিতর্কিত বিষয়ে লোকজন তাঁর পরামর্শ চাইতে আসত। যা-ই হোক, ১৩৪৯ সালে আফ্রিকা ও ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই রোগে আমার মা-বাবাও মৃত্যুবরণ করেন।’ আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন ইবনে খালদুন।আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও অর্থনীতির জনকদের মধ্যে তিনি অন্যতম বিবেচিত হন।
আরবি ভাষাতত্ত্ব ছিল তাঁর অধ্যয়নের অন্যতম বিষয়। কোরআন, হাদিস, শরিয়া (আইন), ফিকাহও (দর্শন) পড়েছেন। সে সঙ্গে তিলিমসানের (উত্তর-পশ্চিম আলজেরিয়ার অঞ্চল) দার্শনিক ও গণিতবিদ আল-আবিলির কাছে গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন শেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তিনি আবু রুশদ, ইবনে সিনা, আল-রাজির কাজ নিয়েও পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। ২০ বছর বয়সে খালদুন তিউনিসিয়ার শাসক ইবনে তাফরাকিনের দরবারে ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ নেন। দরবারের কাজকর্মের বিবরণ লিখে রাখতেন। ১৩৫২ সালে কনস্টানটিনের সুলতান আবু জিয়াদ তিউনিস দখল করে নিলে খালদুন তাঁর শিক্ষক আবিলিকে অনুসরণ করে ফেজে (মরক্কোর একটি শহর) চলে যান। সেখানে তিনি রাজকীয় ফরমান লেখার কাজ পান। তবে রাজার কথা ঠিকমতো মেনে না চলার কারণে তিনি ২২ মাস কারাগারে বন্দি ছিলেন। এভাবে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে খালদুন সময় অতিবাহিত করেছেন। জীবনের শেষ দিকটা কাটিয়েছেন মিসরে। পড়িয়েছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও। তাঁর একজন যোগ্য শাগরেদের নাম আল মকরিজি।
ইবনে খালদুন তাঁর বই মুকাদ্দিমার জন্য অধিক পরিচিত। মুকাদ্দিমা তিনি লিখেছেন ১৩৭৭ সালে। মুকাদ্দিমা অর্থ সূচনা। যদিও এই গ্রন্থটি তার পরিকল্পিত বিশ্ব ইতিহাস কিতাব আল-ইবারের ভূমিকা হিসেবে তিনি রচনা করেন, তথাপি এটি বিশ্বব্যাপী একটি স্বতন্ত্র রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।অনেক আধুনিক চিন্তাবিদ মুকাদ্দিমাকে ইতিহাসের দর্শনগ্রন্থ হিসেবে দেখতে চান। অনেকে বলেন, এটি সমাজবিজ্ঞানের প্রথম বই।
১৬ ও ১৭ শতকের অটোমান পণ্ডিতরা খালদুনের কাজে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আঠারো শতকে মুকাদ্দিমার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুর্কি ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯ শতকের ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই বইয়ের গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং ইবনে খালদুনকে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করতেন।মুকাদ্দিমা ১৮৬০ সালে ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়।
আল বাকরি
আল বাকরি তাঁর পুরো নাম ‘আবু উবাইদ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আর বাকরি।সহজভাবে আল-বাকরি (১০৪০–১০৯৪) ছিলেন আরব আন্দালুসীয় ঐতিহাসিক এবং মুসলিম ভূগোলবিদ। আল বাকরি সেখানে হুলেভাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাকর আরব উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল-মুতাদিদ দ্বারা তাঁর পিতাকে পদচ্যুত করার পরে তিনি কর্ডোবাতে চলে আসেন, যেখানে তিনি ভূগোলবিদ আল-উদ্রি এবং ইতিহাসবিদ ইবনে হাইয়ানের সাথে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি তাঁর পুরো জীবন আন্দালিয়াসে কাটিয়েছেন, বেশিরভাগ অংশ সেভিল এবং আলমেরিয়ায় । তিনি যা লিখেছেন সেখানে কখনও ভ্রমণ না করে লিখতেন না। তিনি কর্ডোবায় মারা যান।
আল-বাকরি ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং আরব উপদ্বীপ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি ভূগোলবিষয়ক মুজাম মা ইসতাইজম ও আল মাসালিক ওয়াল মামালিক নামে দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন।তাঁর মুজাম মা ইসতাইজমে বেশিরভাগ আরব উপদ্বীপে জায়গাগুলির নামের একটি তালিকা রয়েছে যা ভৌগলিক পটভূমির পরিচয় দেয়। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল তাঁর কিতাব আল-মাসালিক ওয়াল-মামালিক । এটি ১০৬৮ সালে সাহিত্য এবং ব্যবসায়ী এবং ভ্রমণকারীদের রিপোর্টের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল, মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আল-ওয়ারাক (৯০৪-৯৭৩) এবং আব্রাহাম বেন জ্যাকবসহ। এটি পশ্চিম আফ্রিকার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্স এবং ঘানা সাম্রাজ্য, আলমোরাভিড রাজবংশ এবং ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। যদিও ইউসুফ আল-ওয়ারাকের কাছ থেকে ধার নেওয়া উপাদানটি দশম শতাব্দীর সময় থেকে শুরু হয়েছিল, তবুও তিনি তাঁর রচনাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া ইভেন্টগুলির তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
আল মাজিনি
স্পেনীয় ভূগোলবিদদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ভূগোলবিদ ছিলেন আল মাজিনি। তিনি ১০৮০ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডায় জন্মগ্রহণ করেন। স্পেন থেকে নিয়ে আফ্রিকা, দামেস্ক, আরদবিল, কাস্পিয়ান সাগরের উপকূল, দারবান্দ, খাজারদের ইত্যাদি এলাকায় তিনি সফর করেছেন এবং সফরের বিস্তারিত বিবরণ কিতাব আকারে তুলে ধরেছেন। তাঁর সেই বিখ্যাত কিতাবের নাম ‘নুখবাত আল আধান ফি আজাইব আল বুলদান’। উল্লেখযোগ্য একটি সময় তিনি খুরাসানে অধ্যাপনায় কাটিয়ে দেন এবং ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন।
ইবনে জোবায়ের
ইবনে জোবায়ের (১ সেপ্টেম্বর ১১৪৫–১২১৭ ) ছিলেন আল আন্দালুসের একজন ভূগোলবিদ, পর্যটক ও কবি। তিনি ১১৯২ সালে মক্কা শরীফ ও ইরাক ভ্রমন করে একটি ভ্রমন কাহিনী লিখেন যার নাম রিহলাত-উল-কিনানী।তার ভ্রমণকাহিনীতে তৃতীয় ক্রুসেডের কয়েকবছর পূর্বে ১১৮৩ থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত তার হজ্জ যাত্রার বর্ণনা রয়েছে। তার বর্ণনায় মিশর ও লেভান্টে সালাউদ্দিনের শাসনের বর্ণনা রয়েছে। মক্কা যাওয়ার সময় তাকে এসব স্থান অতিক্রম করতে হয়। উপরন্তু তার ফিরতি পথে তিনি খ্রিষ্টান সিসিলির মধ্য দিয়ে যান। এক শতাব্দী পূর্বে তা মুসলিমদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়। তিনি সেখানকার উন্নত মিশ্র সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করেন।
ইবনে আব্বাস জাহরাভি
আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আল আব্বাস আল জাহরাভি (৯৩৬–১০১৩) ছিলেন আন্দালুসবাসী একজন আরব মুসলিম চিকিৎসক।ল্যাটিনে অল বুকাসিস নামে পরিচিত। একাদশ শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ ইবনে আব্বাস জাহরাভি শল্যচিকিৎসায় আশ্চর্য নৈপুণ্য।তাকে মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে মহৎ শল্যবিদ তার শল্যচিকিৎসা প্রণালি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ছিল। ইবনে আব্বাস জাহরাভিকে আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে গণ্য করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে তার লেখা বইয়ের নাম কিতাবুল তাসরিফ। এটি চিকিৎসা সংক্রান্ত ৩০ খন্ডের বিশ্বকোষ। শল্যচিকিৎসার প্রক্রিয়া ও যন্ত্র নিয়ে তার অবদান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আধুনিক কালেও প্রভাব ফেলেছে। কিছু কিছু বিষয়ে এখনও ব্যবহার করা হয়। তাঁর রচিত মেডিকেল এনসাইকোপিডিয়া গ্রন্থটি ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়ে বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপে সমাদৃত ছিল।চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম এক্টোপিক গর্ভধারণ নিয়ে বর্ণনা করেছেন। হায়মোফিলিয়াকে তিনি সর্বপ্রথম বংশগত বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন।
আব্বাস ইবনে ফিরনাস
আব্বাস ইবনে ফিরনাস (৮১০-৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন বার্বার বংশদ্ভূত আন্দালুসিয় মুসলিম পলিমেথ বা বহুশাস্ত্রবিশারদ। তার আসল নাম আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি। তিনি প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, সুরকার, পদার্থবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ , জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও আরবি সাহিত্যের কবি । তাকে বলা হয় বিমান এবং বিমানের পিতা। ইবনে ফিরনাস প্রথম মানব বহনকারী গ্লাইডার তৈরি করেছিলেন এবং দু'টি সফল উড়ানের চেষ্টা করেছিলেন। তার উড্ডয়ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে. হিট্টি তার হিস্ট্রি অব আরব গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ইবনে ফিরনাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি আকাশে ওড়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিকভাবে।
তিনি আন্দালুসের ইযন-রেন্ড ওন্ডায় (বর্তমান স্পেনের রন্ডা) জন্মগ্রহণ করেন এবং কর্ডোবা আমিরাতে বসবাস করতেন। উড্ডয়নের প্রচেষ্টার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত।চাঁদে ইবনে ফিরনাস গহ্বরটি ইবনে ফিরনাসের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ইবনে ফিরনাস আল-মাকাতা নামক জলঘড়ির নকশা করেন। এছাড়াও তিনি স্বচ্ছ কাচ নির্মাণের জন্য যন্ত্রের নকশাও প্রণয়ন করেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য প্ল্যানিস্ফিয়ার নামক যন্ত্র ও পাঠের উপযোগী লেন্স প্রস্তুত করেন। গ্রহ নক্ষত্রের ঘূর্ণন প্রদর্শনের জন্য কার্যকর মডেলও তিনি প্রস্তুত করেন। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল পাথরের স্ফটিককে কাটার প্রক্রিয়া। তার এই আবিষ্কারের ফলে স্পেন কোয়ার্টজ কাটার জন্য মিশরের উপর নির্ভরশীলতা থেকে রেহাই পায়। ইতিপূর্বে স্পেন এই ব্যাপারে মিশরের উপর নিভরশীল ছিল।
আকাশে উড়ার প্রচেষ্টার জন্য তিনি অধিক পরিমাণে পরিচিত। বলা হয় তিনি একজোড়া পাখার মাধ্যমে আকাশে উড়েছিলেন। এই বিষয়ে একমাত্র মরোক্কান ইতিহাসবিদ আহমেদ মোহাম্মদ আলমাক্কারীর(আনুমানিক ১৫৭৮–১৬৩২) লেখায়। তিনি প্রায় সাত শতাব্দী পরে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। আলমাক্কারীর লেখা অনুযায়ী:"তার অন্যান্য আগ্রহ উদ্দীপক পরীক্ষাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, তিনি উড়ার চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তিনি নিজেকে পালকে আবৃত করে নেন এবং শরীরে একজোড়া পাখা যুক্ত করেন। এরপর উচুতে উঠে শুন্যে ঝাপিয়ে পড়েন। যেসব নির্ভরযোগ্য লেখক এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তাদের মতে তিনি প্রায় পাখির মতই গ্রহণীয় মাত্রার দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম হন। উড্ডয়নের স্থানে অবতরণের সময় তিনি পিঠে মারাত্মকভাবে আঘাত পান। এর কারণ, পাখিরা অবতরণের সময় লেজের ব্যবহার করে যা তিনি করেননি।
ইবনে ফিরনাস মানুষের উড্ডয়নের ইতিহাসে কিংবা আকাশে ওড়ার পেছনে মানুষের যে প্রচেষ্টা তার একজন সফল স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে স্বরণীয় হয়ে আছেন। তার প্রচেষ্টাকে বলা যায় আধুনিক উড়োজাহাজ আবিষ্কারের প্রথম ধাপ। মানুষকে ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন দেখানো ইবনে ফিরনাস তাই ইতিহাসে অমর ।
আল কুরতুবি,
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আবু বকর আল আনসারি আল কুরতুবি ছিলেন ছিলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, সাহিত্যিক ও ফিকাহবিদ।নাম মুহাম্মদ, উপনাম, আবু আবদুল্লাহ, পিতার নাম আহমদ, দাদার নাম আবু বকর, নেসবতি নাম আনসারি, খাজরাজি। উপাধি কুরতুবি। স্পেনের কর্ডোবায় জন্মগ্রহণ করেছেন বলে তাঁকে কুরতুবি বলা হয়। ইমাম কুরতুবি ১৩শ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। ১২৩০ সালে স্প্যানিশ আক্রমণের সময় তার বাবা মারা যান। তরুণ বয়সে কুরতুবি পাত্র তৈরির জন্য তার পরিবারে মাটি আনার কাজ করেছেন। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ইমাম মালিক (রহ.)-এর অনুযায়ী তখন বেশি ছিল। ফলে স্পেনের বেশির ভাগ মুসলমান মালিকী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। এ হিসেবে ইমাম কুরতুবি (রহ.)ও মালিকী মাজহাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
১২৩৬ সালে রাজা প্রথম ফার্নান্ডো কর্ডোবা দখল করে নিলে তিনি মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়া চলে যান। সেখানে তিনি হাদিস ও তাফসীর অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি কায়রো যান এবং মুনিয়া আবিল খুসাবে বসবাস শুরু করেন। বাকি জীবন তিনি এখানে অতিবাহিত করেছেন।
তাফসীর, হাদিস, তিলাওয়াত ও ফিকহে ইমাম কুরতুবি দক্ষতা অর্জন করেন যা তার লেখায় ফুটে উঠেছে।তাফসীর আল কুরতুবি নামক কুরআনের তাফসির গ্রন্থের জন্য তিনি বেশি পরিচিত।তফসীর আল-কুরতুবী শাস্ত্রীয় পন্ডিত আল-কুরতুবি রচিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি কুরআনের তাফসীর। এটি তাফসির আল কুরতুবী আল জামিয়ালি-আহকাম বা আল-জামি 'লি আহকাম আল-কুরআন বা তাফসির আল জামি নামেও পরিচিত তা ২০ খণ্ডে বিভক্ত।এই তাফসিরের মূল উদ্দেশ্য ছিল কুরআন থেকে আইনত নির্দেশ ও বিধি-নিষেধগুলি নির্ধারণ করা, এটি করার সময় আল-কুরতুবী আয়াতগুলির ব্যাখ্যা, কঠিন শব্দের উপর গবেষণা, বর্ণনামূলক চিহ্নের আলোচনা এবং শৈলী ও রচনার কমনীয়তা ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। বইটি বহুবার পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। অনেক পন্ডিত তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ কর্মের প্রশংসা করেন।
ইমাম কুরতুবি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন অসংখ্য অমূল্য রচনা সম্ভার। তার মধ্যে প্রসিদ্ধ কিছু হলো— ১.আল আসনা ফি শরহে আসমায়িল্লাহ হিল হুসনা। ২.আত তাসকিয়া বি আহওয়ালিল মাওতা ওয়া উমুরিল আখিয়াহ।৩.আত তাজ কার বি আফদালিল আজকার। ৪. কামউল হারসি বিজ জুহদি ওয়াল কানাআতি ওয়া রাদ্দি জিল লিস সাওয়াল বিল কুতুবি ওয়াশ শাফায়াতি। ৫. শারহুত তাকাসি। ৬. আরজুযাহ ফি আসমায়িন নবী (সা.)। ৭. আত তাকরির লি কিতাবিত তামহিদ। ৮. আল মুকতাবাস ফি শারহি মুয়াত্তা মালিক ইবন আনাস। ৯. আল লামউল লু’লুবিয়া ইত্যাদি। নিজের রচনায় ইমাম কুরতুবি সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং মুতাজিলাদের সমালোচনা করেছেন।
ইমাম কুরতুবি তার সৌজন্যতা ও জীবনযাপন ধারার জন্য পরিচিত ছিলেন। ১২৭৩ সালে ইমাম কুরতুবি মৃত্যুবরণ করেন। মুনিয়া আবিল খুসাবে তাকে দাফন করা হয়। ১৯৭১ সালে তার মাজারের পাশে তার নামে মসজিদ নির্মিত হয়েছে।
ইবনে আবদুল বার
ইউসুফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল বার, আবু উমার আল-নামারী আল-আন্দালুসি আল-কুরতুবি আল-মালিকি, (সাধারণভাবে ইবনে আবদুল বার নামে পরিচিত)। ইবনে আবদুল বার ৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ।একাদশ শতাব্দীর লিসবনের বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ও বিচারক ছিলেন। তিনি প্রথমে মুসলিম আইনের জাহিরিয়া মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। পরে মালিকি আইন সম্পর্কে পড়েন যা উমাইয়া খিলাফাত দ্বারা স্বীকৃত আইন ছিল। তিনি মালিকি আইনশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এছাড়া তিনি উমাইয়া খিলাফতের একজন গুরুত্বপূর্ণ কাজী ছিলেন। তিনি তার পাণ্ডিত্যের প্রমাণ তার রচিত বহুসংখ্যক গ্রন্থে রেখে গেছেন। তিনি তৎকালীন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইনবিদ ছিলেন।১০৭১ খ্রিষ্টাব্দে আল-আন্দালুসের জাটিভা-তে ৯৩ বৎসর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
আজ জাহিরি
আবু মুহাম্মদ আলী ইবনে আহমদ ইবনে সাইদ ইবনে হাযম (৭ নভেম্বর, ৯৯৪- ১৫ আগস্ট ১০৬৪) আল-আন্দালুস আজ জাহিরি নামেও পরিচিত, আন্দালুসীয় বহুবিদ্যাজ্ঞ যিনি কর্ডোবাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসালামি চিন্তাধারার একজন নেতৃস্থানীয় প্রবক্তা এবং সংগ্রাহক ছিলেন।
ইবনে বাজার
ইবনে বাজার পুরো নাম আবু বকর মুহাম্মদ বিন ইয়াহিয়া, মুসলিম স্পেনের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন। তিনি চিকিৎসক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন একই সাথে। মুসলিম জাহানের অনন্য সাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ইবনে সীনার মৃত্যুর পর দর্শন চর্চা প্রায় বিলুপ্ত হলে তিনি ফারাবীর (৮৭০-৯৫০ খ্রি.) শিষ্য হিসেবে দর্শন শাস্ত্রের উন্নতি বিধানে মনোনিবেশ করেন এবং রক্ষণশীল ধারায় এরিস্টটলের নিও-প্রোটোনিক ব্যাখ্যা শুরু করেন। তাঁর অনেক মৌলিক গ্রন্থ আছে।
আল-ইদ্রিসি
সিউটার শ্রেষ্ঠ সন্তান আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-ইদ্রিসি আল-কুরতুবী আল-হাসানী আস-সাবিত, বা সাধারণভাবে আল-ইদ্রিসি (১১০০-১১৬৫) সম্ভবত পাশ্চাত্যের সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত ভূগোলবিদ। মুসলিম স্পেনের ভৌগোলিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। ছিলেন একজন আরব মুসলিম ভূগোলবিদ, মানচিত্রাঙ্কনবিদ এবং মিশর বিশেষজ্ঞ যিনি সিসিলির পালার্মোতে বসবাস করতেন রাজা ২য় রজারের শাসনামলে।মানচিত্রকার মোহাম্মদ আল ইদ্রিসী, যাঁর মানচিত্র রেনেসাঁর সময় ইউরোপিয়ানদের গবেষণা করতে সাহায্য করেছিল।এক ‘খণ্ডগোলক নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ৭০টি মানচিত্র প্রস্তুত করেন।
জগদ্বিখ্যাত ভিষকাচার্য জোহর। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। নানা প্রকারের ওষুধ এবং অস্ত্র প্রয়োগের অস্ত্রাদি আবিষ্কার করেছিলেন।
প্রসিদ্ধ উদ্ভিদ তত্ত্ববিদ ইবনে বতহের এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ওষুধসংক্রান্ত গাছ-গাছড়া আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ভেষজ ওষুধ সম্বন্ধীয় বিশালাকার একটি গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছিলেন।
বিশিষ্টদের মধ্যে দার্শনিক ইবনে মাসারাহ (মৃত্যু-৯৩১), ঐতিহাসিক ইবনুল আহমর (মৃত্যু-৯৬৯), জ্যোতির্বিদ আহমদ বিন নসর (মৃত্যু-৯৪৪), মাসলামাহ বিন কাসিম (মৃত্যু-৯৬৪), চিকিৎসক আরিব বিন সাঈদ, ইয়াহিয়া বিন ইসহাক অন্যতম।যে সব পণ্ডিত হিশামের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তারা হলেন ঈসা বিন দীনার, আবদুল মালিক বিন হাবীব, ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, সাঈদ বিন হাসান এবং ইবনে আবু হিন্দ অন্যতম। আল মনসুরের দরবারে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কবি ওবাদা বিন আব্দুল্লাহ মাসুমী, আবদুল ওয়ারিস বিন সুফিয়ান, সাঈদ বিন ওসমানসহ আরো অনেকে।আবুল ফারাজ ইস্পাহানী তাঁর বিখ্যাত ‘কিতাবুল আগানী; রচনা করে দ্বিতীয় হাকাম কর্তৃক ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রায় ভূষিত হন। তৎকালীন স্পেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক উবায়দা বিন আবদুল্লাহ হজরতের প্রশংসামূলক কবিতা নিয়ে স্পেনীয় কবিদের একটি ইতিহাস লিখেছিলেন। এই গ্রন্থের জন্য মনসুর তাঁকে ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রায় পুরস্কৃত করেন। তা ছাড়া কবিদের জন্য তার গৃহের দ্বার সব সময় খোলা রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কবিদের মধ্যে উবায়দা বিন আব্দুল্লাহ, আবদুল ওয়ারিস বিন সুফিয়ান, সাঈদ বিন ওসমান, সাঈদ বিন হাসান, ইবনে যায়দুন, ইবনে আহনাফ, ইবনে সাঈদ, ইবনে আম্মার, ইবনুল খাতিব, ইবনুল লেবারন, ইবনে লাব্বানা, ইবনে ইয়েমানী, আবু বকরসহ অনেকের নাম করা যায়। ইবনুল আম্মারের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান মুতামিদ তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।দর্শনে আবু সীনা মাশাবাহ, ইবনে জিব্রাইল, ইবনে জোহর, , অগ্রগণ্য।স্পেনের প্রত্যেক খলিফাই রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য ঐতিহাসিক নিযুক্ত করতেন। প্রত্যেক শহরে ও প্রদেশে ঐতিহাসিক নিযুক্ত ছিলেন। বাদাজোজের ইবনুল আলতাশ ও ইবনুল খাতিব, টলোডোতে ইবনুল আহমদ, কর্ডোভায় খাজরাজী আল গাজ্জাল, আল হিজারী প্রমুখ ঐতিহাসিকের নাম উল্লেখযোগ্য।জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্পেনীয় মুসলমানদের অবদান চির স্মরণীয়। তারা প্রথম ইউরোপের বুকে মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।পারস্যে জন্মগ্রহণকারী এবং স্পেনে প্রতিষ্ঠিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আবু হাসান বিন নাফে ওরফে জিরাব ছিলেন সঙ্গীত শিল্পের অমর ব্যক্তিত্ব।ঐতিহাসিক লেনপুল ও ডোজি তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। স্পেনের আরো অসংখ্য জ্ঞানী শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন শাস্ত্রবিদ ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, ঈসা বিন দীনার, আবু ইব্রাহীম ইবনে মোয়াবিয়া, সাঈদ বিন রাযিক, জুবাইদী, ইব্রাহীম বিন নজর এবং গণিতবিদ আলজিবার। স্পেনের মহিলা শিল্পী ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে কর্ডোভায় মহিলা কবি ওয়াদাল্লাহ। ছন্দ ও অলঙ্কার শাস্ত্রে তিনি এতোই বুৎপত্তি সম্পন্না ছিলেন যে, সারা বিশ্বের তিনি Sapho of Arabs নামে পরিচিত ছিলেন।
এভাবে অসংখ্য অগণিত প্রতিভার স্পর্শে মুসলিম স্পেন ধন্য হয়েছিল। তার রাজধানী কর্ডোভার যশোগাঁথা দেখে সুদূর জার্মানির এক মঠবাসী সন্নাসী মুগ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন : Cordova : The Jewel the World.
এম আকবর আলী লেখেন, আল জারকালি টলেডোর প্রাসাদে একটি পানি ঘড়ি তৈরি করে ছিলেন (পৃষ্ঠা ৮৬৬)।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন