সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাক- স্বাধীনতা বলে কিছু নয়, ইসলামোফোবিয়া



২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী ফ্রান্সের জনসংখ্যা ৬ কোটি ৬৯ লাখেরও অধিক।মুসলিম জনসংখ্যা হচ্ছে ৬মিলিয়নের ও বেশি।মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র পিউ রিসার্চের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৮ শতাংশ মুসলমান৷ পিউ রিসার্চ সেন্টার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩২ লাখ হবে।প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে অনেক কম।ফ্রান্সে ইসলাম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।বর্তমানে ফ্রান্সে ৩০০০হাজার মসজিদ আছে।পাঁচ শতের বেশি রয়েছে শুধু প্যারিস শহরে।গত ২৫ বছরে ফ্রান্সে ইসলাম গ্রহণের হার দ্বিগুণ বেড়েছে।গত ১০০ বছরে ফ্রান্সে যতগুলো ক্যাথলিক গির্জা নির্মিত হয়েছে,গত ৩০ বছরেই তার চেয়ে বেশি মসজিদ ও নামাজকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। মুসলমানদের অব্যহত অগ্রগতি ফরাসিদের ভাবিয়ে তুলেছে ।ফলে মুসলমানদের কোণঠাসা করতে ও ইসলামোফোবিয়া থেকে পরিকল্পিতভাবে ফ্রান্সে মুসলমানদের টার্গেট করা হচ্ছে ।ইতোমধ্যে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে।ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম দেশ, যেখানে বোরকা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়৷ ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল এই আইন কার্যকর হয়৷ বোরকা বা নেকাব পড়লে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনে।মুসলমান নারীদের জন্যে কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিধান করা আইন করে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাদের ওপর চাপ আরো বাড়িয়ে দিতে একটি পুরনো আইনকে টেনে সামনে আনা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের বামপন্থিদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছেন এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ফ্রান্সও যখন কোভিড-১৯ মহামারীতে দিকভ্রান্ত, ম্যাঁক্র তখন মহামারী মোকাবিলার চাইতে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তাঁর দেশের মুসলিমদের ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপকে। বলে চলেছেন, ইসলামের ভেতরেই নাকি ''সমস্যা'' রয়ে গেছে।বলেছেন, বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্ম সঙ্কটে রয়েছে। এই সঙ্কট উগ্রপন্থার জন্য। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ইসলাম ধর্ম এই সঙ্কট মোকাবেলা করছে।ফ্রান্সে ১৯০৫ সালের একটি আইনকে নতুন করে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে দেওয়া এক ভাষণে ইসলাম সম্পর্কে এসব মন্তব্য করেছেন এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। জানা যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য তৈরি করা ওই আইনটি ফিরিয়ে আনলে ধার্মিকরা আরো বেশি চাপে পড়বেন। ম্যাক্রোঁ বলেন, রাষ্ট্র থেকে যে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়কে বিচ্ছিন্ন করা হবে এই আইনের মাধ্যমে।ম্যাক্রো আরো বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ফ্রান্সের ঐক্যের মূল ভিত্তি। তাই আমরা কঠোরভাবে এটা বাস্তবায়ন করতে চাই। এখানে যে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে তার ধর্ম পালন করতে পারবেন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যে কোনো সরকারি দপ্তরের সঙ্গে ধর্মের কোনো সংযোগ থাকবে না।

নতুন আইনে অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, ফ্রান্সের বিভিন্ন মসজিদে বিদেশী অনুদানের বিষয়টিতে নজরদারি করতে পারবে রাষ্ট্র, ফরাসি ইমামদের জন্য স্পেশ্যাল সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম চালু করা হবে এবং নেয়া হবে হোম স্কুলিং-এর সংখ্যা কমানোর যথাযথ ব্যবস্থা। সাধারণত ফরাসি মুসলিমরাই তাদের শিশুদের জন্য এ ধরনের স্কুল চালিয়ে থাকে। ম্যাঁক্রো-র ধারণা, এসব স্কুল চালায় ''ধর্মীয় চরমপন্থীরা' প্রস্তাবিত নতুন আইন নিয়ে গত ২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো দীর্ঘ দুই ঘণ্টাব্যাপী ভাষণ দেন। তাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় তাঁর ইসলামবিরোধিতা প্রকাশ করেন। তাঁর বক্তব্যের জবাবে ফ্রান্সের ১০০ জন বিশিষ্ট মুসলিম প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, একজন নারী হিজাব পরল কী পরলো না, এটা কোনো রাষ্ট্রীয় বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। এসব ফাঁপা রাজনৈতিক ও মিডিয়া বিতর্ক বন্ধ করুন।ফ্রান্সে এক শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করা হয় । নিহত ব্যক্তি তার ছাত্রদের ইসলামের নবী সম্পর্কে বিতর্কিত কার্টুন দেখিয়েছিলেন।লে মঁন্ড পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী নিহত ব্যক্তি ইতিহাস ও ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন।শার্লি হেবদো ম্যাগাজিন ইসলামের নবীকে নিয়ে ছাপা হওয়া যেসব কার্টুন মুসলিমদের উষ্মার কারণ হয়েছিল, ঐ ধরণের কার্টুন চিত্র প্রকাশের সাথে বাক স্বাধীনতার সম্পৃক্ততা নিয়ে ক্লাসে ছাত্রদের সাথে আলোচনা করেছিলেন।ফরাসী মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, শার্লি হেবদো ইসলামের নবীর যেসব কার্টুন ছেপেছিল, সেগুলোর একটি বা একাধিক কার্টুন দেখিয়ে ছাত্রদের সাথে আলোচনা করার জন্য এ মাসের শুরুর দিকে কয়েকজন মুসলিম অভিভাবক স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও করেছিলেন। এ ঘটনাকে ইসলামি সন্ত্রাসী হামলা বলে বর্ণনা করেছে দেশটির প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ। ম্যাক্রঁ বলেছেন, ঐ শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে কারণ তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আঙ্কারাভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংকের প্রতিবেদনে ফাউন্ডেশন ফর পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল রিসার্চ (এসইটিএ) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইউরোপীয় ইসলামোফোবিয়া : রিপোর্ট ২০১৮’ ইউরোপে মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদের উত্থানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে, এমন কিছু কারণের ওপর আলোকপাত করেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার, বহুসংস্কৃতিবাদ এবং ইউরোপের রাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে সবসময় মুসলিমবিরোধী আলোচনা করার কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে ইসলামফোবিয়া এবং মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদ। মুসলিম-বিরোধী এই বর্ণবাদের প্রজনন ও প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইউরোপের গণমাধ্যম। ইউরোপের এমন খুব কম গণমাধ্যম আছে, যারা মুসলিমদের ইতিবাচক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলে।বরং নেতিবাচকভাবেই মুসলিমদের তুলে ধরে সবসময়। আর ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ক্রমাগত মুসলিমবিদ্বেষ তো আছেই।প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মুসলমানদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদদের ইসলামোফোবিক ভাষা এবং ডানপন্থীদের বর্ণবাদী ভাষা ইসলামোফোবিয়াকে আরো বাড়িয়ে তুলছে এবং বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করছে। এখন ইসলামোফোবিয়া কেবল মুসলমানদের নয়, ইউরোপের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও নির্বাচনী উদ্দেশ্যে তারা এই বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়াকেই উসকে দেয়।ফ্রাসে ২০২২ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ অস্ত্রটি ব্যবহারের কাজে বেপরোয়া এখন প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র এবং তাঁর কট্টর ডানপন্থী প্রতিদ্বদ্বী মেরিনে লা পেন। লা পেনের প্ল্যাটফরমটি ইসলামবিরোধীদের, এটা সবাই জানে। তাই প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাদের মাঝে নিজের কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে।একজন সাংবাদিক এ নিয়ে টুইটারে লিখেছেন, ম্যাঁক্র-র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন টলটলায়মান। তাই তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বালানোর পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ এটিই হলো একমাত্র পন্থা, যা ভোটের মাঠে কখনো ব্যর্থ হয় না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...