ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে ইসলাম ও মুসলমান
ব্রাজিল হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। এছাড়াও জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ।বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিল প্রায় ১৫ হাজার ৯১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।ব্রাজিলের উত্তরে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম, ও ফ্রান্সের সামুদ্রিক দেপার্ত্যমঁ ফরাসি গায়ানা। এছাড়াও এর উত্তর-পশ্চিমভাগে কলম্বিয়া; পশ্চিমে বলিভিয়া ও পেরু; দক্ষিণ-পশ্চিমে আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে, এবং সর্ব-দক্ষিণে দক্ষিণে উরুগুয়ে অবস্থিত।ব্রাজিলের সাথে চিলি ও ইকুয়েডর ব্যতীত দক্ষিণ আমেরিকার সকল দেশেরই সীমান্ত-সংযোগ রয়েছে।১৫০০ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী পেদ্রু আলভারেজ কাবরাউয়ের ব্রাজিলে এসে পৌঁছানোর পর থেকে ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রাজিল ছিলো একটি পর্তুগিজ উপনিবেশ। ১৮১৫ সালে এটি যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, ও আলগ্রেভিজের সাথে একত্রিত হয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা গঠন করে। মূলত ১৮০৮ সালেই ব্রাজিলের পর্তুগিজ উপনিবেশ’ পরিচয়ে ফাটল ধরে, কারণ নেপোলিয়নের পর্তুগাল আক্রমণের রেশ ধরে পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের কেন্দ্র লিসবন থেকে ব্রাজিলের রিও দি জানেইরুতে সরিয়ে নওয়া হয়। ১৮২২ সালে ব্রাজিল, পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাথমিক ভাগে এটি ব্রাজিলীয় সাম্রাজ্য হিসেবে সার্বভৌমত্ব অর্জন করলেও ১৮৮৯ সাল থেকে এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে শাসিত হয়ে আসছে। ১৮২৪ সালে ব্রাজিলের প্রথম সংবিধান পাশ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা চলে আসছে, যা বর্তমানে কংগ্রেস নামে পরিচিত। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ব্রাজিল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র। একটি ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট, ২৬টি প্রদেশ, ও ৫,৫৬৪টি মিউনিসিপ্যালিটি নিয়ে এর যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছে।ব্রাজিলের অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি।ব্রাজিল জাতিসংঘ, জি-২০, সিপিএলপি,অর্গানাইজেশন অফ ইবেরো-আমেরিকান স্টেটস, মার্কুসাউ ও ইউনিয়ন অফ সাউথ আমেরিকান নেশন্স, লাতিন ইউনিয়ন এবং ব্রিক দেশগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্রাজিল জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি দেশ হিসেবে।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ হিসেবে রাশিয়া, কানাডা, চীন, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ব্রাজিলের অবস্থান। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এটি আমেরিকা মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ।ব্রাজিলের সর্বমোট আয়তন ৮৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৭৭ বর্গকিলোমিটার (৫২ লাখ ৯০ হাজার ৮৯৯ বর্গমাইল)।এই দেশটিতে বসবাসকৃত মানুষের সংখ্যা ২০০৮ সালের গণনা অনুযায়ী প্রায় ১৯ কোটি।এটি আমেরিকার একমাত্র পর্তুগিজভাষী দেশ, এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্র।Roman Catholic 64.6%, other Catholic 0.4%, Protestant 22.2% (includes Adventist 6.5%, Assembly of God 2.0%, Christian Congregation of Brazil 1.2%, Universal Kingdom of God 1.0%, other Protestant 11.5%), other Christian 0.7%, Spiritist 2.2%, other 1.4%, none 8%, unspecified 0.4%. ব্রাজিলে লোকসংখ্যার বেশির ভাগই ক্যাথলিক খ্রিস্টান। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি বেশ কিছু মুসলমানও রয়েছে। যার সংখ্যা ১৭ লাখের মতো। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫-৬ শতাংশ। পিউ রিসার্চ সেন্টারের পরিসংখ্যান মতে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে মুসলিমের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ০.১ ভাগ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২ লাখ ২৭ হাজার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তবে ব্রাজিলের মুসলিম সংগঠনগুলো দেশটির মুসলিমদের সংখ্যা চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ বলে জানিয়েছে।
ব্রাজিলে ইসলামের আগমন হয়েছে আরব, আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত মুসলিম অভিবাসীদের মাধ্যমে। Islam is a minority religion in Brazil, first brought by African slaves and then by Lebanese and Syrian immigrants. ব্রাজিলে মুসলমানদের আগমন ঘটে আফ্রিকান দাস শ্রম আমদানির মাধ্যমে । ব্রাজিল সমস্ত আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ৩৭% ব্যবসা করেছিল এবং ৩ মিলিয়নেরও বেশি ক্রীতদাসকে ব্রাজিলে প্রেরণ করা হয়েছিল। পণ্ডিতেরা দাবি করেছেন যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও কোথাও তুলনায় ব্রাজিল বেশি বেশি দাসপ্রাপ্ত মুসলমানদের গ্রহণ করেছে।ব্রাজিলিয়ান মুসলিমদের বড় একটি অংশ সিরিয়া থেকে থেকে আগত। উনিশ শতকের শেষভাগে এবং বিশ শতকের শুরুতে সিরিয়াসহ আরব দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম অভিবাসী ব্রাজিলে পাড়ি জমায়। ব্রাজিলে ইসলাম অস্তিত্ব উনিশ শতকের বহু পূর্বে থাকলেও এ সময়কালকে ব্রাজিলে মুসলিম সমাজের গঠন ও বিকাশের স্বর্ণ যুগ বলা হয়।ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রাজিলে ইসলামের আগমন আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের সূচনালগ্ন থেকেই। আফ্রো-ব্রাজিলিয়ান মুসলিম সম্প্রদায়ের বিদ্রোহের পরে, দেশে ইসলামের পরবর্তী সময়টি মূলত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে মুসলিম অভিবাসনের ফলাফল ছিল। প্রায় ১১ মিলিয়ন সিরিয়ান এবং লেবানিজ (বেশিরভাগ মেরোনেট খ্রিস্টান) অভিবাসী পুরো ব্রাজিল জুড়ে বাস করে ।মুসলমানদের বৃহত্তর অংশ সাও পাওলো অঞ্চলে পাওয়া যায়। The first wave of Levantine Arabs arrived in the 1890s fleeing political and economic instability in the Ottoman Empire, the majority of them Christian but many Muslim.
১৫০০ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল বিখ্যাত পর্তুগিজ পরিব্রাজক ও আবিষ্কারক পেড্রো আলভারেস কারব্যাল(১৪৬৭-১৫২০) যখন ব্রাজিল উপকূলে জাহাজ নোঙর করেন, তখন তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু স্বনামধন্য, দক্ষ, কর্মঠ ও পারদর্শী মুসলিম নাবিক ছিলেন। তন্মধ্যে শিহাবুদ্দিন বিন মাজেদ ও মুসা বিন সাতি অন্যতম। ইতিহাসের বরাত অনুযায়ী তাঁদের হাত ধরেই ব্রাজিলে ইসলাম ও মুসলমানের আগমন ঘটে। তবে বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ইতিহাসবিদ জোয়াকিন হেপিরো ব্রাজিলে ইসলামের আগমনের ব্যাপারে ১৯৫৮ সালে একটি লেকচার দেন এবং পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় লেকচারটি প্রকাশ করা হয়। তাতে তিনি অত্যন্ত তাগিদের সঙ্গে উল্লেখ করেন, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের ব্রাজিল আবিষ্কারের অনেক আগে আরব বণিক ও নাবিকরা ব্রাজিল আবিষ্কার করেন। পর্তুগিজরা মূলত জাহাজ চালনা ও নির্মাণশিল্পে দক্ষ এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মুসলিম নাবিকদের সহযোগিতায় ব্রাজিলে আগমন করে।
অন্যদিকে যখন স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন হয়, তখন বিপুলসংখ্যক স্প্যানিশ মুসলমান খ্রিস্টানদের নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে পালিয়ে ব্রাজিলে হিজরত (আশ্রয় গ্রহণ) করে। ক্রমান্বয়ে ব্রাজিলে স্প্যানিশ মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে স্পেনের অনুকরণে ব্রাজিলের তৎকালীন পর্তুগিজ সরকার ব্রাজিলেও ‘অনুসন্ধান-আদালত’ প্রতিষ্ঠা করে এবং অনৈতিক ও মানবিক বিচারের আওতায় এনে বহুসংখ্যক মুসলমানকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন নিদর্শন মুছে ফেলে।ব্রাজিলের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা যায়, ব্রাজিলে যেসব আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মুসলিম রয়েছে, তাদের পর্তুগিজরা দাস হিসেবে ব্রাজিলে নিয়ে আসে। তারা পুরোপুরি মুসলিম ছিল এবং আরবি উচ্চারণে কোরআন তিলাওয়াত করতেন।ব্রাজিলে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের প্রথম বহর আসে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে এবং ৪০ বছর পেরোনোর আগেই ১৪ হাজারের বেশি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মুসলমান আফ্রিকা থেকে ব্রাজিলে স্থানান্তরিত হয়। পর্তুগিজরা পরবর্তী সময়ে কয়েক বছরে নিগ্রো মুসলিমদের বেশি হারে নিয়ে আসতে শুরু করে। এমনকি শুধু অ্যাঙ্গোলা থেকেই ছয় লাখ ৪২ হাজার নিগ্রো মুসলিমকে ব্রাজিলে নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া সুদানের বিভিন্ন অঞ্চল ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের ব্রাজিলে নিয়ে যাওয়া হয়।এসব নিগ্রো মুসলমানকে জোরপূর্বক ব্রাজিলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের হাত-পা শিকলে বেঁধে জাহাজের পাটাতনে ফেলে নিয়ে যাওয়া হতো। নির্যাতন-অবহেলা, অনাহারে ও রোগাক্রান্ত হয়ে যেসব মুসলমান মারা যেত, তাদের মাঝপথে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। মুসলিম দাসদের মধ্যে যারা অন্যদের তুলনায় বয়স্ক ও শিক্ষিত ছিল, তারা অন্যদের ওয়াজ-নসিহত করত এবং কোরআন, ফিকহ, আকিদা ও শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি শিক্ষা দিত। তাদের সঙ্গে বসবাসের অযোগ্য কুটিরগুলোতে থাকত।যখন ক্রমান্বয়ে মুসলমান দাসের সংখ্যা ও শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পেল, তখন তারা বিভিন্ন ইসলামী স্বাধীনতা বিপ্লব সংঘটিত করে। বিপ্লবগুলোর অন্যতম ছিল ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় আলমিরস শহরে মুসলমান দাস বিদ্রোহীদের জড়ো হওয়া। প্রাপ্ত ইতিহাসের মাধ্যমে জানা যায়, সেখানে প্রায় ৩০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান বিদ্রোহে শরিক হয়েছিল এবং তরুণ মুসলিম নেতা জানজা জুম্বার নেতৃত্বে নিপীড়িতদের জন্য একটি আলাদা মুসলিম রাজ্য গঠন করে। দীর্ঘদিন ধরে তারা তাদের রাজ্য জানজা জুম্বার ভাই ও পুত্রদের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র মোতাবেক বলা হয়ে থাকে, জুম্বা ছিলেন পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী কঙ্গোর রাজার নাতি। যদিও কঙ্গোর রাজা পর্তুগিজদের বিপক্ষে সফল হতে পারেননি।দীর্ঘ সংঘর্ষের পরও যখন মুসলমানদের দমন করা যায়নি, তখন পর্তুগিজরা জুম্বার সঙ্গে সন্ধি করতে চায়। কিন্তু জুম্বি নামের আরেকজন অল্প বয়সী মুসলিম নেতা পর্তুগিজদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে সন্ধি মানতে নারাজ হন এবং তিনি আমরণ লড়াই চালিয়ে যান। ফলে ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বীর জুম্বি পর্তুগিজদের বিপক্ষে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ফলে অনেক চেষ্টার পরও পর্তুগিজরা মুসলমানদের বিদ্রোহ দমন বা কোণঠাসা করতে পারেনি।শেষ পর্যন্ত পর্তুগিজরা রাজধানী সাওপাওলো থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক শক্তির সাহায্য নেওয়ার পর ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে আলমিরস মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন হয়। পর্তুগিজরা কঠোর হস্তে মুসলিম বিদ্রোহীদের দমন করে। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই মুসলমানরা পরাজিত হয়। মুসলিম বিদ্রোহীদের লাশগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ও ‘সানসালাত সেলে’ পড়ে পচতে থাকে।বিদ্রোহ দমনের পর অনেক মুসলমানকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। ধর্মান্তরিত হতে রাজি না হওয়ায় অনেককে হত্যা করা হয়। ফলে কিছু মুসলমানের কাছে ব্রাজিলীয় পৌত্তলিকতা আসতে শুরু করে। এমনকি ব্রাজিলের মুসলমানরা এখনো বিভিন্ন পৌত্তলিকতাপূর্ণ অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে।
ইংল্যান্ডের চাপে পড়ে ১৮৮৮ সালে ব্রাজিলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয় এবং ব্রাজিলই সর্বশেষ দেশ, যারা দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে। কিন্তু এই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ধ্বংস করা হয় অনেক মসজিদ। অনেক মুসলমান খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিশে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। তাদের মুসলিম পরিচয়টা পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে এলসালভাদর ও বাহিয়ার বেশ কিছু গির্জার দেয়ালেও কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের নকশা অলংকৃত হচ্ছে। গির্জার ব্যবস্থাপকরা আরবি না জানার কারণে এগুলো কী তা উদ্ঘাটন ও নির্ণয় করতে পারেনি। বস্তুত অনেক গির্জা আগে মসজিদ ছিল এবং খ্রিস্টানরা মুসলমানদের হত্যা ও দমন করে মসজিদগুলোকে গির্জায় রূপান্তরিত করে।
বর্তমানে ব্রাজিলের প্রতিটি শহরেই মসজিদ আছে।বর্তমানে ব্রাজিলে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ১৫০টি। ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটি শহরেই রয়েছে মসজিদ। যেখানে ২০০০ সালে মসজিদ ছিল মাত্র ৪০টির মতো, সেখানে মাত্র কয়েক বছরেই এ সংখ্যা ৪ গুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ টি।ব্রাজিল সফররত মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এই সংখ্যাটি বাড়ছে।।তাছাড়া মসজিদের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায় রয়েছে অনেক মক্তব, মাদরাসা ও ইসলামিক স্কুল।সরকার থেকেও নিয়মিত পাচ্ছে সহযোগিতা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা। রিও ডি জেনেইরোয় রয়েছে বৃহৎ ইসলামিক সেন্টার, ইসলামিক স্কুল, বেশ কয়েকটি বড় মসজিদ। সাওপাওলোতেও রয়েছে বিশাল মুসলিম কমিউনিটি।ব্রাজিলের সাওপাওলো, রিও ডি জেনেইরো ও রিগ্রেন্ডে দে সোল তুলনামূলক মুসলিম অধ্যুষিত শহর। এ ছাড়া পারানা শহরে রয়েছে আরব বংশোদ্ভূত উল্লেখযোগ্য মুসলিম সম্প্রদায়। ব্রাজিলের মুসলমানদের জন্য সুদিন আসতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। লেবানন, ফিলিস্তিন, মিসর ও সিরিয়া থেকে মুসলমানরা ব্রাজিল আসতে থাকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ও লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় এবং ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিল সম্রাট মিসর, লেবানন ও সিরিয়া সফর করার পর থেকে। রাজা দ্বিতীয় পেড্রোর সঙ্গে চুক্তি হয় লেবাননের। লেবানিজরা ব্যবসা করার জন্য আসতে শুরু করে দেশটিতে।
দ্বিতীয় মাত্রায় ১৮১৪ ও তৃতীয় মাত্রায় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ব্রাজিলে হিজরত করে। গত শতাব্দীতে ও বর্তমানে ব্রাজিলে হিজরতকারী বেশির ভাগ মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। ব্রাজিলের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে মুসলিম ব্যবসায়ীরা। তবে অন্যান্য পেশার সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম—চাকরি, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও খেলাধুলায়ও মুসলমানরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। অন্যদিকে আরব বসন্তের পর গত কয়েক বছরে চার শতাধিক সিরিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে শতাধিক মুসলিম পরিবার ব্রাজিলে আশ্রয় নিয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক গিলবার্টো ফেরেইরি (১৫ মার্চ ১৯০০-১৮ জুলাই ১৯৮৭) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘এ নিউ ওয়ার্ল্ড ইন দ্য ট্রপিক্যাল সফেরেসে’ (A new world in the Tropical Spheres) উল্লেখ করেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানরা ব্রাজিলের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সক্রিয়তা ও সৃজনশীলতার অন্যতম উপাদান হিসেবে নিজেদের পরিচয়ই দেয়নি; বরং আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, সে সময় ব্রাজিলে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে এই কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানরাই সর্বাধিক চারিত্রিক মাধুর্যের অধিকারী ছিল। যদিও তাদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের প্রতি ব্রাজিল সব সময় ঋণী হয়ে থাকবে। আখ-চিনি, কফি, তুলা, বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, এমনকি প্রয়োজনীয় সব ধরনের কৃষি সরঞ্জামাদি তাঁরা আফ্রিকা থেকে ব্রাজিলে নিয়ে এসেছিল।তৎকালীন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের প্রযুক্তিগত ও কারিগরি জ্ঞান ব্রাজিলিয়ান ও স্বয়ং পর্তুগিজদের চেয়ে উন্নত ছিল। ব্রাজিলের সভ্যতা ও সমাজ গঠনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এসব কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানের গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। মজার কথা হলো, দাস মুসলমানরা অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তাদের মূর্খ মালিকদের লিখিত বিভিন্ন কাজকর্মেও আঞ্জাম দিত। এমনকি তাদের অজ্ঞ মালিকরা পর্তুগিজদের সঙ্গে কথা বলত মুসলমান দাসদের দোভাষী বানিয়ে। এ ছাড়া নিজের মূর্খ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুর কাছে চিঠি লিখত মুসলমান দাসদের মাধ্যমে এবং সে চিঠিও মূর্খ প্রাপককে পড়ে শোনাতো অন্য মুসলমান দাসরা।’ সাম্প্রতিক অআরব নাগরিকদের মধ্যে ইসলাম ধর্মান্তরের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ইসলাম গ্রহণ করছে। দেশটিতে ইসলাম ধর্মের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছেই।ব্রাজিলের ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রাজিলে আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার নও-মুসলিম বাস করছে। বর্তমানে দেশটিতে ১৫০টির বেশি মসজিদ বিদ্যমান। মূলত লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল ইসলামের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। গত তিন দশকে ব্রাজিলের সমাজব্যবস্থায় ইসলাম গ্রহণের হার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। কেবল মসজিদই নয়, বরং গ্রন্থাগার নির্মাণ, শিল্পকলা স্থাপন, স্কুল নির্মাণ ও সংবাদপত্র প্রকাশসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক কাজে অর্থায়নের মাধ্যমেও মুসলিমরা বড় ভূমিকা পালন করছে।
গ্রন্থনা ও সম্পাদনায়- মো. আবু রায়হান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন