গ্রিসের মুসলমান ও তাদের অবস্থা





#মো.আবু রায়হান
গ্রিস ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের একটি রাষ্ট্র। গ্রিসের সরকারি নাম হেলেনিক রিপাবলিক। যা বলকান উপদ্বীপের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। এর উত্তরে বুলগেরিয়া, সাবেক যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্র মেসিডোনিয়া ও আলবেনিয়া অবস্থিত। গ্রিসের পূর্ব দিকে আছে তুরস্ক। এর মূল ভূমির পূর্ব ও দক্ষিণে রয়েছে এজিয়ান সাগর, আর পশ্চিমে আইওনিয়ান সাগর। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উভয় অংশে গ্রিসের বেশ কিছু দ্বীপ রয়েছে। এ ছাড়া এটি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মিলনস্থলে অবস্থিত।পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার, গণতন্ত্রের জন্মদাতা এবং সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টেটল, পিথাগোরাস, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট প্রমুখ মনীষীর সেই প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার এবং আধুনিক বিশ্বের অন্যতম দেশ গ্রিস।বর্তমান গ্রিসদের প্রাচীন পূর্বপুরুষ হচ্ছে একসময়ের পৃথিবী বিজয়ী প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা, বাইজানটাইন সাম্রাজ্য।পরে গ্রিস প্রায় ৪০০ বছর ওসমানি খেলাফতের আওতাধীনও ছিল।

এজিয়ান সাগরের তীরে সুপ্রাচীন কালে ইউরোপের প্রথম উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, বর্তমান আধুনিক ইউরোপকে এর ফসল বললে বেশি বলা হবে না। Minoan এবং Mycenean সভ্যতার উত্থানের ফলে গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র জেলা এবং সরকার ও সমাজ কাঠামো বিশিষ্ট রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এই রাজ্যগুলো স্পার্টা এবং এথেন্সের অধীনে একত্রিত হয়ে পারসিক অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করেছিল। এথেন্সে গ্রিসের প্রথম সমৃদ্ধ সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয় যার পরিণতি পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ। এ সময় পার্সিয়ানদের হাতে স্পার্টার পতন হয়। এর পর মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে সকল গ্রিকরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে পারসিকদের প্রতিহত করে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে রোমান সম্রাজ্যের সূচনা করে। রোমান যুগের সূচনায় হেলেনীয় সমাজ ও সংস্কৃতির কোন পরিবর্তন না হলেও এর ফলে আবশ্যিকভাবেই গ্রিস তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারায়। খ্রিস্ট ধর্ম বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত এখানে হেলেনীয় সংস্কৃতি টিকে ছিল। গ্রিস রোমের একটি প্রদেশে পরিণত হয় এবং তখনও গ্রিস প্রবল প্রতাপে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সংস্কৃতিকে প্রভাবান্বিত করে চলে। এরপর রোমান সাম্রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়; একভাগের নাম পূর্ব রোমান সম্রাজ্য যা গ্রিকদের সাম্রাজ্য নামে প্রতিষ্ঠা পায় এবং পরবর্তীকালে বাইজান্টাইন সম্রাজ্য নাম ধারণ করে। অন্য অংশ ছিল কনস্টান্টিনোপ্‌ল কেন্দ্রিক যার নাম ছিল বাইজান্টিয়াম। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বসফরাস প্রণালির উপকূলে প্রাচীন গ্রিক শহর বাইজেনটিয়ামে তাঁর সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী স্থাপন করে এর নাম রাখেন নোভারোমা বা নয় রোম। কালক্রমে তাঁর নামানুসারে এই শহরের নাম হয় কনস্টান্টিনোপল।একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীকে গ্রিসে বাইজান্টাইন শিল্পকলার স্বর্ণযুগ বলা হয়। তবে ১২০৪ থেকে ১৪৫৮ সালের মধ্যে সংঘটিত ক্রুসেডের সময় ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত কিছু সেনাদল দ্বারা গ্রিস আক্রান্ত হয়। ২৯ মে ১৪৫৩ সালের কনস্টান্টিনোপ্‌লের পতনের পূর্ব পর্যন্ত এখানে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।গ্রিসের বৃহৎ অবদান হচ্ছে পশ্চিমা দর্শন, অলিম্পিক গেম্‌স, পশ্চিমা সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং নাটক। সব মিলিয়ে গ্রিসের সভ্যতা সমগ্র ইউরোপে এক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সভ্যতা হিসেবে পরিগণিত হত। আধুনিক অলিম্পিক গেমসের জন্মস্থান কিন্তু এই গ্রিস। ১৮৯৬ সালে প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয় এথেন্সের ‘পান-এথেনাইকো’ স্টেডিয়ামে, মাত্র ১৪ টি দেশকে নিয়ে। ১০৮ বছর পর আবার অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় গ্রিসে, ২০০৪ সালে। তবে সে বার যোগ দিয়েছিল প্রায় ২০০টি দেশ।বর্তমানে গ্রিস একটি উন্নত দেশ, যার রাজধানী অ্যাথেন্স এবং ১৯৮১ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।১৯৫১ সাল থেকে ন্যাটো এবং ১৯৬০ সাল থেকে ওইসিডি-এর সদস্য হিসেবে আছে।

দেশটির সরকারী ভাষা হচ্ছে গ্রিক। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম লিখিত ভাষা। ভাষাটি প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি পুরনো।১ লাখ ৩১ হাজার ৯৫৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ মানুষের বসবাস।দেশটির শতকরা প্রায় ৯৩ ভাগ মানুষ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয় এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ শতাংশ। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ২ শতাংশ। গ্রিসের মুসলিম সংখ্যালঘু হলো গ্রিসের একমাত্র স্বীকৃত সংখ্যালঘু। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে মুসলিম সংখ্যা ৯৭,৯০৫ (জনসংখ্যার ০.৯%) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের তথ্য অনুসারে, অনুমানিক ১,৪০০০০ যা মোট জনসংখ্যার ১.২৪%।অনুমান করা হয় গ্রিসে ১০ লাখের মতো মুসলমান বসবাস করেন। তন্মধ্যে এথেন্সেই রয়েছে ২ লাখ মুসলমানের বাস।
গ্রিসে ইসলাম তিনটি ধাপে প্রবেশ করে- প্রথমতঃ মুসলিমরা ক্রিট আমিরের (৮২৪-৯৬১) সময় থেকে আধুনিক গ্রীসের সীমান্তের মধ্যে বসবাস করেছে।বাইজেন্টাইনদের ক্রীট জয়ের পর ইসলামের এই প্রথম দিকের অনুসারীদের হত্যা করা হয়েছিল, ক্রীতদাস করা হয়েছিল বা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিল এবং তাদের বসতি, মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।দ্বিতীয়তঃ গ্রীসে মুসলিমরা অটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে পূর্ব ম্যাসিডোনিয়া এবং থ্রেসে প্রবেশ করে- ওসমানি খেলাফতের উত্তরসূরি দ্বিতীয় মুহাম্মদ ফাতেহর সময় গ্রিসের রাজা কনস্টান্টাইন কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ তাঁর পূর্বসূরিদের মতো কনস্টান্টিনোপল দখলের উদ্যোগ নিচ্ছেন জেনে রাজা কনস্টান্টাইন পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টান রাজাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। সমঝোতার খাতিরে তিনি তখন রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনেক দাবিদাওয়া মেনে নেন। এতে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের নেতারা খেপে যান। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রধান গ্র্যান্ড ডিউক নোটারাস বলেন, রোমান সম্রাটের মুকুট অপেক্ষা তিনি ওসমানি সুলতানের পাগড়ি দেখতে বেশি পছন্দ করেন।১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ কনস্টান্টাইনের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন। যুদ্ধে গ্রিসের রাজা নিহত হন। কনস্টান্টিনোপলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়। কনস্টান্টিনোপল দখলের পর মুহাম্মদ ফাতেহ গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের কর্তৃপক্ষকে একটি সনদ প্রদান করেন। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি অবাধে প্রতিপালনের অধিকার স্বীকৃত হয়। সুলতান নির্দেশ দেন যেন কোনো গির্জা ও উপাসনায়গুলোর অসম্মান না করা হয় এবং পাদরি, মহিলা, শিশু ও অক্ষমদের যেন কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া হয়। যুদ্ধকালে যেসব খ্রিস্টান শহর ছেড়ে পালিয়েছিল, মুহাম্মদ ফাতেহ তাদের স্বগৃহে ফিরে আসার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু খ্রিস্টান কনস্টান্টিনোপল ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে সেখানে ওসমানি খেলাফতের রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। ওডেসাতে চারজন গ্রিক বণিক ১৮১৪ সালে ‘হিটারিয়া ফিলকি’ নামে এক গুপ্ত কমিটি গঠন করে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে এর সদস্যসংখ্যা এসে দাঁড়ায় দুই লাখে। ইউরোপে ওসমানি খেলাফতের অবসান ঘটিয়ে প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যের মতো একটি নতুন গ্রিক সাম্রাজ্য গঠন ছিল এই সমিতির লক্ষ্য। ইতিহাসবিদ লেনপুল বলেন, ‘স্বাধীনতার উচ্চাদর্শ এই সব বিদ্রোহকে যতখানি না উদ্দীপিত করেছিল, তার চেয়ে বেশি করেছিল রাশিয়ার উস্কানি।’তৎকালীন ওসমানি খেলাফতের উত্তরসূরি দ্বিতীয় মিসরের মুহাম্মদ আলীর সৈন্যরা গ্রিক বিদ্রোহীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। এ সময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি গ্রিসের প্রতি ইউরোপীয়দের মনে সহানুভূতি জেগে ওঠে। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মিলিত বাহিনী নাভারিনোর নৌযুদ্ধে ওসমানি নৌবাহিনীকে পরাজিত করে। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসের বিরুদ্ধে নতুন সামরিক অভিযান চালিয়ে ওসমানি বাহিনী আবারও পরাজিত হয়। অবশেষে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ওসমানি খেলাফত গ্রিসের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে সেখানে মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে যায়।

তৃতীয়তঃ মুসলিম অভিবাসীরা বিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে এথেন্স এবং থেসালোনিকিতে আসে। প্রথম অভিবাসীরা বেশিরভাগ মিশরীয়ই। মিশর থেকে ১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে এসে পৌঁছেছিল এবং গ্রিসের দুটি প্রধান নগর কেন্দ্র, এথেন্স এবং থেসালোনিকিতে বসতি করেছে।গ্রীসের মুসলমানরা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের- লেবানন, সিরিয়া, সাইপ্রাস, ইরাক, ইরান, বলকান অঞ্চলের- মন্টিনিগ্রো, তুরস্ক, আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এবং উত্তর আফ্রিকা্র-মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিশর থেকে অভিবাসী। আফগানিস্তান, দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার অভিবাসীরা ১৯৭০ সালে গ্রিসে এসে পৌঁছান।

গ্রিসে ইসলাম সম্পর্কে ছড়ানো হয় বিভিন্ন মিথ্যাচার, যাতে ইসলামের প্রতি মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি হয়। এটি মূলত গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ছিল। তাদের বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া হতো, ‘তুর্কিরা ৪০০ বছরেরও বেশি সময় গ্রিস দখলে রেখেছিল। ওই সময় গ্রিকদের ওপর তুর্কিরা যে অপরাধ করেছিল, সে জন্য ইসলাম দায়ী। যেহেতু তুর্কিরা মুসলমান, তাই তাদের অপরাধ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করেছিল।’তাদের বইপুস্তত মতে, ইসলাম আসলে কোনো ধর্ম ছিল না, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নবী মনে করা হতো না। তাঁকে মনে করা হতো বুদ্ধিমান নেতা ও রাজনীতিবিদ। তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের আইন একত্র করে তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণা গড়ে নিয়েছিলেন, বিশ্ব জয় করেছিলেন। স্কুলের বাচ্চাদের তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করতে শেখানো হতো।বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইসলামবিষয়ক অধ্যাপক মার্লিন সোয়াটজের মতে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে ইহুদি জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ তাদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে অসন্তুষ্ট ছিল, ফলে মুসলিম সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছিল। আর মুসলিম শাসনে ইহুদি সংস্কৃতি নতুন করে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র গ্রিসেই ইসলামিক কোর্ট রয়েছে।গ্রিসের পশ্চিম থ্রেসে চলে মুসলিম শাসন, এখানে আছে ইসলামিক কোর্ট।এ অঞ্চল তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে ১৯১৩ সাল থেকে। ৮ বর্গ কিলোমিটারের এ অঞ্চলে বসবাস করে ১ লাখ ২০ হাজার মুসলিম। যাদের অধিকাংশ তুর্কি বংশোদ্ভূত।মুসলিমগণ নিজেদের মধ্যে ইসলামিক আইন প্রয়োগের লক্ষ্যে থ্রেস কর্তৃকপক্ষ একটি আইনও পাস করেছে।আইন অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত মুফতিগণ সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইসলামিক আইন প্রয়োগ করবেন। ১৯৯১ সাল থেকে স্থানীয় মুসলিমগণ বিচারক হিসেবে মুফতি নির্বাচন করেন। তারা আইনপ্রণয়ন ও তারা ইসলামি আদালতগুলো পরিচালনা করে। সরকার তাদের নিয়োগ অনুমোদন করে। তাদের জন্য রয়েছে একাধিক ইসলামিক কোর্ট। গ্রিক আইন অনুযায়ী মুসলিম উত্তরাধিকার বিষয়ে একমাত্র মুফতিরাই সিদ্ধান্ত দিতে পারবে।এতোদিন ইসলামিক আদালতের মুফতিগণ স্বাধীনভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারতো। তবে গ্রিস সরকার আঞ্চলিক বিচারক মুসলিম শাসকদের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এমনকি তারা শতবছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে ইসলামিক কোর্টের ক্ষমতাকে পারিবারিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।নতুন আইন অনুযায়ী পশ্চিম থ্রেসের ইসলামিক আদালত শুধু মুসলমানের পারিবারিক বিষয় সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২৩ সালে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার লুজান চুক্তি অনুযায়ী শরিয়া আইন চালু হয়৷চুক্তি অনুযায়ী, এছাড়াও প্রায় ২০ লাখ অধিবাসী বিনিময় করে তুরস্ক ও গ্রিস, যাতে বাদ পড়েন এবং এই পশ্চিম থ্রেস অঞ্চলের তুর্কি ভাষাভাষী মুসলিমরা৷তুরস্ক সনাতনী গ্রিকদের এবং গ্রিস তুর্কি মুসলিমদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার অধিকার দেয়, যা ঐ চুক্তিতে ছিল৷ শতবর্ষ পুরোনো এই আইন সংস্কার হওয়ায় গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস একে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ' বলে অভিহিত করেছেন৷ বলেছেন, এতে ‘‘সব গ্রিকদের জন্য আইনের সমান অধিকার নিশ্চিত হলো'' এবং একইসঙ্গে গ্রিস সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘‘বিশেষ আইনি ব্যবস্থার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল'' থাকলো৷তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান তো গেল মাসে গ্রিস সফরে অভিযোগই করে বসেছিলেন যে, এথেন্স মুসলিমদের প্রতি চুক্তি মোতাবেক আচরণ করছে না৷
২০১৯ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের দ্বারা প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৩৭% গ্রীক মুসলমানদের পক্ষে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, যেখানে ৫৭% লোকের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ইউরোপের অন্যসব দেশের রাজধানীতে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য মসজিদ অথবা ইবাদতের নির্দিষ্ট স্থান থাকলেও গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির জন্য কোনো মসজিদ নেই।
এথেন্স ইউরোপের একমাত্র রাজধানী যেখানে সরকার স্বীকৃত কোন মসজিদ নেই। গ্রি্সের বৃহত্তর এথেন্স মেট্রোপলিটন এলাকার প্রাচীনতম মুসলিম প্রার্থনা হল বন্ধ রয়েছে।এমএজি অনুসারে, অনুমান করা হয় যে শহরের সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রায় ১০০ টি অস্থায়ী মসজিদ রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই সুন্নি মুসলমানরা পরিচালনা করেন, যদিও কয়েকটি শিয়া মুসলমান দ্বারা পরিচালিত হয়। মসজিদ নির্মাণ নিয়ে এই সংকটের কারণে এথেন্সে মুসল্লিরা বেসমেন্টে, গ্যারেজে, বাড়িতে খোলা জায়গায় প্রার্থনা করেন। এসব ঘর সম্পূর্ণভাবে জানালাবিহীন ও বায়ুহীন। এথেন্সে ওসমানি যুগের শেষ কয়েকটি স্থাপনার অন্যতম হলো- জিসটারাকিস মসজিদ। মুসলিম শাসনের অবসান ঘটলে ঐতিহাসিক এ মসজিদকে কারাগার এবং লোকশিল্প যাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। গ্রিসে ১৮২৯ সালে ওসমানি শাসন অবসানের পর থেকে এথেন্সে আর মসজিদ তৈরি করা হয়নি।ওসমানি শাসন অবসানের পর অর্থোডক্স চার্চ গ্রিসের ধর্মীয় কর্তৃত্ব পায়। সে সময় মসজিদসহ মুসলিম যুগের অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ও চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করা দেওয়া হয়। গ্রিসে এক সময় ছিল মুসলিমদের ঐতিহ্য আর অহংকারের সব স্থাপনা। কিন্তু উসমানী শাসনামলের পতনের পর থেকে সেখানে অনেক মসজিদ হয়েছে নাইট ক্লাব থিয়েটার ও বিনোদনকেন্দ্র। এক কথায় বলা যায় গ্রিসে মুসলিমদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এখন অপমানজনক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। নবায়নের নামে কিছু মসজিদ পরিণত করা হয়েছে চার্চে। ওসমানি সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ছিল ইসলাম।গ্রিসে উসমানী শাসনামলের ১০ হাজারের বেশি ইসলামী স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। আয়া সোফিয়াকে নামাজের জন্য খুলে দেয়ায় গ্রিসের সমালোচনার জেরে অনেকেই দেশটিতে অবস্থিত উসমানী স্থাপনাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।১৪৬৮ সালে গ্রিসের থেসেলোনোকিতে হামজা বে মসজিদটি শুধু নামাজের জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর পর মসজিদের মিনার ভেঙে ফেলা হয়েছে। মিনারের কারুকাজ এবং মূল্যবান পদার্থগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। ধ্বংস করে দেয়া হয় কাঠের মিম্বার। ১৯২৭ সালে গ্রিসের ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানায় আসার পর মসজিদটি বিক্রি করে দেয়া হয়। সেখানে বানানো হয় দোকান ও সিনেমা। ১৯৮০ পর্যন্ত মসজিদটি হল হিসেবে ব্যবহার হয়। লোননিনা প্রদেশের নাদরা অঞ্চলের ফায়েক পাশা মসজিদও গির্জায় পরিণত করা হয়। ১৯৭০ সালে মসজিদটিকে বানানো হয় বিনোদনকেন্দ্র। বর্তমানে মসজিদটি পরিত্যক্ত পড়ে আছে।একইভাবে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মসজিদগুলো পরিত্যক্ত। উসমানী শাসনের পরে রাজধানী এথেন্সের সবচেয়ে পুরনো মসজিদটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। যার মধ্যে সেনাবহিনীর কারাগার এবং স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করার মতো ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেন, গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের সব মসজিদ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। একটি মসজিদও অবশিষ্ট নেই। তিনি ইস্তাম্বুলে একটি হাসপাতাল উদ্বোধনের সময় এ কথা বলেন।২০১৬ সালে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে মসজিদ নির্মাণের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর এর মাধ্যমে প্রায় দুইশ’ বছর পর এথেন্সে মসজিদ নির্মাণের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।গ্রিস সরকার এথেন্সে মসজিদ নির্মাণের একটি বিল অনুমোদন করে। প্রায় এক দশক ধরে মসজিদটি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ জন্য ৯ লাখ ৪৬ ইউরো সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়। গ্রিক নৌবাহিনীর অব্যবহৃত ঘাঁটিতে এ মসজিদ নির্মনের কথা। এথেন্স থেকে দূরবর্তী একটি শিল্প এলাকায় মসজিদটি নির্মিত হবে বলে অনেক মুসলমানই অভিযোগ করেন। তারা গ্রিসের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে মসজিদ নির্মাণের দাবি জানিয়েছিলেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল