সিসিলি থেকে মুসলমানদের করুণ বিদায়






 

মো আবু রায়হানঃএক সময় ভারত ,স্পেন ,সিসিলি ,ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিশাল অঞ্চল মুসলমানরা কয়েক শতাব্দী ধরে শাসন করেছেন। কিন্ত আজ ভারত ,স্পেন ,সিসিলি ,ফিলিপাইনে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকলেও তারা অসহায় , নিপীড়িত ও সংখ্যলঘিষ্ঠ ।সিসিলি হল ভূমধ্যসাগরের সর্ববৃহৎ দ্বীপ। এটি পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট দ্বীপসমূহ নিয়ে ইতালির একটি সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, যা সিসিলিয়ান অঞ্চল নামে পরিচিত। দ্বীপের মোট আয়তন ২৫৭১১ কিলোমিটার ।সিসিলি ইতালীয় উপদ্বীপের দক্ষিণে, ভূমধ্যসাগরের মাঝ বরাবর অবস্থিত, যা মূল ভূখণ্ড থেকে মেসিনার সংকীর্ণ প্রণালী দ্বারা পৃথক হয়েছে। সিসিলি এবং দক্ষিণ ইতালিতে ইসলামের ইতিহাস শুরু হয়েছিল আরব বন্দোবস্ত দিয়ে, মাজারাতে, যা ৮২৭ সালে দখল করা হয়েছিল। সিসিলি ও মাল্টার পরবর্তী শাসন দশম শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল। সমস্ত সিসিলির উপর মুসলিম শাসন ৯০২ সালে শুরু হয়েছিল এবং সিসিলির আমিরাত ৮৩১ থেকে ১০৬১ অবধি স্থায়ী ছিল। The Muslim conquest of Sicily began in June 827 and lasted until 902, when the last major Byzantine stronghold on the island, Taormina, fell. Isolated fortresses remained in Byzantine hands until 965, but the island was henceforth under Muslim rule until conquered in turn by the Normans in the 11th century. মুসলিমদের সিসিলি বিজয় ৮২৭ সালের জুন মাসে শুরু হয় এবং ৯০২ সালে দ্বীপের শেষ প্রধান বাইজেন্টাইন দুর্গ তাওরমিনার পতন হওয়া অবধি স্থায়ী হয়। বিচ্ছিন্ন দুর্গগুলো ৯৬৫ সাল অবধি বাইজেন্টাইনদের হাতে ছিল। তবে ১১শ শতাব্দীতে নর্মানদের দ্বারা দখল না হওয়া পর্যন্ত দ্বীপটি মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল।সিসিলির মাধ্যমে মুসলিম বাহিনী ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের রাজধানী রোমের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়।এ্ই দ্বীপটি বিভিন্ন সভ্যতার মুখোমুখি হয়েছে। ফিনিশিয়, গ্রীক, রোমান প্রভৃতি সভ্যতার লোকেরা আবাস গড়েছিল এই দ্বীপে। একইসাথে আরব-মুসলিম সভ্যতাও যে এই দ্বীপে ঠিকানা করে নিয়েছিল, এই তথ্যটি অধিকাংশেরই অজানা।আন্দালুসিয়ার মতই মুসলিম শাসনাধীন সিসিলি তৎকালীন বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।এটিও ছিল ইউরোপীয় রেনেসার অন্যতম কেন্দ্রভূমি। প্রায় তিন শতাব্দীকাল মুসলিমরা শাসন করে এটি। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানকার স্থাপত্য-ঐতিহ্যে ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে রয়ে গেছে মুসলিমদের আগমনের ছাপ। সিসিলির দ্বীপ দিয়েই মুসলিমদের তৈরি জ্ঞান-বিজ্ঞান পৌঁছে যেত ইউরোপের বুকে।আরব, অনারব, মুসলিম, অমুসলিম সকলেই এখানে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের অনুসন্ধানে ভ্রমণ করতেন।আরব মুসলমানদের সংস্কৃতির প্রভাব এই দ্বীপে এতো অধিক ছিলো যে, তাদের পরবর্তীতে যারাই এখানকার শাসন ক্ষমতায় এসেছিলো, তারা সকলেই এই সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিলো।এখানে মুসলিমদের আগমন যেমন অপ্রত্যাশিত ছিল তেমনি প্রস্থানও ছিল খুবই হূদয়বিদারক।

মুসলমানদের পূর্বে ভূমধ্যসাগরীয় কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপটিতে রোমান বাইজানটাইন সাম্র্রাজ্যের সামরিক কেন্দ্র ও নৌঘাটি ছিল। এখান থেকেই রোমানরা মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলসমূহে আক্রমণ করতে সক্ষম ছিল। সে প্রেক্ষিতে সিসিলির রোমান সামরিক অবস্থান ছিল মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য হুমকির কারণ।রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসলাম আরব উপদ্বীপের বাইরে ছড়িয়ে পরে। ৭১১ সালের মধ্যে মুসলমানরা স্পেন (আন্দালুসিয়া) জয় করে ফেললেও সে তুলনায় সিসিলির মুসলিম শাসনাধীনে আসার ইতিহাস আরো অনেক পরের।৬৫২ সাল হতেই সিসিলি জয়ের জন্য অভিযানের সূচনা হয়।৬৫২ সালে খলীফা হযরত উসমান (রা.) এর সময় প্রথম মুসলিম নৌবাহিনী গঠিত হয়। দামেস্কের গর্ভনর মুয়াবিয়ার তত্ত্বাবধানে এই নৌবাহিনী গঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে সিরিয়া ও মিসরের সমূদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহকে রোমান আক্রমণ হতে রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই নৌবাহিনী গঠিত হলেও পরবর্তীতে নৌযুদ্ধের জন্য এই বাহিনীকে কাজে লাগানো হতো৬৬২ সালে প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়াবিয়া উত্তর আফ্রিকায় বিজয়াভিযানে বের হলে, রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কন্সটান্টটাইন তার রাজধানী কন্সটান্টিনোপল ছেড়ে দক্ষিণ ইতালীর সিসিলিতে এসেছিলেন, যেনো তিনি তার সাম্রাজ্যের অংশে সহজেই মনোযোগ দিতে পারেন। তাছাড়া সম্ভাব্য আরব আক্রমণ হতে এই অঞ্চলে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার চিন্তা করেন।
৬৮১ সালে আরব মুসলিমরা উত্তর আফ্রিকার বার্কা দখল করে নিলে রোমানরা সিসিলি দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করে। ৬৮৩ সালে উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে মুসলমানরা কার্থেজ (তিউনিস) দখল করে। এটি বিজয় ছিল রোমানদের জন্য একটি বড় আঘাত ।৬৯৭ সালে স্থানীয় বার্বারদের বিদ্রোহে রোমানরা কার্থেজ পুনরায় দখলের প্রয়াস পায়। আরব শাসনের বিরোধিতা করে কিছু বার্বার গোত্র বিদ্রোহ করলে সিসিলি থেকে রোমানরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ৬৯৭ সালে রোমানরা কার্থেজ মুসলমানদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ৬৯৮ সালে খলীফা আবদুল মালিক এই বিদ্রোহ দমনের জন্য তার সেনাপতি হাসান ইবনে নুমানকে প্রেরণ করলে তিনি কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেন এবং সমগ্র উত্তর আফ্রিকা হতে রোমানদের বিতাড়িত করেন।আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর রশিদ ৮০০ সালে আফ্রিকা অঞ্চলের তিউনিসিয়ার গভর্নর হিসেবে ইবরাহিম বিন আগলাব তামিমিকে নিযুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র জিয়াদাতুল্লাহ বিন ইবরাহিম ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জিয়াদাতুল্লাহ ছিলেন বিচক্ষণ, রণকৌশলী ও তীক্ষ মেধার অধিকারী। সেনাবাহিনীর কারো বিদ্রোহের ইচ্ছা থাকলে তিনি আগেই তা উপলব্ধি করতে পারতেন। সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখতে রোম সাম্রাজ্যের উপকূলবর্তী সিসিলি দ্বীপের একটি অংশ সারিদানিয়া দখল করতে পাঠান। সেনাবাহিনী তা জয় করে ফিরে আসে। বিচক্ষণ সেনানায়ক জিয়াদাতুল্লাহ ইতালিতে মুসলিমদের আবাস গড়ে তোলার সুযোগ খুঁজছিলেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপগুলো বিজয় হওয়ায় প্রাথমিকভাবে তিনি বেশ সফল ছিলেন।৮২৭ সালে, যখন দ্বীপের নৌবহরের কমান্ডার ইউফিমিয়াস বাইজেন্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় মাইকেলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জেগে ওঠেন। অনুগত বাহিনী দ্বারা পরাজিত এবং দ্বীপ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউফিমিয়াস আগলাবিদের সাহায্য চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ৮১৭ সালে বাইজেন্টাইনদের সাথে স্বাক্ষরিত এক শান্তিচুক্তি যা আপাতদৃষ্টিতে তখনও বহাল ছিল, এর কারণে আগলাবের আমীর জিয়াদ শুরুতে ইউফিমিয়াসকে সাহায্য করতে ইতস্তবোধ করেন। এ সময় আগলাবী আমিরাতের অত্যন্ত প্রভাবশালী আলেম ও প্রসিদ্ধ ইসলামী আইনজ্ঞ আসাদ আলফুরাত যিনি ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ আশ শাইবানীর সহপাঠী ছিলেন, আমীর যিয়াদকে এই যুক্তি দেখান যে, বাইজেন্টাইনরা বেশকিছু মুসলিম ব্যবসায়ীকে অপহরণ করায় বাইজেন্টাইনদের সাথে সাক্ষরিত চুক্তিটি ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এ যুক্তি আমীর জিয়াদের খুব পছন্দ হল।৮২৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস। আসাদ আল ফুরাতের নেতৃত্বে প্রায় ১০,০০০ সৈন্যের মুসলিম সেনাবাহিনী উত্তর আফ্রিকা ত্যাগ করে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে যায়।দ্বীপে আরবদের অবতরণের পর, ইউফিমিয়াস দ্রুত পাশ কাটিয়ে যান। দ্বীপের রাজধানী সিরাকিউসে একটি প্রাথমিক আক্রমণ ব্যর্থ হয়, কিন্তু মুসলমানরা পরবর্তীতে বাইজেন্টাইনদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এবং কিছু দুর্গ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ইফ্রিকিয়া এবং আন্দালুসের সহায়তায় ৮৩১ সালে তারা পালের্মো দখল করে নেয়, যা নতুন মুসলিম প্রদেশের রাজধানী হয়ে ওঠে। কিন্তু এ বিজয়ের পরপরই কনস্টান্টিনোপল থেকে খ্রিস্টানদের অনেক সাহায্য আসে। অতঃপর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। তাতে সেনাপতিসহ অনেকেই শাহাদাতবরণ করেন। কিন্তু মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। অনেক বছর যুদ্ধ করার পর অবশেষে মুসলিমরা ৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পুরো সিসিলি দ্বীপ জয় করে। এর পর থেকে মুসলিম সেনাবাহিনী ইতালিতে বিভিন্ন সময় আক্রমণ করতে থাকে।মুসলিম শাসনামলে সিসিলি সমৃদ্ধি লাভ করে এবং অবশেষে ইফ্রিকিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি আধা-স্বাধীন আমিরাত গঠন করে।

সিসিলির আমিরাত একটি ইসলামী রাজ্য যা সিসিলি দ্বীপটিতে ৮৩১ থেকে ১০৯১ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল। এর রাজধানী ছিল পালের্মো যা এই সময়কালে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠে। সিসিলিতে সরকারী শাসনব্যবস্থা আগলাবি আমিরাতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই নির্ধারণ করা হয়। প্রদেশটি একটি গভর্নর দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে যিনি নামে মাত্র কায়রাওয়ানের আগলাবি আমিরের অধীনস্ত ছিলেন, কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মোটামুটি স্বাধীনভাবেই শাসন করতেন)। মুসলিমরা কাজী এবং স্কলারদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী আইন অনুসরণ করতেন। আর খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা জিযিয়া এবং ভূমিকর দেয়ার শর্তে নিজেদের ধর্মীয় আইন অনুসরণ করার স্বাধীনতা পায়। অন্যদিকে মুসলিমদের দিতে হতো যাকাত এবং ভূমিকর। আমিরাত দ্বারা দুই শতাব্দীর ইসলামি শাসন আধুনিক সিসিলিতে কিছু চিহ্ন রেখে গেছে। ৯০৯ সালে ইফ্রিকিয়ার মতো সিসিলিও ফাতিমীয় খিলাফতের অধীনে চলে যায়। শুরু থেকেই সিসিলি আমিরাতের সাথে উত্তর আফ্রিকা সরকারের যোগসূত্র ছিল। ৯০৯ সালে উত্তর আফ্রিকার কায়রাওয়ান দখলের মাধ্যমে আগলাবি রাজবংশের পতন ঘটে এবং শিয়া ফাতিমিয় শাসনের সুচনা হয় । আবদুল্লাহ আল-মাহদি ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে নেয়।শিয়ারা ক্ষমতা দখলের পর সিসিলির নেতারা ভাবলেন শিয়াদের সাথেও হয়তো সম্পর্কটা এমন কিছুই হবে। তাই সিসিলির অভিজাত শ্রেণী তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ফাতিমিয় শিয়াদের সাথে দেখা করে নিজেদের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তা না করে শিয়ারা উত্তর আফ্রিকায় তাদের জালে বন্দী করে। এর বদলে আল-মাহদী সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ শাসনের জন্য ইমামের নামে শিয়া গভর্নর এবং কাজী পাঠায়।বিদ্রোহী আচরণ ও মনোভাবের জন্য খ্যাত সিসিলির জনসাধারণকে দমিয়ে রাখার জন্য নতুন ফাতিমিয় সরকার বেশকিছু কঠোর নীতিমালা ও আইন জারী করে। জনগণের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে সরকার ‘খুম্‌স’ নামক এক ধরনের নতুন কর জারী করে যার ফরমান হলো আয়ের ১/৫ অংশ সরাসরি ফাতিমিয় ইমামের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। এর ফলে সুন্নি জনসাধারণের সাথে সরকারের বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ফলাফলস্বরূপ সাথে সাথেই প্রথম ফাতেমীয় গভর্নরের পতন হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। এর পরপরই ৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নতুন আরেক বিদ্রোহ গোটা দ্বীপপুঞ্জে ফাতেমীয় প্রভাব কয়েক বছরের জন্য খর্ব করে দেয়। তবে ৯১৮ তে ফাতেমীয়রা নির্মমভাবে তা দমন করে। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে আগ্‌রিজেন্তো শহরে আরো একটি বিদ্রোহের উত্থান হয়। পুরো দ্বীপপুঞ্জের জনসাধারণ এই বিদ্রোহের সমর্থন দেয়া শুরু করে ৯৩৯ সালথেকে। আবারো এক ফাতিমিয় অভিযানের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করা হয়, গণহত্যা চালানো হয় বিভিন্ন শহরে। এতে শহরগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। শহরগুলো পুনরায় জনপূর্ণ করতে ফাতিমিয়রা উত্তর আফ্রিকা থেকে ফাতেমীয় সরকারের অনুগত নতুন অভিবাসীদের নিয়ে আসে।দ্বীপপুঞ্জে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ৯৬৪ সালে ফাতিমিয়রা আল-হাসান আল-কাল্‌বী নামক ফাতেমীয় ইমামের অনুগত এক সামরিক ব্যক্তিকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। তার মাধ্যমে দ্বীপপুঞ্জে নতুন এক রাজবংশের অভিষেক ঘটে যার বংশধরেরা ফাতেমীয়দের অনুগত থেকে পরবর্তী শত বছর শাসনকার্য চালায়।সিসিলিতে কাল্‌বী শাসনামলের সময় মুসলিমরা সর্বশেষ খ্রিস্টান অঞ্চল জয় করলেও দ্বীপপুঞ্জে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ থামেনি। সুন্নিদের উপর ফাতিমিয়দের নির্যাতন দ্বীপপুঞ্জের বেশীরভাগ মানুষ সহ্য করে গেলেও, স্থানীয় মুসলিম, উত্তর আফ্রিকার আরব এবং আমাজিগ অভিবাসীদের মধ্যে অব্যহত উত্তেজনার ফলে সামাজিক বিভাজন বড় আকার ধারণ করে।সামরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মধ্য ভূমধ্যসাগরে সিসিলির পতন শুরু হয় কাল্‌বী শাসনামল থেকে। ১১শ শতকের শুরুর দিকে ইতালিয় উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের বাইজেন্টাইন চৌকিগুলোতে সামরিক অভিযান চালানোর ঝোঁক আর কাল্‌বী আমীরগণদের মাঝে ছিলনা। জনসাধারণও অলস হয়ে পড়ে, আর বেশীরভাগ পুরুষই সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান থেকে নিষ্কৃতি পেতে দেন-দরবার শুরু করে।
মধ্যযুগীয় সময়কালে ইসলামী বিশ্ব তার সাংস্কৃতিক শিখরে ছিল, আল-আন্দালুস, সিসিলি এবং লেভেন্টে ক্রুসেডার রাজ্যগুলির মাধ্যমে ইউরোপকে তথ্য এবং ধারণা সরবরাহ করত। সিসিলি বাণিজ্য এবং কৃষিকাজ সমৃদ্ধ হয়েছিল এবং পালের্মো ইউরোপের বৃহত্তম এবং ধনী শহরগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছিল। সিসিলি বহুজাতিক ও বহুভাষিক হয়ে ওঠেন, একটি পৃথক আরব-বাইজেন্টাইন সংস্কৃতি বিকাশ করে যা এর ইসলামিক আরব এবং বার্বার অভিবাসীদের উপাদানগুলিকে স্থানীয় গ্রীক এবং লাতিন খ্রিস্টান এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের সাথে একত্রিত করে। সিসিলিয়ান ভাষা এবং স্থানীয় জায়গার নামগুলিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক আরবি প্রভাব রয়েছে; সিসুলো-আরবি থেকে উদ্ভূত মাল্টিজ ভাষায় অনেক বেশি প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য সাংস্কৃতিক অবশিষ্টাংশগুলি দ্বীপের কৃষি পদ্ধতি এবং ফসল, স্থানীয় খাবার এবং আর্কিটেকচারে পাওয়া যায়।দীর্ঘ আরব-বাইজেন্টাইন সংগ্রাম দ্বীপের পরবর্তী ইতিহাসে স্থায়ী চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। মুসলিম শাসনামলে সিসিলিয় সংস্কৃতি দ্রুত আরবীয় হয়ে ওঠেছিল কিন্তু মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ইসলামীকরণের ব্যাপক বিরোধিতা করেছিল।সিসিলি মুসলিম সাম্রাজ্যের অংশ ছিলেন এবং বিজ্ঞান ও চারুকলার পাঠদানের জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ উচ্চমানের সভ্যতার বিকাশে পিছিয়ে ছিলেন না। মূল ভূখণ্ড ইতালির সান্নিধ্যের কারণে এটি ইউরোপে আরবি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আরব যুগের (৮২৭-১০৯১) এবং নরম্যান এক (১০৯১-১১৯৪) সিসিলি স্পেনের পরে আরব-ইসলামিক সভ্যতা এবং ইউরোপের মধ্যে একটি সেতু ছিল।মুসলিম আমলে পালেরমো বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষার একটি প্রধান শহর ছিল। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শহর হয়ে ওঠে। মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা মিলেমিশে ও শান্তিতে একসাথে বসবাস করায় এটি সমৃদ্ধি ও সহনশীলতার সময় ছিল। দ্বিতীয় রজারের শাসনামলে সিসিলি একটি ক্লিয়ারিং হাউসে পরিণত হয় যেখানে পূর্ব ও পাশ্চাত্য পন্ডিতরা ইউরোপকে জাগ্রত করতে এবং নবজাগরণের আগমনকে হেরাল্ড করার মত ধারণাগুলি বিনিময় করে। আরবি বিজ্ঞান সিসিলি থেকে ইতালি এবং তারপরে পুরো ইউরোপে চলে যায়।সিসিলিতে আরব উপস্থিতি ছিল শৈল্পিক ক্রিয়াকলাপের অনুপ্রেরণা যা নরম্যান সিসিলির বৈশিষ্ট্যযুক্ত। কার্যত সমস্ত স্মৃতিসৌধ, ক্যাথেড্রাল, প্রাসাদ এবং দুর্গগুলি নরম্যানদের অধীনে নির্মিত আরব ছিল এই অর্থে যে কারিগররা আরব ছিলেন, যেমন স্থপতি ছিলেন। ফলস্বরূপ, বেশ কয়েকটি ইতালীয় শহরে আর্কিটেকচারে আরবি প্রভাব দেখা যায়। আরবরা অনেকগুলি নতুন ফসলের সূচনা করেছিল: তুলো, শাঁস, খেজুর, আখ, আখ, ফলমূল এবং ফলমূল সহ। সিসিলিতে আনা নতুন সেচ কৌশল দ্বারা এই ফসলের চাষ সম্ভব হয়েছিল।কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব টেক্সটাইল, চিনি, দড়ি তৈরি, ম্যাটিং, সিল্ক এবং কাগজ সম্পর্কিত অনেকগুলি শিল্প তৈরি করে। অন্যান্য শিল্পের মধ্যে রয়েছে গ্লাস, সিরামিকস, মোজাইক, অস্ত্র এবং যুদ্ধের ইঞ্জিন, জাহাজের বিল্ডিং এবং সালফার, অ্যামোনিয়া, সীসা এবং আয়রনের মতো খনিজগুলির উত্তোলন।সিসিলির মূল ভূখণ্ডের ইতালির সান্নিধ্য এটিকে মুসলিম স্পেনের সাথে একত্রে তৈরি করেছিল, যা বেশ কয়েকটি শিল্প প্রযুক্তি যেমন ইতালীয় শহরগুলিতে যেমন কাগজ এবং সিল্ক তৈরির স্থানান্তরিত করেছিল।একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বা দ্বাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিম সিসিলিতে সেরিকালচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে রেশম টেক্সটাইলগুলি মূলত লুক্কা এবং বোলগনায় ইতালীয় মূল ভূখণ্ডে বোনা হয়েছিল। এই দুটি ইতালীয় শহর ইউরোপের প্রথম সিল্ক নিক্ষেপ মেশিনের সাইটও ছিল, এটি সিসিলির আরব থেকে স্থানান্তরিত একটি প্রযুক্তি।মুসলিম শাসনকালে সামাজিক ও স্থাপত্যগত উন্নতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষক ও মসজিদের সংখ্যা ছিল অন্য শহরের চেয়ে অনেক বেশি।বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী হওয়ায় সিসিলির অধিবাসীরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ইসলামের প্রতি ছিল খুবই নিষ্ঠাবান। ইতালিসহ অনেক অঞ্চলের সম্রাট মুসলিমদের সামাজিক প্রীতিবন্ধন উন্নয়ন সভ্যতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। সিসিলির দ্বীপ দিয়েই জ্ঞানের আদান-প্রদান হতো। প্রবীণ খ্রিস্টানরা মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বাদ আহরণ করত। ভূগোলবিদ ইবনে হাওকাল তাঁর ‘সুরাতুল আরদ’ চতুর্দশ শতকের সিসিলির মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তাকে মুসলিম কর্ডোবার সঙ্গে তুলনা করেন। অসংখ্য মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখতে পান। শুধু পালেরমো শহরে দুই শতাধিক মসজিদ ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। এখনো সিসিলির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, বিচারব্যবস্থায় মুসলিম শাসনের ছাপ স্পষ্ট।

ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সিসিলির সর্বদা সংঘাত লেগে থাকত। এক শতাব্দী পর থেকে সিসিলির বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ও সংঘাত দেখা দেয়। অন্যদিকে ফাতেমিরা মিসরের কায়রোয় চলে যায়। আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জ্বলে হত্যা, লুণ্ঠন ও বিদ্রোহের আগুন। একসময় তিউনিসিয়া থেকেও সিসিলিতে আসা সহযোগিতা বন্ধ হয়ে পড়ে। তাই সিসিলিতে মুসলিম বাহিনীর সাহায্য পৌঁছা এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থা অনেকটা আন্দালুসের শেষ অবস্থার মতো হয়ে পড়ে। একেকটি অঞ্চল একেকজন দখল করতে থাকে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, কোনো বড় শাসক অন্যের কাছে পরাজিত হলে সে ইতালির নরমান শাসকদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিসিলি অঞ্চল দখল করে নেয় ইতালীয় সম্রাট। প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিমদের শাসন চললেও ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে এটি পুরোপুরি ইতালির দখলে চলে যায়।রজার প্রথমের অধীনে খ্রিস্টান নরম্যান ভাড়াটেরা শেষ পর্যন্ত এই দ্বীপটি জয় করেছিল এবং ১০৭১ সালে সিসিলি কাউন্টি প্রতিষ্ঠা করেছিল; দ্বীপের সর্বশেষ মুসলিম শহর নোটো ১০৯১ সালে সিসিলিতে ইসলামী শাসনের সমাপ্তি চিহ্নিত করে পতিত হয়। নরম্যানদের বিজয়ের সময়ও দ্বীপপুঞ্জের বেশির ভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী ছিল। ১১৩০ থেকে ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা ‘দ্বিতীয় রজার’-এর শাসনামল ভালোই ধর্মসহিষ্ণু ছিল। এ সময়ই বিখ্যাত ভৌগোলিক আল-ইদ্রিসি তাঁর বিশ্ব মানচিত্রাবলি(world atlas) ও ‘নুজহাত আল-মুশতাক ফি ইখতিরাকিল আফাক’ (The Book of Pleasant Journeys into Faraway Lands) রচনা করেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনে চলমান ধর্মযুদ্ধের রেশ এসে পরে সিসিলিতে। ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে পালেরমোর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে ‘পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট’ সিসিলির মুসলিমদের দেশের জন্য‘hostile elements’ (দেশের শত্রু) হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে ১২০০ ও ১৩০০ শতকে মুসলিমদের জোর করে নির্বাসনে পাঠানো হয় আর স্বেচ্ছায় নির্বাসনও চলতে থাকে। অবশেষে ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের সর্বশেষ মুসলিমদের জোর করে সিসিলি ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। আন্দালুসের প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে জুবাইর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় উইলিয়ামের সময়ে সিসিলিতে মুসলিমদের গণহত্যা, নিপীড়ন, মসজিদ গির্জায় পরিণত করা, নামাজে বাধা প্রদানসহ নানা রকম কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে দেখেন। এমনকি নিপীড়িতদের অনেকে দূরবর্তী মুসলিম অঞ্চলে গিয়ে মুক্ত জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে চাইত। অনেকে কোনো মুসলিম মুসাফির দেখলে নিজের কন্যাকে নিরাপদ থাকার আশায় তাদের হাতে তুলে দিতে চাইত। সিসিলির বিভিন্ন স্থানে অনেক বছর পর্যন্ত কিছু মুসলিম থাকলেও অবশেষে রোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সম্রাট ফ্রেডেরিক পুরো সিসিলিকে মুসলিমমুক্ত করেন।একাদশ শতাব্দীর শুরুতে আমিরাত অভ্যন্তরীণ কলহ এবং বংশীয় বিরোধ থেকে ভাঙন শুরু করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, সিসিলিতে প্রায় চারশত বছরের ইসলামিক উপস্থিতির অবসান ঘটিয়ে মুসলমানরা যারা ইতোমধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করেনি বা খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত হয়নি তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল