গির্জা থেকে মাদ্রাসা নিরাপত্তা কোথায় ?
#মো.আবু রায়হান
গির্জায় যাজকদের দ্বারা নানরা যৌন নিপীড়নের শিকার হন তা প্রতিদিনের চিত্র ।কিন্তু মসজিদ মাদ্রাসায় ইমাম ,মাদ্রাসার শিক্ষকদের দ্বারা শিশু ধর্ষণ ও বলৎকারের শিকার হওয়ার সংবাদ পত্রিকায় আসায় দেশের মানুষ একই সঙ্গে বিক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন।গির্জার নানরা যাজকদের কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে স্বীকার করেন পোপ ফ্রান্সিস। পোপ ফ্রান্সিসের কথায় উঠে আসে যে যৌন নিপীড়নের শিকার নানদেরকে যৌনদাসী করে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনায় পোপ ফ্রান্সিসের পূর্বসূরি পোপ বেনেডিক্ট পুরো একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন । পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, নানদের ওপর যৌন নিপিড়নের এখনো গির্জার একটি অব্যাহত সমস্যা, তবে কয়েকটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানেই এগুলো ঘটছে, বিশেষ করে নতুনদের ক্ষেত্রে। আমি মনে করি, এটা এখনো ঘটছে। ধারণা করা হচ্ছে, গির্জার নানরা যে যাজকদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, সেটা এই প্রথমবারের মতো স্বীকার করলেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বলেছিলেন, এই সমস্যাটি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে গির্জা, তবে এসব ঘটনা এখনো ঘটছে।গত বছর মধ্যপ্রাচ্যে একটি ঐতিহাসিক সফরের সময় সাংবাদিকদের পোপ ফ্রান্সিস বলেন, নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসাবে দেখার প্রবণতাটি এখনো গির্জায় একটি সমস্যা হিসাবে রয়ে গেছে।তিনি বলেন, `যাজক এবং বিশপরা নানদের নিপীড়ন করে। তবে গির্জা এখন এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে সতর্ক হয়েছে এবং এটি বন্ধে কাজ করছে।বেশ কয়েকজন যাজককে বরখাস্ত করা হয়।পোপ বেনেডিক্ট সাহস নিয়ে নারীদের একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কারণ সেখানে যাজক বা প্রতিষ্ঠাতাদের হাতে নারীদের নিপিড়নের বিষয়টি যৌন দাসত্বে রূপ নিয়েছিল।
ক্যাথলিক গির্জার নানদের বৈশ্বিক সংগঠন জানায়, `ভয় ও নীরবতার সংস্কৃতির` কারণে নানরা গির্জার এই যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারেননি।জানা গেছে, পোপ বেনেডিক্ট ২০০৫ সালে ফ্রান্সের কম্যুনিটি অফ সেন্ট জেন নামে নারীদের একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি রোমান ক্যাথলিক পত্রিকার কাছে স্বীকার করে যে, যাজকরা বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে এমন আচরণ করেছে, যা তাদের কৌমার্য রক্ষার ব্রতের সঙ্গে খাপ খায়না।ভারতে আরেকটি ঘটনায় গতবছর একজন বিশপকে গ্রেপ্তার কার হয়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একজন নানকে ১৩বার ধর্ষণ করেছেন। যদিও ওই যাজক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।গত বছর চিলিতে যাজকদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন গির্জার নানরা। এরপর তদন্ত শুরু করে ভ্যাটিকান।এ বিষয়ে ভ্যাটিকানের নারীদের ম্যাগাজিন, উইমেনস চার্চ ওয়ার্ল্ড বলছে, অনেক ঘটনায় নানরা ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়েছেন।
রাজশাহীর তানোরে গির্জায় এক কিশোরীকে তিনদিন আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ফাদার প্রদীপ গ্রেগরিকে গ্রেফতার করে র্যাব। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পরিবার জানায়, ওই কিশোরী সকালে গির্জার পাশে ঘাস কাটতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে পরদিন তানোর থানায় জিডি করা হয়।গির্জার ফাদার প্রদীপের ঘরে ওই কিশোরী বন্দি আছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় এক ছাত্রকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে নাসির উদ্দিনকে নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নাসির রাঙ্গুনিয়া উপজেলার আহমদিয়া আজিজুল উলুম মাদ্রাসার হোস্টেল সুপার ।ওই শিক্ষক মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকা শিশুদের বিভিন্ন সময়ে শারীরিক নির্যাতন চালাতেন। শিক্ষকের ভয়ে শিক্ষার্থীরা কোন অভিযোগ করেনি। সম্প্রতি চারজন শিশুর অভিভাবক রাঙ্গুনিয়া থানায় অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে নাসিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের কথা নাসির স্বীকার করেছেন।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, নাসির দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসার হোস্টেলে এ অপকর্ম করে আসছেন। ছেলে শিশুদের ব্যাপারে তার আসক্তি থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতেন। কোনো শিশু শিক্ষার্থী তার অপকর্মে রাজি না হলে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন নাসির। বিভিন্ন মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের খবর সংবাদমাধ্যমে আসায় বিশ্লেষকরা পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছেন। চলতি মাসে জয়পুরহাট সদর উপজেলায় একটি নুরানী মাদ্রাসায় চারজন কন্যাশিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনে তাদের অভিভাবকরা মামলা দায়ের করেন । সেই মামলায় অভিযুক্ত মাদ্রাসাটির শিক্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। প্রতি রাতেই এক একজন শিশুকে বিছানায় ডেকে নিয়ে সে বলাৎকার করতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।জয়পুরহাটের ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি দেশের আরও কয়েকটি জায়গায় মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে।এরমধ্যে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় একটি মহিলা আবাসিক কওমী মাদ্রাসায় ১৩ বছর বয়সী এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসাটির হোস্টেল সুপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকদিন আগে।ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি মাদ্রাসার দু'জন ছাত্রকে বলাৎকার করার অভিযোগে সেই মাদ্রাসার একজন শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই ঘটনাগুলোতে পুলিশ এখন তদন্ত করছে।
শুধু মাদ্রাসা বা ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র নয়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা যে জায়গাই হোক, এটা উদ্বেগজনক ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটা চরম ঘৃণিত অপরাধ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, স্থান কাল পাত্র নয়, অপরাধীকে অপরাধের দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে হবে। অপরাধীকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্র বা সমাজের দায়িত্ব।
ইসলাম শিশু ও নারী নির্যাতন দমনে শাস্তির নির্দেশনা আরও কঠোর। বিশেষত শিশু নির্যাতনকে ইসলাম জঘন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। কারণ শিশুর প্রতি স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসাই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ করে না সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়। ’(আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৪৩)শিশুর সঙ্গে স্নেহশীল আচরণ ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্য। নিজের সন্তানের সঙ্গে সুন্দর আচরণ না করায় মহানবী (সা.) এক পিতাকে ভর্ৎসনা করেন। শিশুরা ভুল করলে প্রহার করা ও বকাঝকার বদলে সুন্দর আচরণ ও উত্তম উপদেশ দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। মায়া-আদরের মাধ্যমে শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও এই নীতি অনুসরণ করতেন। আনাস (রা.) তার শৈশবের দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর সেবায় কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার কোনো কাজে আপত্তি করে তিনি কখনো বলেননি ‘এমন কেন করলে বা এমন কেন করলে না’। ”(মুসলিম, হাদিস: ২৩০৯)নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনও পুরুষ কোনও নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
শিশু নির্যাতনকে ইসলামে ভয়াবহ ‘সন্ত্রাস’ ও বিশৃঙ্খলা অভিহিত করা হয়েছে। ইসলামী আইনে শিশুর ধর্ষণকারীর আরও কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। মিসরের দারুল ইফতা শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন ও সহিংসতাকে কোরআনে বর্ণিত ‘ইহরাব’ ও ‘ফাসাদ ফিল আরদ’ (চরম সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা)-এর অন্তর্ভুক্ত বলেছে। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বলেও তারা মত দিয়েছে। তারা পবিত্র কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হলো, তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে বা বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে ফেলা হবে কিংবা তাদের দেশান্তর করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৩৩)দারুল ইফতার ফতোয়ায় বলা হয়েছে, এই আয়াত বিশ্লেষণ করলে শাস্তির যেসব কারণ পাওয়া যায়, তার সবগুলো শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন ও সহিংসতার মধ্যে প্রমাণিত হয়। যেমন—আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা, দুর্বলের প্রতি অত্যাচার, সমাজে ভয় ছড়ানো, সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করা, মানুষের জীবন ও সম্পদের প্রতি হুমকি তৈরি, মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা ইত্যাদি। যেহেতু পূর্বসূরি ফকিহরা এই আয়াতের আওতাধীন অপরাধীদের ক্ষেত্রে ‘তাজির’ তথা শাস্তি প্রয়োগে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার স্বাধীনতা রয়েছে বলে মত দিয়েছেন, তাই শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন বন্ধেও রাষ্ট্র কর্তৃক দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির বিধান করতে পারেন। তবে তা করতে হবে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার পর। হজরত নাফি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, ‘(হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে) এক ব্যক্তি এক কুমারী মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। লোকজন ধর্ষণকারীকে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে উপস্থিত করলে সে (ধর্ষক) ব্যভিচারের কথা অকপটে স্বীকার করে। লোকটি ছিল অবিবাহিত। তাই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্দেশ মোতাবেক লোকটিকে বেত্রাঘাত করা হলো। এরপর তাকে মদিনা থেকে ফাদাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।’ (মুয়াত্তা মালিক)
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে সরকারি মালিকানাধীন (কাজে নিযুক্ত) এক গোলাম এক দাসির সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে ওই দাসির কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ওই গোলামকে কষাঘাত (বেত্রাঘাত) করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিকে কোনো শাস্তি প্রদান করেননি।’ (বুখারি)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন