ইংল্যান্ডে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা














মো.আবু রায়হানঃ ইংল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত ইউরোপের একটি দেশ। এর পশ্চিমে ওয়েলস, উত্তরে স্কটল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিমে আইরিশ সাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কেল্টীয় সাগর অবস্থিত।পূর্বদিকে উত্তর সাগর ও দক্ষিণদিকে ইংলিশ চ্যানেল ইংল্যান্ডকে ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।ইংল্যান্ডের ১৬ শতকের শেষ থেকে এবং ১৮ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বিদেশে স্বশাসিত উপনিবেশ, উপনিবেশ, অধিরাজ্য, ম্যান্ডেট এবং এ ধরনের দখলকৃত এবং বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল।এটি প্রায় শতক ধরে চলমান ছিল এবং পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ৪৫ কোটি ৮০ লাখ যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ৩,৩৭,০০,০০০বর্গকিমি যা পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় এক চতুর্থাংশ।বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্তমিত হতো না।বর্তমানে ইংল্যান্ডের আয়তন ১ লাখ ৩০ হাজার ২৭৯ বর্গকিলোমিটার।আমরা যুক্তরাজ্য ,ইংল্যান্ড ও গ্রেট ব্রিটেনকে গুলিয়ে ফেলি অথবা একই ভাবি। আগে তা খোলাসা করে নিই।যুক্তরাজ্য হচ্ছে ৪টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি দেশ (স্টেট)। চারটি সম-মর্যাদার জাতি ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড মিলে যুক্তরাজ্য গঠিত। যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম পুরোটা একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড বলা যেতে পারে, তবে সীমারেখার ভিত্তিতে এই চারটি দেশকে আলাদা আলাদাভাবে সার্বভৌম বলা যায় না। যুক্তরাজ্যের পুরো নাম হচ্ছে- 'ইউনাইডেট কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। অনেকে শুধু ইংল্যান্ডকেই যুক্তরাজ্য ভেবে ভুল করে থাকেন। কারণ যে চারটি দেশ নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত, তার মধ্যে ইংল্যান্ড আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাকি তিনটি দেশের চাইতে বড়।গ্রেট ব্রিটেন বলতে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস এবং এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলিকে বোঝায়।মজার ব্যাপার হচ্ছে লন্ডন হলো ইংল্যান্ডের রাজধানী যা আবার যুক্তরাজ্যের রাজধানী!লন্ডন ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ নগর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এটি ইংল্যান্ডের টেমস নদীর তীরে অবস্থিত। প্রায় ৭০ লক্ষ লোকের বসতি এই লন্ডন সপ্তদশ শতক থেকেই ইউরোপে তাঁর প্রথম স্থান বজায় রেখে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর।ইংল্যান্ড ছাড়াও যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড- এই তিনটি দেশেরই আলাদা আলাদা পতাকা, রাজধানী, সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং সংসদীয় ব্যবস্থাও রয়েছে।সুতরাং ইংল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত। ইংল্যান্ডের জনবসতি সমগ্র যুক্তরাজ্যের লোকসংখ্যার ৮৩% এবং দেশটি গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ এবং শতাধিক ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত।১৮ শতকের শেষে ও ১৯ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডেই বিশ্বের প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটে। এর সূত্র ধরে এখানে এমন একটি সমাজ সৃষ্টি হয় যাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাধান্য ছিল বেশি। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম নগরায়িত রাষ্ট্র, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি নাগরিক শহরে বাস করেন। ১৯ শতকে রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে ইংল্যান্ডবিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশে পরিণত হয়। দেশটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির।ইংল্যান্ডের সরকারি ভাষা ইংরেজি এবং এটি তাদের মাতৃভাষা। এর বাইরে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আইল অভ ম্যানে মাংক্স ভাষা এবং জার্সি ও গুয়ের্নজিতে ফরাসি ভাষা প্রচলিত। ইংল্যান্ডে অভিবাসী সম্প্রদায়ে শতাধিক অভিবাসী ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে আছে বাংলা, চীনা, গ্রিক, গুজরাটি, হিন্দি, ইতালীয়, পাঞ্জাবি, পোলীয়, পর্তুগিজ, স্পেনীয়, তুর্কি, ইউক্রেনীয়, উর্দু, ভিয়েতনামি, ইত্যাদি ভাষা। কিছু লোক জিপসি বা রোমানি ভাষাতে কথা বলে।
২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লাখের অধিক।২০১১ সালের তথ্যানুযায়ী, ইংল্যান্ডের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান।কোনো ধর্ম পালন করে না এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ। বাকিরা মুসলিম, হিন্দু সম্প্রদায়সহ নানা জাতীগোষ্ঠীর মানুষ। ইংল্যান্ডের মুসলিম জনসংখ্যা তিন মিলিয়ন ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করছে দেশটির সরকারের কার্যালয় হোয়াইট হল। অফিস ফর ন্যাশনাল স্টাটিসটিক্সের (ওএনএস) নতুন প্রকাশিত এক রিপোর্টের বরাত দিয়ে টেলিগ্রাফের এক খবরে বলা হয়, অভিবাসন বৃদ্ধি ও উচ্চ জন্মহারের কারণে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ইংল্যান্ডে মুসলিমদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এসব মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের জন্ম ব্রিটেনের বাইরে। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, বর্তমানে ব্রিটেনে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ৩১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ জন। এরমধ্যে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২২জনের জন্ম ব্রিটেনের বাইরে। মুসলিমদের এই সংখ্যা ব্রিটেনে মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ২০ জনে একজন মুসলিম।Official ONS figures for 2018/19 that were released in December show that there are 3,194,791 Muslims living in England, with over a third aged under 16. English Muslims make up the vast majority of the 3,363,210 currently living in England, Scotland and Wales. মুসলিমরাই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। তবে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আনুগত্যও ধীরে ধীরে বাড়ছে। অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে এবং সমানুপাতে শিখদের সংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে ইহুদি ও বৌদ্ধদের সংখ্যা স্থির রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এখনো ইংল্যান্ডের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করে না বা ধর্ম ও ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিশ্লেষকদের ধারণা, খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনাস্থার কারণেই ধর্মহীনতা ও অন্য ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। তবে পরিসংখ্যান রিপোর্টে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খ্রিস্টানদের সংখ্যা হ্রাসের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখানো হয়নি।১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৫০ হাজার জন, যা মোট সংখ্যার ১.৯%। এক দশক পরে অর্থাৎ ২০০১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৫ জনে, যা মোট জনসংখ্যার ৩%। কিন্তু ২০১১ সালে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২৭ লাখ অতিক্রম করে যা মোট জনসংখ্যার ৪.৮%। এই হিসাবে গত ১০ বছরে ইংল্যান্ডে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১৬ ভাগ।বর্তমানে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসে মুসলমান জনসংখ্যা ৩০ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৭ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৫.৪%।সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলমান অভিবাসী এবং মুসলমানদের উচ্চ জন্মহারের কারণে এত বিপুল পরিমাণ মুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গবেষকেরা মনে করছেন।Previous estimates have placed the number of Muslim converts in the UK at between 14,000 and 25,000, but Faith Matters's study suggests that the real figure could be as high as 100,000, with as many as 5,000 new conversions each year.এখন ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলমান অধিবাসীদের দেশ ইংল্যান্ড। লন্ডনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ লক্ষের মতো আর এর মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষই হল মুসলমান(এদের আবার৫ লক্ষ হল বাংলাদেশী মুসলমান)।
Islam is London's second largest religion. Muslims account for just over 12% of London's population. There were 1,012,823 Muslims reported in the 2011 census in the Greater London area.ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ম্যানচেস্টারের৫৪ লক্ষ লোকের মধ্যে প্রায় ৯ লক্ষই মুসলমান। তৃতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামের মোট জনসংখ্যা ১১ লক্ষের আড়াই লক্ষই মুসলমান। জনসংখ্যার আনুপাতির হারে বার্মিংহামে মুসলমান সবচেয়ে বেশি।
এলিজাবেথিয়ান যুগকে বলা হয় ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ও স্বর্ণযুগ। ১৫৫৮ সালে শুরু হয়ে এ যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৬০৩ সাল পর্যন্ত। এলিজাবেথিয়ান যুগে যে সমস্ত বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল বহুজাতিভিত্তিক সংস্কৃতির অর্থাৎ ব্রিটিশদের সঙ্গে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। রানি প্রথম এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন ১৫৫৮ সালে। রানি এলিজাবেথ ইউরোপ বিশেষত ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্য বিশেষত মরক্কোর সাদিয়ান, অটোমান ও পার্সিয়ান শিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক মৈত্রীজোট গঠন করেন।মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে জোট গঠন ছাড়াও রানি এলিজাবেথ মুর, ইন্ডিয়ান ও আফ্রিকান নিগ্রোদের কাছেও দূত প্রেরণ করেন। রানি প্রত্যেকর কাছে এই বার্তা পাঠান যে, তারা ধর্মীয় মতপার্থক্য ভুলে যেন ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করে এবং চাইলে তারা ইংল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করতে পারে। এলিজাবেথের বিভিন্ন মুসলিম দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনের পর থেকে মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ শুরু করে ব্রিটিশরা।অন্যদিকে রানি এলিজাবেথ যে সমস্ত বার্তাবাহক মুসলিম বিশ্বে পাঠিয়েছিলেন তাদের সবাই কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে আসেননি। অনেকে সেখানেই বসতি গড়েছিলেন এবং কেউ কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগে যখন খ্রিস্টান ধর্মের মূল্যবোধই ব্রিটিশ পরিচয়ের মূল ভিত্তি ছিল তখন তারা সামাজিক নিয়মের বাইরে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । বলে রাখা ভালো যে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে যত মুসলমান ছিল, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মুসলমানদের শাসক ছিলেন রানী ভিক্টোরিয়া। বলা হয়ে থাকে ইংল্যান্ডের প্রথম মুসলমান লর্ড ছিলেন একজন আইনবিদ। উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম।যিনি পরবর্তীতে আবদুল্লাহ কুইলিয়াম নামে খ্যাত হন।উইলিয়াম ১৮৮৭ সালে মরক্কো সফরের সময় যাত্রা বিরতিতে মরক্কোর কয়েকজনকে নামাজ পড়তে দেখে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হন তিনি। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে আবদুল্লাহ রাখেন কুইলিয়াম। ১৮৮৭ সালে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করেন।বলা হয়ে থাকে, পুরো ইংল্যান্ডে প্রায় ৬০০ জনকে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। ১৮৯৪ সালে, রানীর অনুমতি নিয়ে অটোমান সুলতান কুইলিয়ামকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের 'শেখ-আল-ইসলাম' বা 'মুসলমানদের নেতা' খেতাব দেন। এই স্বীকৃতির পরেও, লিভারপুল শহরের ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরকে নানা লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সইতে হত। তাদের দিকে ইট-পাথর, ঘোড়ার মলসহ নানা আবর্জনা ছুঁড়ে মারার মত ঘটনাও ঘটেছে। মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণ করতে গিয়ে ধনীদের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতেন।লেডি এভলিন মারে, এডিনবার্গের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন স্কটল্যান্ড ও উত্তর আফ্রিকা যাওয়া-আসা করে।তিনি লিখেছেন, 'সেখানে আমি আরবি বলতে শিখি। আমি প্রায়ই আমার তত্ত্বাবধায়কের চোখ এড়িয়ে বাড়ির বাইরে যেতাম। আমার আলজেরিয়ান বন্ধুদের সাথে মসজিদে ঘুরে বেড়াতাম। ধীরে ধীরে অবচেতন মনে আমি পুরোপুরি মুসলমান হয়ে উঠি।'কায়রোতে লেডি এভলিনের সঙ্গে দেখা হয় জন কোবোল্ডের। পরে যাকে তিনি বিয়ে করেন। জন কোবোল্ডও বেশ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি হজ্ব পালন করতে মক্কায় যান। সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্রিটিশ নারী যিনি হজ্ব পালন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে লেডি এভলিন তাঁর বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলেন 'লেডি জয়নব' নামে। সেখানে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গাগুলোতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তিনি মুসলিম সংস্কৃতিতে নারীদের আধিপত্যমূলক প্রভাব নিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলেন।


ইংরেজি ভাষাতে ইসলাম বা মুসলিম শব্দটি প্রবেশ করে সতের শতকে। এর আগে তারা মুসলমানদের বোঝাতে সারাসিন শব্দটি ব্যবহার করত, যার অর্থ হলো আরব বেদুইন। বিপরীত ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা মুসলমানদের মনে করত তারা একটি অসঙ্গতিপূর্ণ ধর্মে বিশ্বাস করে যেটা প্রাচীন প্যাগন বা মূর্তিপূজারীদের ধর্ম থেকে উদ্ভূত। এর ফলে তারা মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ এড়িয়ে চলত।আঠারো এবং উনিশ শতকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। সে সময়েই মুসলমানরা ব্রিটেনে যেতে শুরু করে। সর্বপ্রথম যে মুসলিম দেশ থেকে মুসলমানরা ব্রিটেনে গিয়েছিল সে দেশটি হলো ইয়েমেন। সে সময় ইয়েমেনিরা ব্রিটিশদের বাণিজ্য জাহাজে নাবিক হিসেবে কাজ করতো। সেই সুবাদেই তারা ব্রিটেনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিল।The first large group of Muslims in Britain arrived about 300 years ago. They were sailors recruited in India to work for the East India Company. The next phase of Muslim immigration to Britain followed the opening of the Suez Canal in 1869. Most of these immigrants came from Yemen.১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তারা ব্রিটেনে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরি করেছিল। তবে বিট্রেনের মুসলমানদের বেশিরভাগই এসেছিল ভারত উপমহাদেশ থেকে। এ কারণে ব্রিটেনের ইসলামের রঙ এবং স্বরূপ অনেকটাই ভারতীয়।এ কারণেই ব্রিটেনের বেশিরভাগ মুসলমানই আহলে সুন্নাত এবং হানাফি ফিকাহর অনুসারী।প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মুসলিম সৈনিক ইংল্যান্ডের পক্ষে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১.৫ মিলিয়ন যোদ্ধা ভারত থেকে এবং দুই লাখ ৮০ হাজার সৈনিক আলজেরিয়া, মরক্কো ও তিউনিশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়। দ্য ন্যাশনালের হিসাব মতে, ‘সংঘাতময় সময়ে’ কমপক্ষে অর্ধমিলিয়ন মুসলিম ব্রিটিশ আর্মিতে যুদ্ধ করেছে। ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ ছিল মুসলিম। ৯ হাজার ফিলিস্তিনি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগদান করেছিল। বিপরীতে খুব সামান্যসংখ্যক মুসলিম সৈনিক অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করেছিল।
পরিসংখ্যান মোতাবেক ইংল্যান্ডে ৬০০ মসজিদ এবং ৪০০ এর মতো ইসলামী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। There are estimated to be around 1,500 mosques in Britain - the majority are formed from houses or other converted buildings, with fewer than 20% purpose-built.ইংল্যান্ডে মুসলমানদের সংখ্যা এবং মসজিদ নির্মাণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। একথার সত্যতা নিরূপণ করা যায় শুধু এটা দিয়েই যে, ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে শুধু তিনটি মসজিদ ছিল। আর এসব মসজিদে শুধু ফজর, মাগরিব ও ইশার নামাজ হত। তখন বৃটেনে জুমার নামাজের বিশেষ কোনো প্রচলন ছিল না। সে সময় থেকে মাত্র ত্রিশ বছর পর ১৯৯৩ সাল পর্যন- ইংল্যান্ডে ৫৭৫ টি মসজিদ নির্মাণ হয়েছে এবং এসব মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমা নিয়মিতভাবে আদায় হচ্ছে। সত্তুরের দশক থেকে মুসলমানরা ইংল্যান্ডে তাদের উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে এবং তাদের সামাজিক অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে আইন সংস্কার করতে আন্দোলন শুরু করেছিল। এ লক্ষ্যে তারা ইসলামী সংস্থাগুলোর ইউনিয়ন বা ইউ.এম.সি, ব্রিটিশ মসজিদ পরিষদ, জামাতের ইমামদের পরিষদ, মসজিদ সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠন চেষ্টা চালিয়েছিল পারিবারিক আইনসহ বিভিন্ন আইনের সংস্কার করে ইসলামী আইন বা বিধি বিধানের অনুকূলে পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালে স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশ এবং তার বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনী (রহ) এর ফতোয়া ও পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইউরোপে ইসলামী জাগরণ নতুন একটি পর্বে উন্নীত হয়। সে সময় সমগ্র বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং সেই সুবাদে ইংল্যান্ডে ইসলামী বিষয় আশয় দেখাশুনা করার জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। এভাবে ইসলামের বিকাশ ব্যাপক বিপ্লবী রূপ ধারণ করে।এইসব আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁদের ক’জনের নাম উল্লেখ করা জরুরি বলে মনে করি। বিশেষ করে লন্ডন ইসলামী সংস্থার প্রধান কলিম সিদ্দিকীর নামটি অবশ্যই নিতে হবে। তিনি ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ মুসলিম পার্লামেন্ট গঠন করার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই ফোরামের উদ্দেশ্য ছিল অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। ১৯৯২ সালে এই পার্লামেন্টটির উদ্বোধন করা হয়।
ইংল্যান্ডে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইম ঘৃণা ছড়ানো এবং সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে এই অবাঞ্ছিত প্রক্রিয়া বেশ জোরদার হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, একটি হোয়াইট টেররিস্ট গ্রুপ বা সাদা চামড়া সন্ত্রাসী দল ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষ ও আক্রমণ চালাচ্ছে। পুলিশ বলেছে, নব্য নাৎসি দল ইয়র্কশায়ার, লিডস, ডিউসবারি ও বেটলিতে চরম দক্ষিণপন্থী দলের সাথে মিশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংসতায় নেমেছে। ব্রিটেনে মুসলমানেরা এখন নিয়মিত হেট ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন, এই জঘন্য অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। সাদা চামড়ার অনেক ব্রিটিশকে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। ম্যানচেস্টারে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর মুসলিমবিদ্বেষ ৫০০ ভাগ বেড়ে যায়। ম্যানচেস্টার পুলিশ আরো জানায়, এর আগে মুসলিমবিদ্বেষী অপরাধ ১৮৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল, যার পরিণামে হত্যা করা হয়েছে ২২ জনকে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ব্রিটেনে মুসলমানদের লক্ষ করে হামলা ও অপদস্থ করার ঘটনা ৩২৬ শতাংশ বেড়েছে। এসব হামলার প্রধান টার্গেট হচ্ছে হিজাব-বোরকা পরা মুসলিম মহিলারা। ওই বছর মুসলিমদের লক্ষ করে ১১২৮টি হামলা-হেনস্তার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনাগুলোতে ১৩ থেকে ১৮ বছরের শ্বেতাঙ্গ কিশোর তরুণেরা বেশি জড়িত। এসব বিদ্বেষমূলক হামলার শিকার যারা হচ্ছেন, তারা জানিয়েছেন, হামলার সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা ঠেকানোর কোনো চেষ্টা করে না। বর্ণবাদ ও ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। বর্ণবাদ, উগ্রপন্থা, ইসলামবিদ্বেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে মুসলমানেরা বড় বড় মিছিল করেছে। লন্ডন, কার্ডিফ ও গ্লাসগোর মতো বড় শহরে এসব বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সংহতি জানানো হলো উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের অধিকারের প্রতি। বিক্ষোভকারীরা অভিবাসী ও উদ্বাস্তুরা স্বাগত বর্ণবাদী হামলা বন্ধ করো ইত্যাদি শ্লোগান দেন।ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ-এর একটি উক্তি ইতিহাসের বইসমূহে প্রসিদ্ধ -আগামী শতকে দুনিয়ার সকল ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে শুধু ইসলাম ছাড়া। কারণ এটিই একমাত্র ধর্ম যা সময়ের সকল প্রয়োজন পূরণ করে।
  যুক্তরাজ্য হচ্ছে ৪টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি দেশ (স্টেট)। চারটি সম-মর্যাদার জাতি ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড মিলে যুক্তরাজ্য গঠিত। যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম পুরোটা একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড বলা যেতে পারে, তবে সীমারেখার ভিত্তিতে এই চারটি দেশকে আলাদা আলাদাভাবে সার্বভৌম বলা যায় না। যুক্তরাজ্যের পুরো নাম হচ্ছে- 'ইউনাইডেট কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। গ্রেট ব্রিটেন বলতে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস এবং এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলিকে বোঝায়অনেকে শুধু ইংল্যান্ডকেই যুক্তরাজ্য ভেবে ভুল করে থাকেন। কারণ যে চারটি দেশ নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত, তার মধ্যে ইংল্যান্ড আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাকি তিনটি দেশের চাইতে বড়। এর চাইতেও মজার ব্যাপার হচ্ছে লন্ডন হলো ইংল্যান্ডের রাজধানী যা আবার যুক্তরাজ্যের রাজধানী! লন্ডন ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ নগর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এটি ইংল্যান্ডের টেমস নদীর তীরে অবস্থিত। প্রায় ৭০ লক্ষ লোকের বসতি এই লন্ডন সপ্তদশ শতক থেকেই ইউরোপে তাঁর প্রথম স্থান বজায় রেখে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর।ইংল্যান্ড ছাড়াও যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড- এই তিনটি দেশেরই আলাদা আলাদা পতাকা, রাজধানী, সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং সংসদীয় ব্যবস্থাও রয়েছে।সুতরাং ইংল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত। এর পশ্চিমে ওয়েলস, উত্তরে স্কটল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিমে আইরিশ সাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কেল্টীয় সাগর অবস্থিত।পূর্বদিকে উত্তর সাগর ও দক্ষিণদিকে ইংলিশ চ্যানেল ইংল্যান্ডকে ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এর জনবসতি সমগ্র যুক্তরাজ্যের লোকসংখ্যার ৮৩% এবং দেশটি গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ এবং শতাধিক ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠি১৮ শতকের শেষে ও ১৯ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডেই বিশ্বের প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটে। এর সূত্র ধরে এখানে এমন একটি সমাজ সৃষ্টি হয় যাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাধান্য ছিল বেশি। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম নগরায়িত রাষ্ট্র, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি নাগরিক শহরে বাস করেন। ১৯ শতকে রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে ইংল্যান্ডবিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশে পরিণত হয়। দেশটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির। ইংল্যান্ডের আয়তন ১ লাখ ৩০ হাজার ২৭৯ বর্গকিলোমিটার।ইংল্যান্ডের সরকারি ভাষা ইংরেজি এবং এটি তাদের মাতৃ ভাষা। এর বাইরে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আইল অভ ম্যানে মাংক্স ভাষা এবং জার্সি ও গুয়ের্নজিতে ফরাসি ভাষা প্রচলিত। ইংল্যান্ডে অভিবাসী সম্প্রদায়ে শতাধিক অভিবাসী ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে আছেবাংলা, চীনা, গ্রিক, গুজরাটি, হিন্দি, ইতালীয়, পাঞ্জাবি, পোলীয়, পর্তুগিজ, স্পেনীয়, তুর্কি,ইউক্রেনীয়, উর্দু, ভিয়েতনামি, ইত্যাদি ভাষা। কিছু লোক জিপসি বা রোমানি ভাষাতে কথা বলে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল