ফিজিতে ইসলাম ও মুসলমান
#মো.আবু রায়হান
ফিজি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র। এর সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী ফিজি দ্বীপপুঞ্জ (Republic of the Fiji Islands) । এটি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ৩,১০০ কিমি উত্তর-পূর্বে এবং হাওয়াইয়ের ৫,০০০ কিমি দক্ষিণে।পশ্চিমে ভানুয়াতু, দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্যালাডোনিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে নিউজিল্যান্ড, পূর্বে টোঙ্গা, উত্তরে টুভালু ও উত্তর-পূর্বে ফ্রান্স।ফিজির মূল বন্দরটি রাজধানী সুভায় অবস্থিত।ফিজি সবার কাছে দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। ফিজি মোট ৩৩০টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়। এর মধ্যে ১০৬টি ক্ষুদ্র দ্বীপে অধিবাসীরা বসবাস করে।সবচেয়ে দূরবর্তী দ্বীপ ওয়ান-আই-লাও। সবচেয়ে জনবসতি ভিটি লেভু ও ভানুয়া লেভু দ্বীপ। এই দুটি দ্বীপেই বাস করে দেশটির প্রায় ৮৭ শতাংশ মানুষ।এখানে জনবসতি শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে। ১৯ শতাব্দীর শুরুতেই ইউরোপীয় আধিবাসীরা ফিজি এসেছিল। তারও আগে ১৬৪৩ সালে একজন ডাচ আবেল তাসমান ফিজি আসেন।১৮৭৪ সালে ব্রিটেন এখানে উপনিবেশ স্থাপন করে। এই উপনিবেশ স্থায়ী ছিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। ১৯৭০ সালের ১০ অক্টোবর, ফিজি স্বাধীনতা লাভ করে। ফিজিকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় ১৯৮৭ সালে।১৯৯৮ সালের ২৭ জুন দেশটির নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। একই সঙ্গে দেশের নাম ফিজি দ্বীপপুঞ্জ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
আয়তন ১৮ হাজার ২৭৪ বর্গকিলোমিটার ।২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৯ লাখ ৩ হাজার ২০৭ জন।এতে ৫১ শতাংশ হলো ফিজি জাতি। ৪৪ শতাংশ হলো ভারতীয় জাতি। ২০০৭ সালের জরিপ অনুযায়ী প্রোটেস্ট্যান্ট ৪৫ শতাংশ, হিন্দু ২৭.৯ শতাংশ, রোমান ক্যাথলিক ৯.১ শতাংশ, মুসলিম ৬.৩ শতাংশ ও শিখ ০.৩ শতাংশ । মুসলিমদের মোট সংখ্যা ৬২ হাজার ৫৩৪ জন।এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মুসলমানরা বেশিরভাগই ৫৯.৭ শতাংশ হানাফি মাযহাবের, ৩৬.৭ শতাংশ অনির্ধারিত,আহমদিয়া (কাদিয়ানি) ৩.৬ শতাংশ।ভারত-পাকিস্তানিদের মাঝে মুসলমানদের সংখ্যা ১৫.৯%। ৫৭.১৯% মুসলমান গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। ১৯.১১% রাজধানীতে, বিশ হাজার ২৩১ জন বা অঞ্চলে, ৫২৮৮ জন রাওয়া অঞ্চলে বসবাস করেন।ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তারা ফিজিতে শ্রমিক হিসেবে আগমন করে। বর্তমানে ফিজির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মুসলিমদের জাগরণ চোখে পড়ার মতো। সেখানকার জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় তাদের।ভারতীয়দের যেভাবে এখানে আনা হয়েছিল-সে কাহিনী সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বর্বর চরিত্রের ঘৃণ্য উপমা। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা যখন এই অঞ্চলে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন লক্ষ যে করে এখানকার আদিবাসীরা চাষাবাদে একেবারে অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ। ইংরেজ গভর্নর তখন চিন্তা করল- ভারতীয় অভিজ্ঞ কৃষকদের এখানে নিয়ে এলে ভালো হবে। ভারতও তখন তাদের সাম্রাজ্যবাদী কলোনী। যেই ভাবনা সেই কাজ। মাদ্রাজ, কেরালা, বাঙ্গাল ও উত্তরপ্রদেশজুড়ে গরিব কৃষকদের মধ্যে শুরু হয় তৎপরতা। ভারতীয় দরিদ্র কৃষকদের অল্প পরিশ্রমে বেশি উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ফিজিতে। অতঃপর তাদের মাথায় পরানো হয় দাসত্বের শিকল। তাদের ওপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন।প্রথম কৃষক হিসেবে ভারত উপমহাদেশ থেকে ৬০৫৫৩ জন ফিজিতে যান। তাদের মধ্যে দুই হাজার ৫৩৭ নারীসহ ৭৬৩৫ জন মুসলিম ছিলেন।তাদের মধ্যে করাচি থেকে এসেছিল ৬৫৫৭ জন মুসলমান। ১০৯১ জন মুসলমান মাদ্রাজ থেকে এবং ১৪৫০ জন মুসলমান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, বালুচিস্তান-আফগানিস্তান এবং পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে এসেছিল।১৮৭৯ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে কয়েক দফায় মুসলমানরা ফিজিতে যায়।তাদের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ঘটে।এরপর পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও মালয় অঞ্চল এবং পূর্ব আফ্রিকা থেকে মুসলিমরা ক্রমান্বয়ে ফিজিতে আগমন করতে থাকে। এভাবে ফিজিতে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
১৯০৮ সালে ফিজিতে প্রায় ৪০০০ জন মুসলমান ছিল।১৯১৫ সালে আওজুমান হিদায়াত-ই-ইসলাম নওসোরিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরের বছরে আঞ্জুমান ইশাইত আল ইসলাম লৌটোকাতে প্রতিষ্ঠিত হয়।সুভা অঞ্চলে প্রায় ৭০ জন মুসলমান ছিল, যাদের কোনো মুসলিম স্কুল বা মসজিদ ছিল না।রাজধানী শহরে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ার সাথে সাথে সুভার মুসলিম সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটাতে ১৯১৯ সালে আঞ্জুমান-ই-ইসলাম গঠিত হয়েছিল।তুরকের জামে মসজিদে এক সভায় ফিজি মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ৩১ অক্টোবর ১৯২৬ সালে।সর্বপ্রথম যারা এখানে এসেছিলেন, তারা নামাজ, রোজা প্রভৃতি ধর্মীয় মৌলিক বিষয় মেনে চলত। তাঁরা ইসলামের প্রতীকী বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান ছিল। তারাই এখানে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু যেহেতু নতুন প্রজন্মের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না; তা ছাড়া হিন্দু, খ্রিস্টান ও শিখদের সঙ্গে ছিল সার্বক্ষণিক মেলামেশা-ফলে ধীরে ধীরে দ্বীনের অনুসরণ ও ধর্মীয় আমল-আচরণ ম্লান ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। এরপর সর্বপ্রথম সম্ভবত ১৯৬৭ সালে জাম্বিয়া থেকে একটি তাবলিগ জামাতের আগমন হয়। তারাই ধর্মের প্রতি ফিরে আসার প্রেরণা জাগিয়ে তোলেন। এখানকার অধিবাসীরাও তাদের ধর্মীয় কর্তব্যের কথা জানতে পারে। নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়।২৫টি মসজিদ রয়েছে ফিজিতে। রয়েছে ১৩টি প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র ও বেশ কিছু মাদরাসা।সেখানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়।২০১৯ সালে ফিজির মুসলমানরা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লৌটোকাতে সর্ববৃহৎ মসজিদে হেলাল উদ্বোধন করেন। দৃষ্টিনন্দন ও সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন মসজিদটি তৈরিতে খরচ পড়েছে দেড় মিলিয়ন ডলার।বর্তমানে ফিজিতে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় অনুরাগ বাড়ছে। দেশটির মুসলিম যুবকরা দিন দিন ধর্ম পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ইসলামবিরোধী নানা প্রচারণা থাকার পরও ফিজির সাধারণ মানুষ ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে। বাড়ছে মসজিদমুখী মুসল্লির সংখ্যা।
ফিজিকে বলা হয়, সূর্যোদয়ের দেশ। এই দেশেই প্রথম আজান উচ্চারিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার সময় থেকে প্রায় ৪ ঘন্টা আগে এখানে ফজেরর আজান হয়, আর জাপানের সময় থেকে ২ ঘন্টা আগে। এখানেই প্রতিদিন সবার আগে সূর্য ওঠে।
মহানবী (সা.) এর জন্মদিবসে ফিজিতে সরকারি ছুটি রয়েছে।ফিজির মুসলমানরা সবাই সুন্নি। তারা হানফি মাজহাব অনুসরণ করেন। ফিজিতে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ বেশ সক্রীয়। ভারতবর্ষে শিক্ষা নেওয়া অনেক আলেম-উলামা সে দেশে রয়েছেন। তাদের দাওয়াতের কারণে ফিজির জনগনের কাছে দিন দিন ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে উঠছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন