ফুটবলের স্বর্গরাজ্য আর্জেন্টিনায় ইসলাম ও মুসলমান



আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার একটি রাষ্ট্র।বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনা প্রায় ১৭ হাজার ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেশটি উত্তরে বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে, উত্তর-পূর্বে ব্রাজিল, পূর্বে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর। এবং দক্ষিণে ড্রেক প্রণালী। বুয়েনোস আইরেস দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশের প্রায় পুরোটা জুড়ে অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে এটি দক্ষিণ আমেরিকার ২য় বৃহত্তম এবং বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম রাষ্ট্র।আধুনিক আর্জেন্টিনার ইতিহাস ১৬শ শতকে স্পেনীয় উপনিবেশীকরণের মাধ্যমে সূচিত হয়।১৭৭৬ সালে এখানে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে রিও দে লা প্লাতা উপরাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই উপরাজ্যের উত্তরসূরী রাষ্ট্র হিসেবে আর্জেন্টিনার উত্থান ঘটে ।প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের পর ১৮১০ সালে আর্জেন্টিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৮১৮ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধবিজয় শেষ হয়। আর্জেন্টিনার জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা দক্ষিণ আমেরিকার অন্যত্রও বিপ্লবে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এরপরে দেশটিতে অনেকগুলি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৬১ সালে অনেকগুলি অঙ্গরাজ্যের একটি ফেডারেশন হিসেবে দেশটি পুনর্গঠিত হয়, যার রাজধানী নির্ধারিত হয় আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় শহর ও রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে।

আর্জেন্টিনার আয়তন ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ বর্গ কিমি.। আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ আর্জেন্টিনা। চার কোটি ৩৪ লাখ ১৭ হাজার জনসংখ্যার দেশটিতে রোমান ক্যাথলিক ৯২ শতাংশ, প্রটেস্ট্যান্ট ২ শতাংশ, ২ শতাংশ মুসলিম, ইহুদি ২ শতাংশ এবং অন্যান্য ৪ শতাংশ জনসংখ্যা বসবাস করে। (সূত্র : ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক)। অ্যাসোসিয়েশন অব রিলিজিয়ন ডাটা আর্কাইভের (এআরডিএ) মতে, দেশটির প্রায় ১.৯% মানুষ মুসলিম।ল্যাটিন আমেরিকার সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশ এটি। দেশটিতে বসবাস করে ১০ লাখেরও বেশি মুসলিম।দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ২০০৯ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটিতে ৭ লাখ ৮৪ হাজার মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে।পিউ রিসার্চ সেন্টার’ ২০১০ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে আর্জেন্টিনার মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ উল্লেখ করা হয়।The first mentioned Arab settlers were the 15th century's Moorish (Morisco) Muslims of the Iberian peninsula that were people of Arab North African descent who explored the Americas with Spanish explorers, many of them settling in Argentina who were fleeing from persecution such as the Spanish Inquisition.পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন আর্জেন্টিনা স্পেনের উপনিবেশ ছিল, তখন স্পেন থেকে মুর ও মরিস্কো মুসলমানরা স্পেনের নাবিকদের সাথে দেশটিতে এসেছিল। তাদের অধিকাংশই বসতি গেড়েছিল আর্জেন্টিনায়।ঊনবিংশ শতাব্দীতে আরব বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের আগমন ঘটে দেশটিতে, যাদের অধিকাংশই ছিল সিরীয় ও লেবানিজ বংশোদ্ভূত । এদের অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসে খ্রিষ্টান হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানও এসেছিল। বর্তমানে আর্জেন্টিনায় আরব বংশোদ্ভূত প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ বাস করে। Between the late 19th century and the early 20th century, the Argentine government witnessed a wave of Arab migrants coming from the Middle East, notably from Syria and Lebanon, which were both part of the Ottoman Empire. The migrants that arrived in Argentina were considered Turks because they simply carried Turkish documents. While the majority of these immigrants were Christian, some hailed from the Middle East.মূলত ওসমানি খেলাফতের পতনের পর প্রায় সাড়ে ৩ লাখ আরব অভিবাসী আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল আরব খ্রিস্টান। তাদের সঙ্গে এসেছিল অনেক আরব মুসলিম। ধারণা করা হয় সে সময় প্রায় ১ লাখ মুসলিম আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়।
আর্জেন্টিনায় ১০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠিত মসজিদ রয়েছে। আর্জেন্টিনায় ইসলামের বৃদ্ধি এবং দেশে ভ্রমণকারী মুসলিম পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আশির দশকে দেশটির রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে দুটি মসজিদ গড়ে ওঠে, যেগুলো ছিল দেশটির ইতিহাসে প্রথম দুই মসজিদ। ১৯৮৩ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সহায়তায় মসজিদে তাওহিদ নামে নির্মিত হয় শিয়া মসজিদ।১৯৮৫ সালে সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য মসজিদ আল-আহমদ নির্মাণ করা হয়। যেটি ছিল দেশটির ভূমিতে ইসলামি স্থাপত্যকলায় নির্মিত প্রথম ইমারত।পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার করর্ডোবা শহরে ২টি, মার দেল প্লাটা শহরে ২টি এবং দেশসেরা বলসনের সূফি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আর্জেন্টিনায় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দ্য ইসলামিক সেন্টার অব আর্জেন্টিনা।১৯৮৯ সালের নির্বাচনে আর্জেন্টিনায় আরব বংশোদ্ভূত কার্লোস মেনেম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মুসলিম।তিনি আর্জেন্টিনার প্রথম আরব বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট। তার বংশের আদি নিবাস ছিল সিরিয়ায়।ক্ষমতার লোভে ১৯৬৬ সালে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে।তার সাবেক স্ত্রী জুলিমা ইয়মার তথ্য মতে, Menem abandoned Islam and converted to Christianity in 1966 only because he wanted to become president of the nation. (দেশের প্রেসিডেন্ট হতেই তিনি ১৯৬৬ সালে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। তিনি তার শাসনামলে মুসলমানদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন)। সৌদি সরকারের সহায়তায় তার আমলেই ইসলামিক সেন্টারসহ মসজিদ নির্মাণ হয়।বাদশাহ ফাহাদ ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দেশটির সর্ববৃহৎ মসজিদ, যার নির্মাণকাজ খাদেমুল হারামাইন শরিফাইনের তত্ত্বাবধায়নে ১৯৯৬ সালে ২০,০০০ বর্গমিটার জমির উপর সম্পন্ন হয়। আর্জেন্টিনার সরকার ১৯৯২ সালে স্থাপনাটি নির্মাণের জন্য ৩৪,০০০ বর্গমিটার জমি দান করেছিল। স্থাপনাটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্থাপনার অন্তর্ভুক্ত ইমারতগুলো হল একটি মসজিদ, একটি গ্রন্থাগার, দুইটি বিদ্যালয় ও একটি পার্ক।
বর্তমানে আর্জেন্টিনার বিভিন্ন শহরে ১৫০টির বেশি ইসলামিক সেন্টার আছে। এর তত্ত্বাবধানে অসংখ্য মাদরাসা, স্কুল ও কলেজ পরিচালিত হয়।ইসলামিক অর্গানাইজেশন অব ল্যাটিন আমেরিকার (Islamic Organization of Latin America -IOLA)প্রধান কার্যালয় আর্জেন্টিনায় অবস্থিত। সংগঠনটিকে ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে সক্রিয় ইসলামি সংগঠন বলে বিবেচনা করা হয়। সংগঠনটি ল্যাটিন আমেরিকার সমাজে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্তকরণ ও ইসলাম প্রচার নিয়ে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। আর্জেন্টিনার স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে ইসলামিক সেন্টার অফ দ্যা আর্জেন্টাইন রিপাবলিক (সিআইআরএ) সবচেয়ে প্রভাবশালী।১৯৩১ সালে আর্জেন্টিনায় বসবাসকারী আরব-মুসলিমদের দ্বারা এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত আল-আহমাদ মসজিদটিও এই সংগঠনের অবদানে প্রতিষ্ঠিত হয়।সেখনকার মুসলমানেরা এখন কেমন আছেন এই অনুসন্ধানে ‘দ্যা আর্জেন্টাইন ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, আর্জেন্টাইন মুসলিমরা কোন ধরনের বৈষম্যের শিকার হন না। আরো বলা হয়, একজন আর্জেন্টাইন মুসলিম কোন ধরনের বাঁধা ছাড়াই তার ধর্ম বিশ্বাস পালন ও অনুশীলন করতে পারেন।সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে যখন হিজাব পরে নারীরা জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টর জন্য ছবি তুলতে পারে না। পুরো বিশ্ব যখন হিজাব বিতর্কে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন, সে সময়টিতে আর্জেন্টিনার আদালত মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের অনুমতি দিয়েছে।এমনকি ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি আদালতের এক রায়ে বলা হয়, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রেও মুসলিম নারীরা হিজাব পরিহিত অবস্থায় ছবি দিতে পারবেন।’ আর্জেন্টিনার আদলত হিজাব পরাকে ধর্মীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেছে। ৯/১১ পর সেখানকার মুসলিমরাও প্রথম দিকে বেশ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করলেও সে দেশের সরকার মুসলিমদের প্রতি সহনশীল হওয়ায় তারা সে সংকট সহজে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
আর্জেন্টিনায় মুসলিমদের জন্য ধর্ম পালনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। আর্জেন্টিনার ভাষায় ইসলামি বইয়ের ব্যাপক উপস্থিতি না থাকায় ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনায় রয়েছে কিছু সমস্যা।
আর্জেন্টাইন মুসলিমদের সমস্যার প্রথম কারণ হলো- ‘প্রথমত তারা তাদের অনেক ইবাদত ভুলে গেছে। তারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানে না। অনেকে আরবি ভাষায় সুরা-কেরাতও জানে না। এমন অনেক মুসলিম পরিবার আছে, যেখানে একজন মাত্র আরবি পারেন, বাকিরা কেবল স্প্যানিশ পারেন।’
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষা স্প্যানিশে খুব কম ইসলামি বইপত্র পাওয়া যায়, বিশেষ করে স্প্যানিশ ভাষায় কুরআন পাওয়া যায় না (কুরআনের স্প্যানিশ অনুবাদ হলেও তা সহজলভ্য নয়)’।
তৃতীয় ও শেষ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সেখানে মাদরাসা বা ইসলামিক স্কুল ও ইসলাম প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক মুসলিম স্থানীয় খ্রিষ্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। এমনকি অনেকে তার মূল ধর্ম (ইসলাম) ভুলে যাচ্ছেন!’
এজন্য আর্জেন্টিনায় দাওয়াত ও তবলিগের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা ও মসজিদ-মাদরাসা আবাদ করা অত্যন্ত জরুরি।

গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় -মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল