মিয়ানমারের মুসলিম ও ভাগ্যাহত রোহিঙ্গারা




মিয়ানমার বা মায়ানমার প্রাক্তন নাম ও কথ্যরূপ বর্মা বা বার্মা । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। মায়ানমারের আনুষ্ঠানিক নাম হল মায়ানমার প্রজাতন্ত্র । তৎকালীন বার্মার গণতান্ত্রিক সরকারের উৎখাতের পর ১৯৮৯ সালে সেখানকার সামরিক সরকার বার্মার নতুন নামকরণ করে মিয়ানমার এবং প্রধান শহর ও তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনের নতুন নাম হয় ইয়াঙ্গুন।বর্তমানে মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অত্যন্ত পরিকল্পিত নতুন শহর নেপিডোতে। ২১ অক্টোবর ২০১০ থেকে দেশটির জাতীয় সঙ্গীত ও নতুন জাতীয় পতাকা প্রবর্তন করা হয়।বার্মা নামটি ব্রহ্মদেশ নামটির সঙ্গে সম্পর্কিত।মিয়ানমারের মোট আয়তন ৬৭৬,৫৫২ বর্গকিলোমিটার। মায়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ভারতের মিজোরাম, উত্তর-পশ্চিমে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর অবস্থিত। মায়ানমারের সীমানার উত্তর-পূর্বাংশের ২,১৮৫ কিলোমিটার জুড়ে আছে তিব্বত এবং চীনের ইউনান প্রদেশ। দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে লাওস ও থাইল্যান্ড। দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সাথে মায়ানমারের ১,৯৩০ কিলোমিটার উপকূল রেখা রয়েছে।

ব্রিটিশরা বার্মাকে ভারতের একটি প্রদেশে পরিনত করে। ১৮৮৬ সালে রেঙ্গুনকে বার্মা প্রদেশেরে রাজধানী করা হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমারে জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। রেঙ্গুন তথা বার্মা ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত সময়ে জাপানিদের দখলে ছিল। জাপানিদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছিল বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। জাপানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন জেনারেল অং সান এবং বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত। পরে জাপানিদেরও বিতাড়িত করে বার্মাকে স্বাধীন করা। তৎকালীন বার্মা ভারতের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে। জেনারেল অং সান স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে জুলাই ১৯৪৭ সালে কথিত বিরোধী আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬২ সালের ২ মার্চ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। সামরিক জান্তার প্রধান ছিলেন নে উইন। তারা ২৭ মে ১৯৯০ সালে প্রথম নির্বাচন দেয়। এ নির্বাচনে অং সান সু চি এর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৪৯২ টি আসনের মধ্যে ৩৯২টি আসন পায়। কিন্তু নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। সুদীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতি ঘটিয়ে ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। মায়ানমার দেশটি মূল মিয়ানমার অঞ্চল এবং আরও সাতটি রাজ্য নিয়ে গঠিত। এগুলি হল চিন, কাচিন, কারেন, মন, রাখাইন, এবং শান। মূল মিয়ানমার সাতটি বিভাগে বিভক্ত - ইরাবতী, মাগোয়ে, ম্যান্ডালে, পেগু, রেংগুন, সাগাইং, এবং তেনাসসেরিম।
১১শতাব্দী থেকে মায়ানমারে (বার্মা নামেও পরিচিত) মুসলমানরা বসবাস করে আসছে। বার্মার ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ মুসলিম, বায়াত উয়ি, মোনের শাসনামলে প্রায় ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের একজন থাতন রাজা। বায়াত উয়ির ভাই বায়াত তা’য়ের দুই পুত্র, শ্বে বাইন ভ্রাতৃদ্বয় নামে পরিচিত, তাদের ইসলামি বিশ্বাসের কারণে অথবা তাদের বাধ্যতামূলক শ্রম বন্ধ করার জন্য শিশু হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।১৭শতকে, ক্ষতিকারক ও বাস্তব নিপীড়ন প্রদান করে, আরাকানে বসবাসরত ভারতীয় মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। এই মুসলমানগণ শাহ সুজার সাথে বসতি স্থাপন করেছিল, যারা মুগল যুদ্ধে উত্তরাধিকারী হারানোর পর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে, আরাকান জলদস্যু সান্ডাথাডাম (১৬২৫-১৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) চট্টগ্রাম ও আরাকানের স্থানীয় জলদস্যু ছিল, সুজা ও তার অনুসারীদের সেখানে বসতি স্থাপন করতে দেয়। কিন্তু সান্ডাথাডাম ও সুজার মধ্যে একটি বিতর্ক বাধে, এবং সুজা বিদ্রোহীদের কাছে ব্যর্থ হন। সান্ডাথাডাম সুজার অধিকাংশই শিষ্যদের হত্যা করে, যদিও সুজা নিজেকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারেন।রাজা বোদাপায়া (১৭৮২- ১৮১৮) ময়দুরের চারজন বিখ্যাত বর্মি মুসলিম ইমামকে গ্রেফতার করে এবং শুকরের মাংস খাওয়াতে অস্বীকার করায় রাজধানী আভাতে তাদের হত্যা করে।[১৯] মৈতু মুসলিম ও বার্মা মুসলিম সংস্করণের মতে, বোদাপায়া পরে হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ইমামগণকে সাধু হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।১৯২১ সালে বার্মায় মুসলমানদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫,০০,০০০।[২১] ব্রিটিশ শাসনের সময়, বার্মিজ মুসলমানদের "ভারতীয়" হিসেবে দেখা হত, কারণ বার্মায় বসবাসকারী অধিকাংশ ভারতীয়রা মুসলমান ছিলেন, যদিও বার্মিজ মুসলমানরা ভারতীয় মুসলমানদের থেকে আলাদা ছিল। এভাবে বার্মিজ মুসলমান, ভারতীয় মুসলমান ও ভারতীয় হিন্দুদের সম্মিলিতভাবে "কাল" নামেও পরিচিত করা হয়। "কাল" শব্দটি সাধারণ অর্থে কালোবর্ণ হিসেবে অনূদিত এবং তাদের জাতিগতভাবে নিন্দার্থে ব্যবহার করা হয়।১৯৩৮ সালে, বার্মায় মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা আবারো ছড়িয়ে পড়ে। মোশে ইয়াগার লিখেছেন যে ব্রিটিশ বিরোধী ও জাতীয়তাভিত্তিক অনুভূতির দ্বারা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে দেবার জন্য নয় বরং মুসলিম-বিরোধী ছিলো। তবুও ব্রিটিশ সরকার দাঙ্গা ও বিক্ষোভের প্রতি সাড়া দিয়েছিল। মায়ানমারের পত্রিকাগুলোতে মুসলিম ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানিরা রোহিঙ্গাদের অধীনস্থ এলাকার মধ্য দিয়ে সহজেই অগ্রসর হয়।পরাজিত, ৪০,০০০ রোহিঙ্গা অবশেষে বার্মা ও জাপানী বাহিনীর দ্বারা গণহত্যার স্বীকার হয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যায়।
মিয়ানমারের প্রায় সবাই বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। বেশির ভাগ লোকই তেরাভাদা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, লাওস এবং ক্যাম্বোডিয়ার লোকেরাও একই ঘরানার বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করেন। মায়ানমারে বর্মীদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীর লোক নিয়ে বাকি ৩২ ভাগ গঠিত । এর মধ্যে আছে রোহিঙ্গা, অ্যাংলো বার্মিজ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ ইন্ডিয়ানসহ আরো বেশ কিছু জাতি। রোহিঙ্গা ঐতিহাসিকভাবে আরাকানী ভারতীয়ও বলা হয়ে থাকে। রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। ২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সেনাবাহিনীর অভিযানের পূর্বে মায়ানমারে ১.১ থেকে ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাস করতেন। যাদের অধিকাংশের বাসস্থান ছিল মুলত ৮০-৯৮% রোহিঙ্গা অধ্যূষিত রাখাইন রাজ্যে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক শাসক নে উইন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে ‘রাখাইন স্টেট’ নামকরণপূর্বক এটিকে একটি অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে। সে অবধি সরকারিভাবে আরাকানকে ‘রাখাইন স্টেট’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতে আরাকান নামটি অনেক পুরনো। এ নামের বিকৃতিতেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উচ্চারণ হয়েছে। আরাকান শব্দটি মূলত আরকান; যা আরবী আররেকন বা আররুকন শব্দের অপভ্রংশ। রুকন শব্দের অর্থ হলো স্তম্ভ বা খুঁটি। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদকে রুকন বলা হয়। তাই তাদের ধারণা, সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তৎকালীন মুসলমানরা আরাকানকে ইসলামের বুনিয়াদের দিকে খেয়াল রেখে আরাকান নামকরণ করেছেন।
হিজরী প্রথম শতকের শেষ দিকে (৯৬ হি.) ৭১২ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া শাসনামলে সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হবার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা শুরু হলেও মূলত পবিত্র মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসাময়িক কালে মহানবি (সা.) এর জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশেষত আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে। কেননা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকে আরব বণিকেরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও চীনের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ্য, দক্ষিণ পূর্ব বাণিজ্যিক পথ বলতে ভারত মহাসাগরীয় সামুদ্রিক পথকে বুঝানো হয়ে থাকে। এ পথ একদিকে মেসোপোটিমিয়া এবং পারস্যোপসাগর থেকে অন্যদিকে মিশর ও লোহিত সাগর থেকে শুরু হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার পর্যন্ত চলে যেত; সেখান থেকে একদিকে শ্রীলংকা, ইন্দোচীন এবং দক্ষিণ চীন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরবের কুরাইশরাও ইসলাম পূর্ব যুগেই এ বাণিজ্যিক পথে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। বিশেষত পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য (ইরান) ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অব্যাহত যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে আরবদের স্থল বাণিজ্যিক পথ মারাত্মকভাবে বিপদ সংকুল হয়ে পড়েছিল। ইয়ামান ও হাজরা মাউতের আরব বণিকদের নৌবাণিজ্যের পূর্ব অভিজ্ঞতার সুবাদে আরবের কুরাইশরাও নৌবাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে পড়ে। সে সূত্রেই মহানবি (স.) এর আগমনের পূর্বেই তারা ভারতীয় উপমহাদেশ, বার্মা, কম্বোডিয়া ও চীনের ক্যান্টন পর্যন্ত বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিল এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর সূচনা লগ্নেই তারা দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট, চেররবন্দর, তৎকালীন আরাকানের চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের সমুদ্রোপকূলে স্থায়ী বাণিজ্যিক উপনিবেশও গড়ে তোলে। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক কালের মুসলমানরাও বাণিজ্যিক কারণে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে আসে এবং সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চীনা বাণিজ্যে মুসলিম প্রভাব অব্যাহত রাখে। তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ চীনের ক্যান্টন বন্দর ‘খানফু’ নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম বণিকগণ এ সময় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত মালাবার এবং চট্টগ্রাম থেকে কাঠ, মসলা, সুগন্ধীদ্রব্য ও ঔষধি গাছগাছড়া সংগ্রহ করত। বাণিজ্যিক কারণে মুসলমানরা এ সব অঞ্চল সফর করলেও মূলত ইসলাম প্রচার তাদের মূখ্য বিষয় ছিল। কেননা দীনের দাওয়াত দান ও দীন প্রতিষ্ঠার কাজকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছে। দীন প্রচারের এ অনুভূতির প্রেক্ষিতে তারা বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারকে অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করার কারণে মহানবির (স.) জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। মহানবি (স.) এর নবুয়াতের পঞ্চম বছরে অর্থাৎ ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে দিকে মক্কার প্রতিকুল পরিবেশে মুসলমানদের ঈমান-আকিদা নিয়ে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মহানবি (স.) সাহাবিদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। মহানবি (স.) এর নির্দেশের প্রেক্ষিতে হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) সহ প্রায় ৮৩ জন সাহাবি হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে আশ্রয় নেন। সম্রাট নাজ্জাশীর পুরো নাম আসহামার ইবনে আবহার নাজ্জাশী। তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) গায়েবানাহ জানাযা আদায় করেছিলেন। আলিমগণ কেউ কেউ তাকে সাহাবি আবার কেউ কেউ তাবেঈ মনে করেন। মূলত মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপশি ইসলামের সুমহান আদর্শ মক্কার বাইরে প্রচারের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশেই মহানবি (স.) এ সকল বিজ্ঞসাহাবিকে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। কারণ আবিসিনিয়া ছিল লোহিত সাগরে প্রবেশ পথে অবস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। পশ্চিমে মিশর এবং পূর্বে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথে চলাচলকারী বাণিজ্যিক নৌবহরসমূহ আবিসিনিয়ায় এসে যাত্রা বিরতি করত। পূর্ব পশ্চিম উভয় দিকের বণিকরাই এখানকার বাজারে বিপুল পরিমাণে পণ্য বিনিময় করত। এ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিকেন্দ্র হতে বিশ্বের খরব আদান প্রদানের বিশাল সুযোগ মুসলমানদের হাতে আসে। এটা ছিল আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলমানসহ মহানবি (স.) এর জন্য ইসলাম প্রচারের সুবর্ণ সুযোগ।মহানবি (স.) মদীনায় হিজরতের পরবর্তী সময়ে আবিসিনিয়ায় প্রায় সকল মুসলিম মুহাজির মক্কা-মদীনায় ফিরে এলেও আবু ওয়াক্কাস (রা.) আর ফিরে আসেননি। উল্লেখ্য, আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) এর পুরো নাম আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াইব। তিনি রাসুল (সাঃ) এর মাতা আমিনার আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি কাদেসিয়া যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের পিতা। তিনি চীনের কোয়াংটা শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এরই অদূরে তার মাজার এখনও বিদ্যমান। ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশী সে মাজার জিয়ারত করেছেন বলে গবেষককে জানিয়েছেন। উক্ত সাহাবী মহানবি (স.) এর নবুয়তের সপ্তম বছরে হযরত কায়স ইবনে হুযায়ফা (রা.) হযরত ওরওয়াহ ইবনে আছাছা (রা.) এবং হযরত আবু কায়স ইবনে হারেছ (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে নাজ্জাশীর দেয়া একখানা সমুদ্র জাহাজে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। তারা উক্ত জাহাজে প্রথমত ভারতের মালাবারে এসে উপস্থিত হন এবং সেখানকার রাজা চেরুমল পেরুমলসহ বহুসংখ্যক লোককে ইসলামে দীক্ষিত করে চট্টগ্রামে এসে যাত্রা বিরতি করেন। অতঃপর তিনি ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে চীনের ক্যান্টন বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। আবু ওয়াক্কাস (রা.) এর দলটি ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে রওয়ানা দিয়ে প্রায় নয় বছর পর চীনে পৌঁছেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এ নয় বছর তারা পথিমধ্যে বাণিজ্যিক কেন্দ্রসমূহে ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করেছেন। কারণ চীনে আগমনের জন্য আরব দেশ থেকে রওনা করলে বাতাসের গতিবেগের কারণে বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করতে হতো। বিশেষত বণিকেরা এক্ষেত্রে মালাবার, চেরর, চট্টগ্রাম, আকিয়াব, চীনের ক্যান্টন প্রভৃতি স্থানে জাহাজ নোঙ্গর করত। অতএব অনুমান করা যায় যে তিনি মালাবারের পর চট্টগ্রাম ও আকিয়াবেও জাহাজ নোঙ্গর করে ইসলাম প্রচারের কাজ করেছেন এবং সে সূত্রেই হিন্দের (বৃহত্তর ভারতের কোন অঞ্চলের) জনৈক রাজা কর্তৃক মহানবি (স.) এর নিকট হাদিয়া তোহফা প্রেরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবু সাইদ খুদরি (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিন্দের জনৈক শাসক মহানবি (স.) এর কাছে এক পোটলা হাদিয়া প্রেরণ করেছিলেন; যার মধ্যে আদাও ছিল। মহানবি (স.) সাহাবিদেরকে তার (আদার) এক টুকরা করে খেতে দিয়েছিলেন এবং (রাবি বলেন) আমাকেও এক টুকরা খেতে দেয়া হয়েছিল। হিন্দের কোন শাসক মহানবি (স.) এর নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জান যায়না। তবে রুহমী রাজ্যের শাসকগণ বহুকাল পূর্ব থেকেই ইরানের শাসকের কাছে মূল্যবান হাদিয়া তোহফা প্রেরণ করত। সম্ভবত এ রুহমী রাজাদেরই কোন রাজা মহানবি (স.) এর নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছিল।উল্লেখ্য যে, রুহমী রাজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক রুহমী বলতে আরাকান রাজ্যকে বুঝিয়েছেন। কেননা আরাকানের পূর্ব নাম ‘রোখাম’। এটি আরবী শব্দ; যার অর্থ শ্বেতপাথর এবং আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ের পূর্বনাম কায়কপ্রু। এটি বার্মিজ শব্দ; যার অর্থও শ্বেত পাথর। এদিক থেকে কায়াকপ্রু অঞ্চল ও রোখাম একই অঞ্চল হেতু রুহমী বলতে রোখাম বা আরাকানকেই বুঝানো যায়। মনে করা হয় যে, রোখাম শব্দটির বিকৃতরূপই রুহমী। তবে কেউ কেউ রুহমী বলতে রামুকে বুঝিয়েছেন। যদি এটা ধরে নেয়া হয় তবুও আরাকানই হয়। কেননা তখন রামু আরাকানেরই অংশ ছিল। তাছাড়া হাজার বছরের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আরাকানের ঐতিহ্যও অস্বীকার করা যায় না।অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৪৩০ সালে আরাকানে মুসলমানদের স্বাধীন শাসন চালু হয়। যা প্রায় দু'শ বছর স্থায়ী ছিল। আজকের রোহিঙ্গারা সেই স্বাধীন আরাকানের। ১৬৩১ থেকে ৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে দুর্ভিক্ষের পর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ম্রক-ইউ রাজ্যের সম্রাট নারামেখলার (১৪৩০-১৪৩৪) শাসনকালে বাঙালিদের আরাকানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সম্রাট বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করতে সক্ষম হন। যে সব বাঙালি সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা আরাকানে বসবাস করতে শুরু করে। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেওয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। সম্রাট নারামেখলা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃ্তজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামি স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে নারামেখলা নতুন মুদ্রা চালু করেন যার একপাশে ছিল বর্মি বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সি বর্ণ । বাংলার প্রতি আরাকানের কৃ্তজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেন। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। বাংলার সুলতানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আরাকানের রাজাগণ মুসলিম রীতিনীতি বজায় রেখে চলেন। বৌদ্ধ রাজাগণ নিজেদেরকে বাংলার সুলতানদের সাথে তুলনা করতেন এবং মুঘলদের মতোই জীবন যাপন করতেন। তাঁরা মুসলিমদেরকেও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতেন। ১৭ শতকের দিকে আরাকানে বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করতো। যেহেতু রাজাগণ বৌদ্ধ হওয়ার পরেও বাংলার সুলতানদের রীতিনীতি অনুযায়ীই রাজ্য পরিচালনা করতো, তাই আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সি এবং আরবি ভাষার হস্তলিপিকরদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙালি। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মিয়ানমার সরকারের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ ছিল।১৭৮৫ সালে মুসলিম বিদ্বেষী বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে। সেও ঢালাওভাবে মুসলমানদের হত্যা-নির্যাতন করতে থাকে। তার আমল থেকেই মুসলমানদের চলতে হয় দুর্বিষহ জীবনে।এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বর্মিদের গ্রেপ্তার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে[ । বার্মার শাসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপুরী।২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে “রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে।এছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে অাখ্যা দিয়েছে যেখানে গণহত্যার মত অপরাধের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মায়ানমারের বিশেষ তদন্তকারী ইয়ংহি লি, বিশ্বাস করেন, মায়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতড়িত করতে চায়। আরাকানের মোট সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৬০% রোহিঙ্গা থাকলেও বিভিন্ন সময়ের নিধন মিশনে মুসলমানদের সংখ্যা কমে এসেছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৭ সালের পূর্বে ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান ছিল। ইতোপূর্বে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বিভিন্ন সময় নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৫ লক্ষ, পাকিস্তানে ২ লক্ষ ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার, গালফ স্টেটসমুহে ৫৫ হাজার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ৪৩ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ১০ হাজারেরও বেশী মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এছাড়া ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের গণহত্যার সময় লক্ষাধিক মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং ৫ লক্ষাধিক মুসলমান দেশ থেকে বিতাড়িত হয়।২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার পর মায়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরোদ্ধে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে। এই অপারেশনে ৪০০-৩০০০ রোহিঙ্গা নিহত হন, অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ৪০০,০০০ (মায়ানমারের রোহিঙ্গার ৪০%) এর বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ৯ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিবেশী দেশসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে পালিয়ে গিয়েছে।১০০,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচুত হয়ে মায়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে রয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল