রাষ্ট্রহীন কুর্দি মুসলিমরা
মো.আবু রায়হানঃ মেসোপটেমিয়ান সমতল ভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলের একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এই কুর্দিরা। কুর্দিরা ইরানি জাতির অংশ।অধিকাংশ কুর্দিদের আবাস পশ্চিম এশিয়ায়। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া, উত্তর ইরাক, উত্তর-পশ্চিম ইরান এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আর্মেনিয়া অঞ্চলে তারা ছড়িয়ে রয়েছে।কুর্দিস্তান বলে পরিচিত অঞ্চলে এরা বসবাস করে। আধুনিককালে কুর্দিস্তান বলতে তুরস্কের পূর্বের কিছু অংশ (তুর্কি কুর্দিস্তান), উত্তর ইরাক (ইরাকী কুর্দিস্তান), দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান (ইরানি কুর্দিস্তান) এবং উত্তর সিরিয়ার (সিরীয় কুর্দিস্তান) কুর্দি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে বোঝায়। ভৌগলিকভাবে কুর্দিস্তান অঞ্চলটি জগ্রোস পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং তোরোস পর্বতমালার পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত।এছাড়া আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সামান্য কিছু এলাকাকেও কুর্দিস্তানের অন্তর্গত গণ্য করা হয়। সেলজুক তুর্কি সুলতান সাঞ্জার সম্ভবত সর্বপ্রথম ১২শ শতকে কুর্দিস্তান নামটি সরকারীভাবে ব্যবহার করেন। তিনি সেসময় কুর্দিদের আবাসভূমি বিজয় করেছিলেন এবং কুর্দিস্তান নামের একটি প্রদেশ গঠন করেছিলেন। এর রাজধানী ছিল বাহার শহর, যা বর্তমান ইরানি হামাদান শহরের কাছেই অবস্থিত। আধুনিককালে কুর্দিস্তান চারভাগে বিভক্ত। ইরাকি কুর্দিস্তান ছাড়াও অপর তিনটি হচ্ছে তুরস্কের পূর্বের কিছু অংশ (তুর্কি কুর্দিস্তান), দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান (ইরানি কুর্দিস্তান) এবং উত্তর সিরিয়ার (সিরীয় কুর্দিস্তান)।ইরাকের স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তানে কুর্দিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী।প্রতিবেশী সিরিয়া ও ইরানে কুর্দিরা সংখ্যালঘু। এসব অঞ্চলে কুর্দি জাতীয়তাবাদীরা স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন করছে।কুর্দিদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। কুর্দিশ ইন্সটিটিউট অফ প্যারিসের ২০১৭ সালের হিসেবে বিশ্বে কুর্দিদের আনুমানিক সর্বোচ্চ সংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি।তা ছাড়া জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যেও তাদের আরো প্রায় ২০ লাখ বহিরাগত মানুষ রয়েছে। তুরস্কের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% কুর্দি। ইরাকে ১৫%, ইরানে ১০% এবং সিরিয়ায় ১০% জনসংখ্যা কুর্দি। সংখ্যার হিসাবে তুরস্কে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ, ইরানে ৬০ থেকে ৮০ লাখ, ইরাকে ৬০ থেকে ৭০ লাখ, সিরিয়ায় ২০ থেকে ২৫ লাখ।মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তারা। চার-পাঁচটি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যেই তারা গণ্য হচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী হিসেবে।বর্তমানে তাদের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্প্রদায় রয়েছে। জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তারা একরকম হলেও তাদের ভাষার কোনো স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গী নেই। কুর্দি জাতির ভাষা কুর্দি ভাষা। এটি ইরানি ভাষার শাখা উত্তর পশ্চিম ইরানি ভাষার অংশ। কুর্দিদের ভাষা অনেকটা ফার্সির মতো।তবে এ ভাষায় পাঁচটি উপভাষা আছে। উপভাষারা বেশ পরিষ্কারভাবে বিচ্ছিন্ন। কুর্দির উপভাষাগুলো হচ্ছে- কুরমানজি, সোরানি, গোরানি, যাযাকি ও পেহলাওয়ানি। সিরিয় কুর্দিরা বেশিরভাগ ব্যবহার করেন কুরমানজি। ইরাকি কুর্দিরা ব্যবহার করেন কুরমানজি আর সোরানি। ইরানি কুর্দিরা ব্যবহার করেন যাযাকি বাদ দিয়ে বাকি উপভাষাগুলো। আর তুরস্কের কুর্দিরা ব্যবহার করেন পেহলাওয়ানি বাদ দিয়ে বাকি উপভাষাগুলো।কুর্দিরা মূলত সুন্নি মুসলিম। সুন্নি মুসলিমরা সংখ্যায় প্রায় ৮০%। এছাড়া ১৫% কুর্দি শিয়া মুসলিম। আর বাদবাকি ৫% কুর্দি খ্রিস্টিয়ান, ইহুদি, ইয়াজিদি, ইয়ারসানি, মানদিয়ান, বাহাই, জরথুস্ত্র এবং নির্ধর্মী। জাতিগতভাবে কুর্দিরা ধর্মপ্রসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি এবং পরমতসহিষ্ণু। সুন্নি এবং শিয়া উভয় ভাগের মুসলিমদের মধ্যে সুফিবাদের ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়।কিন্তু এই কুর্দিরা কখনো স্থায়ী একটি রাষ্ট্র পায়নি। বিংশ শতাব্দীতে কুর্দি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। কিছু কুর্দি জাতীয়তাবাদী সংগঠন কুর্দিস্তান নামের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে কুর্দি-অধ্যুষিত সমস্ত এলাকা বা এর অংশবিশেষ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অন্যরা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানাগুলির মধ্যেই কুর্দি অঞ্চলগুলির স্বায়ত্বশাসনের পরিমাণ বাড়ানোর পক্ষপাতী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে পশ্চিমা দেশগুলোর করা ১৯২০ সালে সেভরেস চুক্তিতে কুর্দি রাষ্ট্রের কথা ছিল।কিন্তু তিন বছর পর লুজান চুক্তিতে যে আধুনিক তুরস্কের মানচিত্র তৈরি হলো - তাতে কুর্দি রাষ্ট্রের ধারণা বাদ পড়লো। কুর্দি এলাকাগুলো একাধিক দেশে ভাগ হয়ে গেল এবং কুর্দিরা হয়ে গেল সংখ্যালঘু।পশ্চিমারা বিশেষ করে ইংরেজ আর ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তি অনেকটা ভারতীয় উপমহাদেশের ঢঙে আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণ করে কুর্দিদের চারটি বড় রাষ্ট্রে—তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া আর ইরানে সংখ্যালঘুতে পরিণত করে।পরের ৮০ বছরে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য কুর্দিদের নেয়া প্রত্যেকটি প্রচেষ্টাকেই নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। বিশেষ করে তুরস্ক ও ইরাকে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সালাউদ্দিন আইয়ূবীর এই বংশধররা।
ইরাকি কুর্দিস্তান ১৯৭০ সালে ইরাকি সরকারের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।২০০৫ সালে ইরাকের নতুন সংবিধানেও ইরাকি কুর্দিস্তানের এই স্বায়ত্তশাসন পুনরায় স্বীকৃতি পায়।ইরাকি কুর্দিস্তান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে একটি অঞ্চলিক সরকার বিদ্যমান। যাকে সরকারীভাবে কেআরজি বলা হয়। কেআরজি প্রধানকে প্রেসিডেন্ট বলা হয়। এটি ৪টি প্রদেশে বিভক্ত। তার প্রধান হচ্ছে আর্বিল প্রদেশ ।ইরাক নিয়ন্ত্রাধীন কুর্দিস্তানে মুসলিমদের উভয় সম্প্রদায় (সুন্নি ও শিয়া), ইয়াজিদি সম্পদায়, জরথুস্ট সম্পদায়ের লোক বাস করে। তবে কুর্দিরা সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ।ইরাকের জনসংখ্যার আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ ভাগ কুর্দি।ঐতিহাসিকভাবে, আশেপাশের যে কোনো রাষ্ট্রে বসবাসরত কুর্দিদের চেয়ে বেশি নাগরিক অধিকার এবং সুবিধা ভোগ করেছে তারা। কিন্তু তারা অন্যদের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর অত্যাচারেরও শিকার হয়েছে।১৯৪৬ সালে ইরাকে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে লড়াই করার জন্য মুস্তাফা বাজরানি কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (কেডিপি) গঠন করেন। তবে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে ১৯৬১ সাল থেকে।৭০'এর দশকের শেষদিকে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে আরবদের পুনর্বাসন শুরু করে সরকার। বিশেষ করে তেল সমৃদ্ধ কিরকুক অঞ্চলের কুর্দিদের সেখান থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পুনর্বাসন শুরু করা হয়।১৯৭৯ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় কুর্দিরা ইরানকে সমর্থন দেয়।আর তার পর সাদ্দাম হোসেন তার প্রতিশোধ নেন নির্মম অভিযান চালিয়ে। দুটি কুর্দি বিদ্রোহ দমন করা হয়। ১৯৮৮ সালে কুর্দিদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাবশত অভিযান শুরু করেন সাদ্দাম হুসেইন, যার অংশ হিসেবে হালাবজা অঞ্চলে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে যখন ইরাকের পরাজয় হয়, কুর্দি বিদ্রোহীরা তখন বাগদাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। ঐ বিদ্রোহ দমনে ইরাকের কর্তৃপক্ষের নেয়া সহিংস পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোট উত্তরে 'নো ফ্লাই জোন' ঘোষণা করে যার ফলে কুর্দিরা সেসব অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। দুই পক্ষের ক্ষমতা ভাগাভাগি সংক্রান্ত একটি চুক্তি করা হলেও ১৯৯৪ সালে ইরাকের কুর্দি দলগুলো চার বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যেই আক্রমণে সাদ্দাম হুসেইন ক্ষমতাচ্যুত হন, ঐ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে কুর্দিরা। তার দু'বছর পর উত্তর ইরাকের তিনটি প্রদেশে কুর্দিস্তান রিজিওনাল গভর্নমেন্ট (কেআরজি) প্রতিষ্ঠা করে সেসব এলাকার জোট সরকারের অংশ হয়।সেপ্টেম্বর ২০১৭'তে কুর্দিস্তান অঞ্চলে এবং ২০১৪ সালে কুর্দি মিলিশিয়াদের দখল করা বিতর্কিত অঞ্চলগুলোর মানুষ একটি গণভোটে অংশ নেয়। সেসময় ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার এই গণভোটকে অবৈধ দাবি করে এর বিরোধিতা করে। গণভোটে অংশ নেয়া ৩৩ লাখ মানুষের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। বাগদাদ কর্তৃপক্ষ ঐ গণভোটের ফল নাকচ করার প্রস্তাব করে।পরের মাসে ইরাকের সরকার সমর্থক বাহিনী কুর্দিদের দখলে থাকা বিতর্কিত অঞ্চলগুলোর দখল নেয়।ইরান, তুরস্ক সহ অনেক রাষ্ট্র এই গনভোটে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করে। তবে কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে রয়েছে ইসরাঈল।যদিও এই গণভোটের আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ইরাকি কুর্দিস্তানের নিজস্ব পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, এবং সেনাবাহিনী আছে। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের আছে তেল। তবে আশপাশের দেশে থাকা সব কুর্দিদের নিয়ে একটি দেশ গঠনের স্বপ্ন অনেক কুর্দিই দেখে থাকেন, তবে সেরকম কিছু কায়েম করার বাস্তবতা যে এখন নেই এটাও বোঝেন তারা।
তুর্কি কুর্দিস্তান বলতে তুরস্কের দুটি প্রশাসনিক অঞ্চল পূর্ব আনাতোলিয়া ও পশ্চিম আনাতোলিয়া অঞ্চলদ্বয়কে বুঝায়। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একতাবদ্ধ একটি অঞ্চল কুর্দিস্তানের তুরস্ক নিয়ন্ত্রাধীন অংশ। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কুর্দি জাতি যারা কুর্দি ভাষায় কথা বলে ও কুর্দি সংস্কৃতি লালন করে।তুরস্ক এবং সেদেশের কুর্দিদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাসটা অনেক পুরনো।তুরস্কের জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ ভাগ জাতিগতভাবে কুর্দি। কয়েক প্রজন্ম ধরে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ কুর্দিদের বিষয়ে কঠোর নীতি অনুসরণ করেছে। ১৯২৭ সালে যুক্তরাজ্যের সমর্থন নিয়ে তুরস্কের কুর্দিরা প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। তার আগে ইস্তাম্বুলভিত্তিক ইসলামী খিলাফত ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্র অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে বলেও জানা যায়।আধুনিক তুরস্কের নেতা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩০ থেকে ১৯৩৭-৩৮ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার কুর্দিদের বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করেছেন। ১৯২৫ সালেও কুর্দিরা একই ধারায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল; কিন্তু তখন বৈদেশিক কোনো শক্তির সমর্থন ছিল না।১৯২০ এবং ১৯৩০'এর দশকে কুর্দিদের বিক্ষোভের উত্থানের সময় অনেক কুর্দি পুনর্বাসিত হয়, কুর্দি নাম এবং পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, কুর্দি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, এমনকি কুর্দিদের যে একটি আলাদা জাতিগত পরিচয় আছে সেটিও অস্বীকার করা হয়।কুর্দিদের সেসময় বলা হতো 'পাহাড়ি তুর্কি।' ১৯৭৮ সালে আবদুল্লাহ ওচালান পিকেকে গঠন করেন, যাদের প্রধান দাবি ছিল তুরস্কের মধ্যে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠন। ছয় বছর পর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে ঐ সংগঠনটি। সেসময় থেকে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ কুর্দি বাস্তুচ্যুত হয়েছে।১৯৯০'এর দশকে পিকেকে স্বাধীনতার দাবি বাদ দিয়ে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালায়। তবে সেসময়ও সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখে তারা। পিকেকের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ ওচালান গ্রেপ্তার হন এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। আরস্লান প্রায় ১৪ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক দল পিকেকে-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র পিকেকে-কে একটি সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবু তুরস্ক সরকার দেশের বাইরে পিকেকে নেতাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা করেছে, বিশেষ করে নরওয়ের অসলোতে বেশ কয়েক দফা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে তুরস্ক পিকেকে-কে শর্ত দিয়েছিল যে তুরস্ক সরকারের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে হলে প্রথমেই পিকেকে-কে সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হতে হবে এবং জঙ্গিবাদী রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। দাবি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তুরস্কের কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। তুরস্কের কুর্দিদের আরো দাবি ছিল, নিজ ভাষায় (কুর্দি) শিক্ষা গ্রহণ ও তাদের বিচার বিভাগের সব কার্যক্রম পরিচালনার অধিকারসহ রাজনীতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা দেওয়া। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কুর্দি নেতা আরস্লানের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করা ছাড়াও তুরস্কের এরদোগান সরকার কুর্দি প্রস্তাবাবলি নিয়ে আইনানুগভাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছে বলে জানা গেছে। এরই প্রক্রিয়ায় পিকেকে ২০১৩ সালে তুরস্কের সঙ্গে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং তুরস্কের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের সশস্ত্র সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেয়। তবে এর আগে তুরস্কের কুর্দিরা, বিশেষ করে পিকেকে বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেও তা ভঙ্গ করে যখন সিরিয়ার সীমান্তের কাছে কুর্দি অধ্যূষিত শহর সুরুকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩৩ জন তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট নিহত হয়। ইসলামিক স্টেটকে ঐ বোমা হামলার জন্য দায়ী মনে করা হয়।সেসময় পিকেকে তুরস্কের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হামলায় সহায়তার অভিযোগ আনে এবং তুরস্কের সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলা চালায়।এর ধারাবাহিকতায় তুরস্কের সরকার পিকেকে এবং আইএস'এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, যেটিকে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমন্বিত যুদ্ধ' বলে দাবি করা হয়।সেসময় থেকে হাজার হাজার মানুষ - যাদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন - দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে হওয়া সংঘাতে নিহত হয়েছেন।অগাস্ট ২০১৬ থেকে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সেনা উপস্থিতি অব্যাহত রেখেছে তুরস্ক। সেসময় সীমান্তের ওপারে সেনাসদস্য ও ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে ঐ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর জারাব্লুস দখল করে তুর্কি বাহিনী।এর ফলে কুর্দি বিদ্রোহী বাহিনী ওয়াইপিজি'র নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স ঐ অঞ্চলের দখল নিতে ব্যর্থ হয় এবং আফ্রিন শহরের কুর্দি ঘাঁটির সাথে যুক্ত হয়।২০১৮ সালে তুরস্কের বাহিনী এবং তাদের সাথে একজোট থাকা সিরিয়ান বিদ্রোহীরা আফ্রিন থেকে ওয়াইপিজি'র যোদ্ধাদের উৎখাত করে। সেসময় অনেক বেসামরিক নাগরিক মারা যায় এবং হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়।তুরস্কের সরকারের ভাষ্যমতে, ওয়াইপিজি এবং পিওয়াইডি সাবেক পিকেকে'র সাথে সম্পৃক্ত সংস্থা এবং তারা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।তুরস্ক সরকার দাবি করে ঐ সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করছে এবং তাদের নির্মূল করা আবশ্যক।
সিরিয়ার জনসংখ্যার ৭ থেকে ১০ ভাগ কুর্দি।২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার আগে তাদের অধিকাংশের বাস ছিল দামেস্ক এবং আলোপ্পোতে। এছাড়াও উত্তর-পূর্বের শহর কামিশলি, কোবানে এবং আফ্রিন শহরেও তাদের কিছু অংশ বসবাস করতো।সিরিয়ার কুর্দিরাও দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচারিত এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।১৯৬০'এর দশক থেকে প্রায় ৩ লাখ কুর্দিকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি এবং তাদের জমি অধিগ্রহণ করে ঐসব কুর্দি অঞ্চলকে 'আরব অধ্যূষিত' অঞ্চলে পরিণত করার জন্য আরবদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে হওয়া অভ্যুত্থান যখন গৃহযুদ্ধে পরিণত হয় তখন প্রধান কুর্দি দলগুলো কোনো পক্ষ নেয়নি।২০১২'র মাঝামাঝি সময়ে দেশের অন্যান্য জায়গায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সেসব কুর্দি অধ্যূষিত অঞ্চল থেকে সরকারি বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়, যার ফলে কুর্দি দলগুলো সেসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।২০১৪'র জানুয়ারিতে প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (ওয়াইপিডি) সহ অন্যান্য কুর্দি দলগুলো আফ্রিন, কোবানে এবং জাযিরা'র তিনটি বিভক্ত প্রদেশে 'স্বায়ত্বশাসিত প্রশাসন' প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়।মার্চ ২০১৬'তে তারা আইএস'এর দখলে থাকা কয়েকটি আরব এবং তুর্কি এলাকা নিয়ে 'যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।ঐ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সিরিয়ার সরকার, সিরিয়ার বিরোধী দল, তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র। পিওয়াইডি'র দাবি, তারা স্বাধীনতা চায় না, কিন্তু সিরিয়ায় চলমান সংঘাত নিরসনের উদ্দেশ্যে নেয়া যে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতায় কুর্দিদের অধিকার এবং স্বায়ত্বশাসনের বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায় তা নিশ্চিত করতে চায়।প্রেসিডেন্ট আসাদ আলোচনা বা যুদ্ধ, যে কোনোভাবে সিরিয়ার 'প্রতি ইঞ্চি' জায়গা পুনর্দখলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কুর্দিদের স্বায়ত্বশাসনের দাবিও নাকচ করে দিয়েছে তার সরকার।
সালাউদ্দিন আইয়ুবী |
যে অঞ্চলকে নিয়ে ‘কুর্দিস্তান’ গড়তে চায় কুর্দিরা, ওই অঞ্চলে গড়পড়তায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী বাস করে। ওই সব জনগণ; আরব, তুর্কমেনি, ইয়াজিদী, অ্যাসিরিয়ানসহ খ্রিষ্টানরা কি কুর্দিদের নেতৃত্ব মেনে নেবে? তাদের ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতি কি সমাদর পাবে? সে দেশের নাম এককভাবে কুর্দিদের নামে হবে কেন? এই সব প্রশ্নে ঐকমত্যের আশ্রয় না নিয়ে জাতীয়তাবাদের হুজুগ আর মার্কিন সমর্থনে যেকোনো রাষ্ট্রের উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান চিত্র থেকে নতুন কিছু অঙ্কন করবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন