সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শাসকের ভয় এবং অভয়



আল কুরআনে আল্লাহ আরো ঘোষণা করেছেন, যে জাতি অত্যাচারী হবে সে জাতির ওপর অত্যাচারী এবং জালিম শাসক চাপিয়ে দেয়া হবে। হযরত আবদুুল কাদের জিলানি র.-এর একটি বাণী এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন, ‘যে যেমন কর্ম করবে, সে তেমন ফল ভোগ করবে।’ অনেক পণ্ডিত বলে গেছেন ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়।শাসকেরা জন দরদী হলে তাদের নিরাপত্তা জনগণ দেবে ।কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হলে অন্য কথা ।সম্রাট বা বাদশাহ মানেই হীরা-মণি-মুক্তার জৌলুস, বিলাসী জীবন আর জাঁকজমক রাজপ্রাসাদ। সেসব কিছুই ছিল না হযরত উমর (রা.)-এর। মহানবীর বিশ্বস্ত সাহাবি ও ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) মুসলিম সাম্রাজ্য এতটাই বাড়িয়েছিলেন যে, অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা হয়ে ওঠেন তিনি। বীর যোদ্ধা ও কঠোর, ন্যায়পরায়ণ শাসক বলে তাঁর নামেই থরথর কাঁপতেন ছোট-বড় সাম্রাজ্যের শাসকরা। এত প্রতাপশালী শাসক হয়েও ভোগ-বিলাসে মাতেননি হযরত উমর (রা.)। বরং দরিদ্র ও অসহায়ের জন্য মন কাঁদত তাঁর।জনগণ ছিল তার নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। তাঁর রাজপ্রাসাদ ছিল একটি কুঁড়েঘর। সেই ঘরের ছাউনি ছিল খেজুর পাতার। তাঁর সিংহাসন বলতে ছিল খেজুর পাতার মাদুর। এখানে বসেই অর্ধেক পৃথিবী শাসন করতেন হযরত উমর (রা.)।উমর ফারুক কবিতায়– কাজী নজরুল ইসলাম বলেন-
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি
খেঁজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুঠির, তুমি পড়নিকো নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা – পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভুঁয়ে!
শত প্রলোভন বিলাস বাসন ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব, ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমিছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে!
রাজপ্রাসাদে যেখানে থাকার কথা স্বর্ণ-মুক্তার ঝাড়বাতি, সেখানে ছিল জয়তুন তেলের কুপিবাতি। যে ঘরে থাকতেন তা ছিল আরও সাধারণ। অর্ধজাহানের বাদশাহ হয়ে তাঁর পরার মতো ছিল একটিমাত্র জামা। সেই জামাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। জামাটি ধুয়ে দিলে শুকানোর আগ পর্যন্ত খালি গায়েই অপেক্ষা করতে হতো। তাঁর সাম্রাজ্যের মানুষজন কেমন আছে, খেয়েছে কিনা, অসহায়দের কথা ভেবেই অস্থির হতেন। তাঁর সাধারণ জীবন অনুকরণীয়।
বাবুর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে ১৫২৬সালে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।বাবুরের মহত্ব কবিতায় কালিদাস রায় বলেন-
মাটির দখলই খাঁটি জয় নয় বুঝেছে বিজয়ী বীর,
বিজিতের হৃদি দখল করিবে এখন করেছে স্থির।
প্রজারঞ্জনে বাবুর দিয়াছে মন,
হিন্দুর-হৃদি জিনিবার লাগি করিতেছে সুশাসন,
ধরিয়া ছদ্মবেশ
ঘুরি পথে পথে খুঁজিয়ে প্রজার কোথায় দুঃখ ক্লেশ।
বাবুর তার উত্তরসূরিরা প্রায় সাড়ে তিনশত বছর ভারত শাসন করে।
আমির মুয়াবিয়া ছিলেন খিলাফতের প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইসলামের ইতিহাসে মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম দামেস্কের উমাইয়া জামে মসজিদে নিজের জীবন রক্ষার লক্ষ্যে মাকসুরা নির্মাণ করেন।মসজিদের মেহরাবের কাছে নীচু ছাদবিশিষ্ট আরেকটি কক্ষ যার নাম মাকসুরা। খলিফাদের নামাজ আদায় এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যে এই মাকসুরা নির্মাণ করা হয়েছিল। এই কক্ষের ভেতরে দাঁড়িয়ে মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লিদের দেখা যাওয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে এক জামায়াতে নামাজ আদায় করা যেত। এই মাকসুরা নির্মাণের ঘটনা থেকে সাধারণ মানুষ ও মুসল্লিদের সঙ্গে তৎকালীন খলিফাদের দূরত্বের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
একজন মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত তার নেতা তাকে কোনো প্রকার পাপের কাজে আদেশ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কথা শোনা এবং তার আনুগত্য করা- চাই তা তার কাছে ভালো লাগে কি ভালো না লাগে। তবে যখন সে কোনো অন্যায় কাজে আদেশ করবে তখন তার কথা শোনা এবং তার প্রতি আনুগত্য দেখানো যাবে না’। (মুসলিম, ১৮৩৯, মুসলিম)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...