সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মধ্য এশিয়ায় ইসলামের আগমন ও মুসলিম রাষ্ট্র




মো.আবু রায়হানঃমধ্য এশিয়ার পশ্চিম দিকে রয়েছে ক্যাস্পিয়ান সাগর, পূর্ব দিকে চীন, দক্ষিণে ইরান, আফগানিস্তান, দক্ষিণে পাকিস্তান এবং উত্তরে রয়েছে রাশিয়া। আধুনিক মধ্য এশিয়া গঠিত পাঁচটি প্রজাতান্ত্রিক দেশের সমন্বয়ে, সেগুলি হল- কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান। কখনও কখনও চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল জিনজিয়াং এবং ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকেও অনেক সময় এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।তবে তাদের কোনও ভাবেই এই পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে একাত্ম করা যায় না।
মধ্য এশিয়ার আয়তন ৩৯ লাখ ৯৪ হজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার।মধ্য এশিয়া (২০১৯) এর জনসংখ্যা প্রায় ৭২ মিলিয়ন, কাজাখস্তান জনসংখ্যা ১৮ মিলিয়ন, কিরগিজস্তান ৬ মিলিয়ন, তাজিকিস্তান ৯ মিলিয়ন, তুর্কমেনিস্তান ৬ মিলিয়ন এবং উজবেকিস্তান ৩৩ মিলিয়ন । জোরোস্ট্রিয়ানিজম, বৌদ্ধধর্ম এবং ম্যানিকাইজম-সহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সেখানে থাকতেন। অল্প সংখ্যক অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছিলেন কিছু নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান এবং ইহুদি। বর্তমানে তুর্কমেনিস্তান নামে পরিচিত এলাকার বাসিন্দারা মূলত হেলেনীয় মতে বিশ্বাসী ছিলেন।Prior to the introduction of Islam, the main religions of the oasis belt were Zoroastrianism, Buddhism, and Manichaeism. There were Nestorian Christian communities in several of the cities (a bishopric was established at Merv in the fourth century and at Samarkand in the sixth century) and a significant Jewish presence in the Samarkand-Bukhara area. In the southwest (modern Turkmenistan), there were traces of Hellenistic cults.



মধ্য এশিয়ায় ইসলাম প্রবেশ করে প্রায় বারো শ' বছর আগে ইসলামী খেলাফতের সময়। তখন মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজস্তান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান ও আজারবাইজান ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সেসব এলাকায় আরবি ভাষা এবং পরে তুর্কি ভাষা বিস্তার লাভ করেছে।হযরত উমার ফারুক (রাঃ) এর খিলাফতের সময় (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিঃ) বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য জয় করে মধ্য এশিয়ার উপকন্ঠে পৌঁছে গিয়েছিল মুসলিম বাহিনী। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী একশ বছর অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশেদিন (৬৪৪-৬৬১ খ্রিঃ) এবং উমাইয়া আমলে (৬৬১-৭৫০ খ্রিঃ) সেই ধারা অব্যহত ছিল। অবশ্য এ সময়ে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের গতি ছিল প্রথম যুগের তুলনায় মন্থর। তা সত্ত্বেও মোটামুটি অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের মধ্যে সমরখন্দ, বুখারাসহ মধ্য এশিয়া; বিশেষ করে আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানের বিরাট অংশ মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। ফলে প্রাচ্য এবং মধ্য প্রাচ্যের দুই পরাশক্তির মধ্যে মোকাবিলা তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।অষ্টম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় ইসলামের প্রসার এবং বিজয় অভিযান শুরু হয় মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের অংশ হিসাবে। উল্লেখ্য, ৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের খিলাফতকালে সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে মুসলিমরা সেন্ট্রাল এশিয়ার বিস্তৃত অংশ জয় করেছিলেন এবং একাধিক বার ফারঘানা উপত্যকায় অভিযান চালিয়েছিলেন। বর্তমান কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তানের সীমান্তে তালাসের যুদ্ধ হয়েছিল ৭৫১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক স্থানটি ঠিক কোথায় অবস্থিত তা আজও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে মনে করা হয়, খুব সম্ভবত জায়গাটি কিরগিজস্তান এবং কাজাখস্তান সীমান্তের কাছে।এখানে চীনা তাং রাজবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল আব্বাসীয় খিলাফত এবং তিব্বত সাম্রাজ্য।The Battle of Talas in 751 between the Abbasid Caliphate and the Chinese Tang dynasty for control of Central Asia was the turning point, initiating mass conversion into Islam in the region. তালাস নদীর যুদ্ধে বহু সংখ্যক চীনা সৈন্য যুদ্ধবন্দী ও নিহত হয়।

বিশাল ট্যাং সেনাবাহিনীর সেনাপতি গাও শিয়ানশি অল্প কিছু সৈন্যসহ প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, যুদ্ধবন্দী চীনাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন দক্ষ কারিগর এবং প্রকৌশলী। তাদের মাধ্যমেই কাগজ তৈরির প্রযুক্তি আরবদের হস্তগত হয়। সেই খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সাই লুন কাগজ আবিষ্কার করার পর, দীর্ঘ আটশ বছর সেই কৌশল কেবল চীনা, কোরীয় ও জাপানীদেরই জানা ছিল।কিন্তু তালাস নদীর যুদ্ধের পর কাগজ তৈরির প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো পূর্ব এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমরখন্দে কাগজ কল স্থাপিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাগদাদসহ আব্বাসীয় খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে এই শিল্পের বিকাশ ঘটে। ইউরোপের প্রথম কাগজকল স্থাপিত হয়েছিল স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায়, ১০৫৬ সালে। অবশ্যি সেটাও আরব বণিকদেরই প্রভাবে, কেননা সে সময়ে আইবেরীয় উপদ্বীপ অর্থাৎ স্পেন-পর্তুগালের বিশাল অংশ মুসলিম-আরবদের অধীনে ছিল।মধ্য এশিয়ার পরবর্তী চার শতাব্দীর ভূ-রাজনীতি বদলে দিয়েছিল এই একটি যুদ্ধ। সাথে সাথে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করেছিল ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে। কারণ তালাস নদীর যুদ্ধ অনেকটা অলিখিতভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছিল মধ্যে এশিয়ার কতটুকু অংশ আব্বাসীয় খেলাফত ও ট্যাং রাজবংশের মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ সে সময়ের দুই পরাশক্তির স্থানগত সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল এই যুদ্ধে। তালাস নদীর যুদ্ধে বিজয়ের পর সিল্করুটের একটা বড় অংশ আব্বাসীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, যা তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক ছিল। এছাড়া মধ্য এশিয়ার তুর্কী গোত্রগুলো এ সময় মুসলিমদের সান্নিধ্যে আসে এবং পরবর্তী তিন শতাব্দীতে ক্রমান্বয়ে এদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করে। তুর্কি উপজাতি কার্লুক্স-এর পতনের পরে এই এলাকা পুরোপুরি মুসলিম শাসনের অধীনে চলে আসে। ফলে, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর শুরুতে, ওয়েসিস বেল্ট পুরোপুরি মুসলিম বিশ্বের অংশে পরিণত হয় এবং ৮১৩ থেকে ৮১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাগদাদের পরিবর্তে মার্ভ ছিল খলিফা মামুনের রাজধানী। এখন মার্ভ শহরের অস্তিত্ব না থাকলেও, বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের মেরি শহরের নিকটে অবস্থিত ছিল তৎকালীন মার্ভ।

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, ৫,০০,০০০ জনসংখ্যাবিশিষ্ট মার্ভ শহর বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলির অন্যতম হয়ে উঠেছিল। ১২২১ সালে মোঙ্গল সেনা এই শহর ধ্বংস করে। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই সময়ে শরণার্থী-সহ ১০ লক্ষ বাসিন্দাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার ছয় বছর পরে চেঙ্গিস খান মারা যান। তখন তাঁর সাম্রাজ্যের প্রসার ছিল উত্তর-পূর্ব চীন থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত। মেরভ পুরোপুরি পূর্বাবস্থায় ফিরে না গেলেও, ইসলাম সেই বর্বর বিজয় অভিযানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল, এবং ক্রমশ তা বাকি সাম্রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।প্রথম মোঙ্গল যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খানের নাতি বরাকা (বার্কে) খান। তাঁর বংশধর তৈমুর লং এই অঞ্চলে ইসলামকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। একদা যারা মুসলিমদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল, পরে তারাই ইসলামের রক্ষকে পরিণত হয়েছিল।খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া ক্রমশ বাকি মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেছিল। এই অঞ্চলটির কোনও স্বতন্ত্র সীমানা না থাকলেও সিল্ক রোডের বেশ কয়েকটি প্রধান রুট ছিল, যা যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হত। যাই হোক, পরে ভারত, চীন এবং ইউরোপের মধ্যে দ্রুততর বিকল্প বাণিজ্য রুট হিসেবে সামুদ্রিক রুট তৈরি হলে অঞ্চলটি অশান্ত হয়ে ওঠে। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বহু গোষ্ঠীভিত্তিক উপজাতি এই অঞ্চল শাসন করেছিল। তবে কারও শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাশিয়ার জার সাম্রাজ্য সপ্তদশ শতকে মধ্য এশিয়া জয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। খ্রিস্টীয় ১৯ শতকে মধ্য এশিয়ার উপরে কর্তৃত্ব স্থাপন নিয়ে লন্ডন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, যা ইতিহাসের পাতায় গ্রেট গেম নামে খ্যাত। প্রতিটি স্বাধীন উজবেক অঞ্চল দখল না করা পর্যন্ত রুশ অভিযান অব্যাহত ছিল। বর্তমান উত্তর কাজাখস্তান ছিল প্রথম অঞ্চল যেটি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে এসেছিল, এবং এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ রাশিয়া সম্পূর্ণ ওয়েসিস বেল্টের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে এবং পরবর্তী এক দশকের সমগ্র এলাকা পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছিল।স্টেপ এলাকায়, জারশাসিত রাশিয়া ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেছিল। তারা মুসলিম সাহিত্য মুদ্রণ এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল। স্টেপস অঞ্চলে যাযাবরদের জন্য কয়েকটি মসজিদ ছিল। ওয়েসিস বেল্টের মুসলমানদের উৎসাহিত করা হয়েছিল যাতে তারা যাযাবরদের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশ প্রদান করে আরও সাচ্চা মুসলমান করে তুলতে পারে। শীঘ্রই কাজাখ যাযাবররা বুঝতে পেরেছিল, যে ইসলামের এই ‘নতুন’ রূপের সাথে তাঁরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জারের বিভিন্ন নীতির পরিবর্তন হতে থাকে। তখন তারা খ্রিস্টান মিশনারিদেরকে স্টেপ অঞ্চলে প্রেরণ করতে শুরু করে এবং ওয়েসিস বেল্ট এলাকায় ইসলামী রীতিনীতি পালনের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। রুশ বিপ্লবের পরে, ১৯১৭-১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়া পরিণত হয় সোভিয়েত রাশিয়ার (USSR) অংশে। আজ আমরা যে পাঁচটি প্রজাতন্ত্রের সাথে পরিচিত, সেই কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তান হিসেবে তাদের গঠন করা হয়েছিল। তবে রুশ সরকার এই এলাকার মুসলিমদের প্রতি সদয় ছিল না। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই পাঁচটি প্রজাতন্ত্র পৃথক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মধ্য এশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ১০৫ মিলিয়ন। মধ্য এশিয়ার মুসলিমদের মধ্যে কাজাখস্থান (৭০% মুসলিম), কিরঘিজস্থান (৮৬% মুসলিম), তাজিকিস্তান (৯৮% মুসলিম), উজবেকিস্তান (৯০% মুসলিম) এবং তুর্কমেনিস্তান (৯৩% মুসলিম)। এগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত রাশিয়ার দখলে ছিল।

আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ কাজাখস্তান। আর জনসংখ্যায় পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া।কাজাখস্তান মধ্এশিয়ার একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কাজাখস্তানের মোট আয়তন ২৭,২৪,৩০০বর্গকিলোমিটার। এটি বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র ।আয়তন পশ্চিম ইউরোপের আয়তনের সমান। কাজাখস্তানের সর্বাধিক প্রচলিত ধর্ম ইসলাম। এই দেশটিতে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ মুসলিম। বাকী ৩০ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ কাজাখ। ৩০ ভাগ রুশ। বাকী ১০ ভাগ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির। নৃতাত্ত্বিক কাজাখরা প্রধানত হানাফী মাজহাবভুক্ত সুন্নী মুসলিম। এখানে কিছু সংখ্যক শিয়া ও আহ্‌মদীয়া মতাবলম্বীও রয়েছে।ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, কাজাখাস্তান বিশ্বের সর্বউত্তরে অবস্থিত মুসলিম প্রধানদেশ।কাজাখ নামের তুর্কীয় জাতি এদশের প্রধান জনগোষ্ঠী যারা মোট জন্যসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং অন্যান্য মুসলিম নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলো হলো উজবেক, উইঘুর এবং তাতার। সোভিয়েত শাসনের সময় ঐতিহ্যবাহী মুসলিম দেশটির ধর্মীয় কার্যক্রমের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং হাজার হাজার মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দেয়। ২০১৯ সালে ৮০টি মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। সরকারি হিসাবমতে, কাজাখস্তানে বর্তমানে দুই হাজার ৬৯১টি মসজিদ রয়েছে। আরও শতাধিক মসজিদ নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।স্বাধীন কাজাখস্তানের প্রথম রাজধানী ছিল 'আলমা–আতা'। স্বাধীনতা লাভের পর কাজাখস্তান সরকার শহরটির নাম পরিবর্তন করে রাখে আলমাতি। ১৯৯৭ সালের ১০ ডিসেম্বরে আস্তানা শহরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৯৮ সালের ১০ জুন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহরটিকে কাজাখস্তানের রাজধানী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে শহরটির নাম নূর–সুলতান।

১ লাখ ৪৩ হাজার ১শ’ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তাজিকিস্তানের ২০১২ সালের পরিসংখ্যান মতে জনসংখ্যা ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার ৩৮৫ জন।দেশটির ২০০০ সালের শুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৭৯ দশমিক ৯ ভাগ তাজিক, ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ উজবেক, ১ দশমিক ১ শতাংশ রাশিয়ান, কিরগিজ ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং বাকি ২ দশমিক ৬ শতাংশ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর।তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে এটিই একমাত্র দেশ যেখানে ইসলাম ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। ২০০৯ সালের মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসেব মতে, দেশটির জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মুসলমান যাদের ৯৫ শতাংশ সুন্নী এবং ৩ শতাংশ শিয়া। এছাড়া রয়েছে কিছু সূফীবাদী। সুন্নীদের অধিকাংশই হানাফী মাযহাবের অনুসারী।তবে শিয়া মতাবলম্বীদের দাবি অনুযায়ী ২০১০ সালের পর ১ থেকে ২ বছরের ব্যবধানে বিস্ময়করভাবে শিয়া মতাবলম্বীদের হার ১১ থেকে বেড়ে ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদটির হানাফি মাজহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানিফার (রহ.) ১৩১০ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর নাম রাখা হয় খুড়োসন মসজিদ।২০১০ সালে বিশ্ব ইসলামি সংস্থা ওআইসি’র একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে। এতে বিশ্বের ৫৬টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন।
উজবেকিস্তানের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ। ৪,৪৮,৯৮৭ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। উজবেকিস্তানের সাড়ে তিন কোটি মানুষের মধ্যে ৮৮ শতাংশ বা ৩ কোটির বেশি মুসলমান। সুফি ঘরানায় বিশ্বাসী ও সুন্নি মতাবলম্বী।উজবেকিস্তানে রয়েছে ১২টি প্রদেশ, একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং পৃথক সত্তায় গড়ে ওঠা রাজধানী ‘তাসখন্দ’।
তুর্কমেনিস্তানের আয়তন ৪ লাখ ৯১ হাজার ২১০ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের দিক দিয়ে তুর্কমেনিস্তান বিশ্বের ৫২তম বৃহত্তম দেশ। দেশটি স্পেনের চেয়ে সামান্য ছোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের চেয়ে কিছুটা বড়।জনসংখ্যা ৫৬ লাখ ৬২ হাজার ৫৪৪ জন। মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে তুর্কমেনিস্তানের জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। তুর্কমেনিস্তানে জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে তুর্কমেন ৮৫ শতাংশ, উজবেক ৫ শতাংশ, রুশ ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য ৬ শতাংশ। প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম ৮৯ শতাংশ, খ্রিষ্টান ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য ২ শতাংশ।কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিবিসি বাংলার তথ্য মতে, পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে উজবেকিস্তান ‘দ্বিতীয় মক্কা’ হতে চায়। দেশটির সরকার মনে করে, দেশটির শতশত ধর্মীয় স্থাপনার মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা সম্ভব।
কিরগিজিস্তান মধ্য এশিয়ার পূর্বভাগের একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।এর সরকারি নাম কিরগিজ প্রজাতন্ত্র। কিরগিজস্তানের আয়তন মাত্র ১,৯৯,৯৫১ বর্গ কি.মি। কিরগিজস্তানের জনসংখ্যা ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী মাত্র ৬৪ লক্ষ,। জাতিগোষ্ঠী : কিরগিজ (৭৩%), উজবেক (১৪.৬%), রুশ (৬%), চীনা (১.১%), অন্যান্য (৫.৩%)। মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ মুসলিম এবং তাদের বেশির ভাগ সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী। এ ছাড়া অর্থডক্স খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্মাবলম্বী রয়েছে দেশটিতে।রুশ সাম্রাজ্য এবং পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনামলে দেশটিতে ইসলামচর্চা বিশেষভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। রুশ সাম্রাজ্য কিরগিজস্তান দখলের সময় আরবি ছিল দেশটির দ্বিতীয় প্রধান ভাষা। কিন্তু রুশ শাসকরা আরবিচর্চা নিষিদ্ধ করে এবং রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। স্বাধীনতার তিন দশক পরও দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজব্যবস্থায় রুশ শাসনের প্রভাব বিদ্যমান। বর্তমানে কিরগিজস্তানের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা রুশ এবং প্রধান ভাষা ‘কিরগিজ’ও লেখা হয় রুশ বর্ণে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় কিরগিজস্তানে মসজিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯।তবে আশার কথা হলো, স্বাধীনতা লাভের পর কিরগিজস্তানে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় অনুরাগ বাড়ছে এবং সেখানে ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটছে। বর্তমানে দেশটিতে আড়াই হাজারের মতো মসজিদ, ৮১টি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৬৮টি সরকার অনুমোদিত সংস্থা ও সংগঠন রয়েছে। কিরগিজস্তানে গত ২৮ বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। খবর ইন্টারন্যাশনাল কোরআন নিউজ এজেন্সির।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...