আরবলীগ কী ব্যর্থ ?
মো.আবু রায়হানঃআরবলীগ আরব দেশগুলোর সবচেয়ে বড় সংস্থা। ওআইসির পর মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংস্থা এটি। আরবি ভাষাভাষী বিশ্বের ৪৩ কোটি মানুষ ও ১কোটি ৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জনপদের প্রতিনিধিত্ব করে আরবলীগ। ৭ অক্টোবর ১৯৪৪ সালে স্বাক্ষরিত আলেকজান্দ্রিয়া প্রটোকল ছিল আরব লীগের ভিত্তি। মাত্র ছয়টি আরব মুসলিম রাষ্ট্র সৌদি আরব, মিসর, লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, জর্দান নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে আরবলীগের সদস্য রাষ্ট্র ২২টি। দেশগুলো হচ্ছে: আলজেরিয়া, বাহরাইন, কমোরোজ, জিবুতি, মিসর, ইরাক, জর্দান, কুয়েত, লেবানন, মৌরতানিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, ওমান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের সংখ্যা ৫।যেসকল দেশে ইসলাম ধর্ম প্রধান এবং ভাষা আরবি, সেসকল দেশ আরবদেশ ।মূলত সেসব দেশের সংগঠন আরবলীগ।আরবি রাষ্ট্রভাষার দেশ ২৫টি। এর মধ্যে ১৯টির প্রধান রাষ্ট্রভাষা আরবি হলেও অধুনা বহিষ্কৃত সিরিয়াসহ ২২টি রাষ্ট্র আরব লীগের সদস্য। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত হলেও ইরান, ইসরাইল, তুরস্ক আরবদেশ নয়, কারণ এদের ভাষা যথাক্রমে ফার্সি, হিব্রু এবং তুর্কি। ১৯৭৯ সালের মিশর ইসরাইল শান্তি চুক্তি পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালেই আরবলীগ মিশরের সদস্যপদ স্থগিত করে, এবং তিউনিশিয়ার এর সদর দপ্তর স্থানান্তর করে। এক দশক পরে ১৯৮৯ সালে মিশরকে আবার সদস্যপদ দেওয়া হলে আরবলীগের সদর দপ্তর কায়রোরে পুনঃস্থাপিত হয়।আরব লীগের জনসংখ্যার ৯০% মুসলমান, ৬% খ্রীষ্টান এবং ৪% অন্যান্য।আরবলীগের উদ্দেশ্য মূলতঃ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারস্পরিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা।
১৯৪৫ এর পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত আরবলীগের ভুমিকা বরাবরই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আরব লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার কোন কিছুরই প্রতিফলন নেই আরব লীগের। সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারি ছাড়া আরব লীগের নেতারা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য কিছুই করেনি।আরব লীগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল আরব জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, পারস্পরিক সংকট মোকাবেলায় নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণ এবং বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা। কিন্তু এর কোনোটাই ঠিকমতো করতে পারেনি সংস্থাটি। অভিযোগ রয়েছে, আরবলীগ ও আরব নেতাদের রহস্যময় ভূমিকার জন্য ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান হচ্ছে না। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রথম বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয় আরবলীগ। এ সময় ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে কয়েকটি সদস্য দেশ। আরব দেশগুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু তার ভেতরই অখণ্ড ফিলিস্তিনের দাবি থেকে সরে যায় সদস্য দেশ জর্দান। আরব রাষ্ট্রগুলোর মতামত উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে সমর্থন দেয়। ১৯৭৯ সালে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের পর আরবলীগে আবারও উত্তেজনা দেখা দেয়। মিসরের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। ১৯৮৯ সালে তা আবারও ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালে লেবানন সংকট মোকাবেলা এবং ১৯৬২ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিসরের রাজধানী কায়রোতে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) প্রতিষ্ঠাকে আরব লীগের অন্যতম সাফল্য বিবেচনা করা হয়। আরবলীগ ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করে। ১৯৯৬ সালে আরবলীগ ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ দেয়।। আরব দেশগুলোর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার অঙ্গীকার করা হয়েছে আরবলীগের ২০ ধারাবিশিষ্ট সংবিধানে।
তাতে বলা হয়েছে, যেকোনো বিদেশি আগ্রাসন রোধে সদস্য দেশের পাশে থাকবে আরবলীগ। নিজেদের ভেতর সৃষ্ট সংকটেরও শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু ইরাক ও লিবিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর হামলার সময় অন্য সদস্য দেশের সহযোগিতা, সিরিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ, ইয়েমেনে সৌদি জোটের হামলা ইত্যাদি সংকটে আরব লীগের ভূমিকা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব রোধের নামে আরব দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিতে আরবলীগকেও দায়ী করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৬টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৩-১৭ জানুয়ারি ১৯৬৪ তারিখে মিসরের রাজধানী কায়রোতে সর্বপ্রথম এবং ৩১ মার্চ ২০১৯ তারিখে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে আরব লীগের মাত্র ১১ জন শীর্ষ নেতা অংশগ্রহণ করেন।আরব লীগের প্রতি মুসলিম বিশ্বের, বিশেষত আরব মুসলিমদের ব্যাপক প্রত্যাশা থাকলেও শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। কিছু নিন্দা প্রস্তাব ও অঙ্গীকারসর্বস্ব ঘোষণায় শেষ হয় প্রতিটি শীর্ষ সম্মেলন। ঘোষণা ও অঙ্গীকার থাকে; কিন্তু তা বাস্তবায়নের রূপরেখা কেমন হবে তার উল্লেখ থাকে না। যেমন—সেবারের শীর্ষ সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণা। আরবলীগের শীর্ষ সম্মেলনে এই ঘোষণার নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু গোলান মালভূমির ওপর সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব কিভাবে রক্ষা করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। ২০১১ সালে সৌদিআরব, আমেরিকা ও তাদের আঞ্চলিক মিত্রদের সমর্থনে সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে লেলিয়ে দেয়া হয়। বিদেশি মদদে ওই সহিংসতা শুরু হওয়ার পর ২০১১ সালেই সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের চাপে সিরিয়ার সদস্যপদ বাতিল করে আরব লীগ।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিজয়ের মাধ্যমে দেশটির বিরুদ্ধে পশ্চিমা ও আরব দেশগুলোর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় বহু পশ্চিমা ও আরব দেশ এবং সংস্থা সিরিয়ার সঙ্গে আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে।সাম্প্রতিক সময়ে আরবলীগ ফের আলোচনায় । ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহারাইনের নিন্দা করতে আরব লীগের বৈঠকে একটি প্রস্তাব তোলে ফিলিস্তিন কিন্তু সে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নি। এ ঘটনাকে কৌশলে আরব লীগ ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে বলে মনে করছে ফিলিস্তিন। আরবলীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির নিন্দা জানানোর জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। নাম উল্লেখ না করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানায়, কয়েকটি আরব দেশ ওই চুক্তির নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এদিকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রতিবাদে আরব লীগের সভাপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণ করছে না ফিলিস্তিন। অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লাহ শহরে এক সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র ও অভিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী রিয়াদ আল-মালিকি বলেন, সর্বশেষ ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আরব লীগের পর্যায়ক্রমিক সভাপতির পদ প্রত্যাখ্যান করছে। তিনি বলেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পরও আরব লীগ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহারাইনের পক্ষ অবলম্বন করায় আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চুক্তিকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং আরবলীগের নীতি লঙ্ঘন বলে দাবি করেছে ফিলিস্তিন। এ চুক্তির ফলে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।গত ১৫ জুলাই বাহারাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি সই করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসে এ চুক্তি সই হয় এবং এতে মধ্যস্থতা করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শিগগিরই আরবের আরো কয়েকটি দেশ আমিরাত-বাহরাইনের মতো একই পথে হাঁটবে বলে দাবি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন