মো.আবু রায়হানঃ ককেসাস ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত একটি অঞ্চল। মূলত কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের মাঝে এর অবস্থান। ককেসাস অঞ্চলটি উত্তর ও দক্ষিণভাগে বিভক্ত – উত্তর ককেশাস অঞ্চলটি মূলত সিসককেসাস নামে পরিচিত। অপরদিকে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চল ট্রান্সককেসাস নামে পরিচিত।সিসককেসাসের মধ্যে মূলত বৃহত্তর ককেসাসের পার্বত্য অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে উত্তর ককেসীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র সমূহসহ রাশিয়ার দক্ষিণাংশ, জর্জিয়ার উত্তরাংশ এবং আজারবাইজান। সিসককেসাসের পশ্চিমে কৃষ্ণ সাগর, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর এবং উত্তর সীমানায় রাশিয়ার দক্ষিণের ফেডারেল জেলাসমূহ অবস্থিত। উত্তর প্রান্তে রাশিয়ার এই ফেডারেল জেলা দুটি সম্মিলিতভাবে দক্ষিণ রাশিয়া নামে পরিচিত।ট্রান্সককেসাস বৃহত্তর ককেশীয়ার সীমানাকে চিহ্নিত করে। এর উত্তর সীমান্তে রয়েছে রাশিয়ার দক্ষিণাংশ, পশ্চিমে রয়েছে কৃষ্ণসাগর ও তুরস্ক, পূর্বে কাস্পিয়ানসাগর এবং দক্ষিণে ইরান। লেসার ককেসীয় পর্বতশ্রেণী এবং তাকে ঘিরে থাকা নিম্নভূমিসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। সম্পূর্ণ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান (সর্ব উত্তরের অংশ বাদে) এবং জর্জিয়া (সর্ব উত্তরের অংশ বাদে) দক্ষিণ ককেশাসের অন্তর্ভুক্ত।ককেসাস অঞ্চলের সর্বোচ্চশৃঙ্গ এলব্রুস পর্বত পশ্চিম ককেশাসে অবস্থিত।এলব্রুস পর্বতের উচ্চতা ৫,৬৪২ মিটার এবং একে ইউরোপের সর্বোচ্চচূড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা বৃহত্তর ককেসাস পর্বতশ্রেণীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত।ককেসাস অঞ্চল তার ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি।ককেসাসের অন্তর্ভুক্ত জাতি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র জর্জিয়া (আদজারা অন্তর্ভুক্ত), আজারবাইজান (নাখচিভান অন্তর্ভুক্ত), আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ান ফেডারেশন।ককেশাসের অন্তর্ভুক্ত রাশিয়ার বিভাগগুলো হলো দাগেস্তান, চেচনিয়া, ইঙ্গুশেটিয়া, উত্তর ওশেতিয়া-আলানিয়া, কাবারদিনো-বাল্কারিয়া, কারাচে-চেরকেসিয়া, আদিজিয়া, ক্রাস্নোদার ক্রাই এবং স্তাভ্রোপোল ক্রাই।এই অঞ্চলের আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র, আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওশেতিয়া তিনটি এলাকা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, কিন্তু তারা জাতিসংঘের দ্বারা স্বীকৃত নয়।অধিকাংশ দেশ আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওটেশিয়াকে জর্জিয়ার অংশ এবং আর্টসাখকে আজারবাইজানের অংশ বলে মনে করে।
ককেসাস অঞ্চলে প্রায় ৫০টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। উত্তর ও দক্ষিণ ককেসীয়ার জনগণ ধর্মীয়ভাবে সাধারনত সুন্নি মুসলিম, ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান বা আর্মেনীয় খ্রিস্টান হয়ে থাকে। আজারবাইজান হতে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটির দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে অনেক বারো ইমাম মতবাদের শিয়া অনুসারী দেখা যায়,তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত ককেসাস অঞ্চলটি শত শত বছর ধরে রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সম্প্রসারণবাদের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। দীর্ঘ ঐতিহাসিক কাল জুড়ে ককেসাস অঞ্চলটি ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উনবিংশ শতাব্দির প্রথমভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ ককেসাস এবং দক্ষিণ দাগেস্তান পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮১৩ হতে ১৮২৮ সালের মধ্যে যথাক্রমে গুলিস্তান চুক্তি এবং তুর্কমেনচাই চুক্তির মাধ্যমে ইরান দক্ষিণ ককেসাস এবং দাগেস্তান রুশ সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। এই অর্জনের পরবর্তী বছরগুলোতে রাশিয়ানরা অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে বেশ কিছু যুদ্ধ করে এবং পশ্চিম জর্জিয়া সহ অবশিষ্ট দক্ষিণ ককেসাস দখল করে নেয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে জর্জিয়া, আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর হতে এই অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধ (১৯৮৮-১৯৯৪), পূর্ব প্রিগোরোডনি সংঘর্ষ (১৯৮৯-১৯৯১), আবখাজিয়ার যুদ্ধ (১৯৯২-৯৩), প্রথম চেচেন যুদ্ধ (১৯৯৪-১৯৯৬), দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ (১৯৯৯-২০০৯) এবং দক্ষিণ ওশেতিয়ার যুদ্ধ (২০০৮) ইত্যাদি অন্যতম।আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ায় বাড়ছে মুসলিম জনসংখ্যা।২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪৬.৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৪ মিলিয়ন , যা রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। দিন দিন ইসলাম ধর্মের দিকে ঝুঁকছেন দেশটির মানুষ। আর তাই আগামী ১৫ বছরের মধ্যে দেশটির মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগই হবে মুসলিম। আর আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হবে মুসলিম। রাশিয়ার ফেডারেল অ্যাসেম্বলির নিম্নকক্ষে ‘স্টেট ডুমা’ আয়োজিত এক ফোরামে দেশটির অর্থোডক্স চার্চের প্রধান যাজক দিমিত্রি স্মির্নভ এসব তথ্য তুলে ধরেন। রুশ ফেডারেশনের অধীনে এখনও ৮টি মুসলিম-অধ্যুষিত বা মুসলিমদের জন্য সৃষ্ট প্রজাতন্ত্র রয়েছে। এগুলো হলো মধ্য রাশিয়ায় অবস্থিত তাতারস্তান ও বাশকোর্তোস্তান এবং উত্তর ককেশাসে অবস্থিত চেচনিয়া, ইঙ্গুশেতিয়া, দাগেস্তান, কাবার্দিনো-বালকারিয়া, কারাচাই-চের্কেশিয়া ও আদিগেয়া। মুসলিম এলাকাগুলোর জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে দুই কোটি মুসলিম। ইংগুশেতিয়ার ৯৬ শতাংশ মানুষ মুসলিম। দাগেস্তানের মুসলিম জনসংখ্যা ৯২ শতাংশ। তাতারস্থান ও কারজাই এলাকায় ৫০ শতাংশের বেশি মুসলিম।
চেচনিয়া রাশিয়ার ককেসাস অঞ্চলের একটি অংশ। চেচনিয়া রাশিয়ার প্রজাতন্ত্র।এর পার্শ্ববর্তী আরো দুটি প্রজাতন্ত্র হলো ইঙ্গুশেতিয়া আর দাগেস্তান।চেচনিয়ার আয়তন ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটা উত্তর ককেশাসে পূর্ব ইউরোপের সর্বদক্ষিণ অংশে অবস্থিত, এবং কাস্পিয়ান সাগরের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী গ্রোজনি শহর।২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা হল, ১২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৯৮৯ জন। জনসংখ্যার বেশিরভাগ প্রধানত চেচেন জাতিগোষ্ঠির এবং তার সাথে কিছু রুশ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ ছিল।ককেসাসের প্রবেশ দ্বার চেচনিয়া কৌশলগত দিক দিয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কৃষ্ণ ও কাস্পিয়ান সাগরের সংযোগ অঞ্চল চেচনিয়া ১৮ শতকে রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংযোজিত হয়। জার পিটার দ্য গ্রেট অঞ্চলটি দখল করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ইউক্রেন, জর্জিয়া, আর্মেনিয়াসহ বারোটি দেশ রাশিয়া থেকে বেরিয়ে এলেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিৎ ইয়েলৎসিন চেচনিয়ায় এসে সীমান্তের ইতি টানেন। রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই চেচনিয়াকে ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু চেচেনরা কখনোই রাশিয়ার প্রভুত্ব মেনে নেয়নি। স্থলযুদ্ধে পরাস্ত করে পরাক্রমশালী রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে।১৯৯১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল ঝোখার দুদায়েভের নেতৃত্বাধীন অল-ন্যাশনাল কংগ্রেস অফ দ্য চেচেন পিপল দলের সদস্যরা স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে চেচেন-ইঙ্গুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সুপ্রিম সোভিয়েতের একটি অধিবেশনে আক্রমণ চালায়।আক্রমণকালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির গ্রোজনি শাখার প্রধান ভিতালি কুৎসেঙ্কো নিহত হন, ফলে চেচেন-ইঙ্গুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সরকারের পতন ঘটে । পরের মাসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দুদায়েভ বিপুল জনসমর্থন লাভ করে জয়লাভ করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সরকার সমর্থিত প্রজাতন্ত্রটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বহিষ্কার করেন। দুদায়েভ চেচনিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৯১ সালের নভেম্বরে ইয়েলৎসিন গ্রোজনিতে একদল অভ্যন্তরীণ সৈন্য প্রেরণ করেন, কিন্তু দুদায়েভের সৈন্যরা বিমানবন্দরে তাদেরকে ঘিরে ফেললে তারা প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়। ১৯৯২ সালের জুনে রাশিয়ার উত্তর ওসেটিয়া-আলানিয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ইঙ্গুশদের সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলে চেচেন-ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্রটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। নবগঠিত ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্র রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে, অন্যদিকে চেচনিয়া ১৯৯৩ সালে ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্র নামে মস্কোর নিয়ন্ত্রণ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
প্রথম চেচেন যুদ্ধ বা চেচনিয়ার যুদ্ধ ছিল ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত রাশিয়া এবং ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি যুদ্ধ। ১৯৯৪–১৯৯৫ সালের প্রাথমিক অভিযানে রুশ সৈন্যরা চেচনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু প্রচুর লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র ও বিমান সমর্থন থাকা সত্ত্বেও চেচেন গেরিলা যোদ্ধারা রুশ বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। রুশ সৈন্যদের মনোবলের অভাব, রুশ জনমতের তীব্র বিরোধিতা এবং গ্রোজনির যুদ্ধে রুশদের পরাজয়ের ফলে বোরিস ইয়েলৎসিনের সরকার ১৯৯৬ সালে চেচেনদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এবং পরবর্তী বছর তাদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে।রুশ সরকারের তথ্যমতে, যুদ্ধটিতে ৫,৭৩২ জন রুশ সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু অন্যান্য হিসেব অনুসারে নিহত রুশ সৈন্যের সংখ্যা ৩,৫০০ থেকে ৭,৫০০ এর মধ্যে, এমনকি ১৪,০০০ বলেও দাবি করা হয়। আসলান মাসখাদভ ছিলেন একজন সোভিয়েত কর্নেল। প্রথম চেচেন যুদ্ধের সময় তিনি দারুণ সামরিক দক্ষতা দেখান। ১৯৯৭ সালে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ওই বছরই রুশ-চেচেন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী রুশেরা চেচেন সরকারকে টুকটাক সাহায্য করতো। তবে মাসখাদভ সুশাসক ছিলেন না। হরদম তার সাথে বিরোধীদের লড়াই লেগে থাকতো। তেল পাচার, অস্ত্র আর মাদকের ব্যবসা, যুদ্ধ আর দুর্নীতিতে ভরপুর সরকার মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৯৯ এর শেষদিকে মাসখাদভের বিরোধীরা শরিয়া মোতাবেক একটি রাষ্ট্র গড়বার কথা ঘোষণা করেন। তাদের পরিকল্পনায় ছিল চেচনিয়ার সাথে প্রতিবেশী দাগেস্তান আর ইংগুশেতিয়াকে জুড়ে নেওয়া। শামিল বাসায়েভ ছিলেন এদের অন্যতম নেতা।
চেচনিয়ার প্রতিবেশী দাগেস্তানে চেচেনরা মাঝেমধ্যে হামলা চালাতো। ১৯৯৯ সালে এক রুশ জেনারেলকে অপহরণ আর খুন করা হলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। সামিল বাসায়েভ আর ইবন আল খাতাবের নেতৃত্বে একদল চেচেন দাগেস্তানে হামলা চালালে দুই পক্ষে ভয়ানক লড়াই লাগে। রুশেরা জিতলেও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে চেচেনদের বোমা হামলায় শতিনেক বেসামরিক মানুষ মারা যায়। এসব হামলার প্রতিক্রিয়া হয় ভয়ানক। অক্টোবরে রুশ বাহিনী আবার চেচনিয়াতে প্রবেশ করে। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে গ্রোজনীর পতন হয়। রাশিয়া ২০০২ সাল পর্যন্ত ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়, চেচেন যোদ্ধাদের একেবারে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও রুশেরা এই দফাতেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ২০০৩ সালে চেচনিয়ার ক্ষমতায় বসেন রুশপন্থী আখমাদ কাদিরভ। বিরোধীরা বার বার আলোচনার জন্য আহ্বান জানালেও এবারে রুশ বাহিনী কোনো ছাড় দেয়নি। ২০০৫ সালে আসলান মাসখাদভকে হত্যা করে রুশ বাহিনী। মাসখাদভের প্রধানমন্ত্রী বাসায়েভ ২০০৬ সালে নিহত হন।চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে সানজা নদী তীরবর্তী শেলী শহরে নির্মাণ করা হয়েছে সবচেয়ে বড় মসজিদ। ৯ হাজার ৭০০ বর্গমিটার জমির উপর নির্মিত হয়েছে মসজিদটি। এটিকে ইউরোপীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। মসজিদটির নাম রাখা হয়েছে ফাখর আল-মুসলিমিন। বাংলায় যার অর্থ দাড়ায় মুসলমানদের গর্ব।
ইঙ্গুশেতিয়া ভৌগোলিকভাবে উত্তর ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত এবং প্রশাসনিকভাবে রুশ ফেডারেশনের উত্তর ককেশীয় কেন্দ্রীয় জেলার অন্তর্ভুক্ত। ককেশাস পর্বতমালার ১৫০ কি.মি. ইঙ্গুশেতিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত। প্রজাতন্ত্রটির পূর্বে চেচেন প্রজাতন্ত্র, উত্তর ও পশ্চিমে উত্তর ওশেতিয়া–আলানিয়া প্রজাতন্ত্র এবং দক্ষিণে জর্জিয়া অবস্থিত। জর্জিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকায় ইঙ্গুশেতিয়া পুরোপুরিভাবে রুশ ভূখণ্ড দ্বারা বেষ্টিত নয় এবং প্রজাতন্ত্রটির আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির বৃহত্তম শহর ও প্রাক্তন রাজধানী নাজরান, কিন্তু ১৯৯৫ সালে রাজধানী মাগাস শহরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। যেটি আয়তনে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় শহরগুলো বাদে অন্য সকল প্রশাসনিক অঞ্চল অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর। আনুষ্ঠানিকভাবে ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত এই প্রজাতন্ত্রটির আয়তন ৩,১২৩ বর্গ কি.মি. এবং বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ৭ হাজার। প্রজাতন্ত্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৪.১% জাতিগত ইঙ্গুশ, ৪.৬% জাতিগত চেচেন, ০.৮% জাতিগত রুশ এবং ০.৫% অন্যান্য জাতিভুক্ত। ইঙ্গুশরা জাতিগতভাবে 'উত্তর–পূর্ব ককেশীয়' জাতিসমূহের অংশ এবং তাদের মাতৃভাষা ইঙ্গুশ। ইঙ্গুশদের সিংহভাগই সুন্নি ইসলাম ধর্মের অনুসারী, তবে তাদের মধ্যে কিছু খ্রিস্টানও রয়েছে। ইঙ্গুশেতিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৯৬% মুসলিম, ২% খ্রিস্টান এবং বাকি ২% অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুসলিম–অধ্যুষিত এই প্রজাতন্ত্রটি আধা–স্বায়ত্তশাসিত এবং প্রজাতন্ত্রটির নিজস্ব রাষ্ট্রীয় পতাকা, প্রতীক, সঙ্গীত, আইনসভা, সংবিধান ও আদালত রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রভাষা দুইটি – ইঙ্গুশ এবং রুশ। প্রজাতন্ত্রটির ৩২ সদস্যবিশিষ্ট আইনসভার নাম ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্রের গণপরিষদ।
দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রটি উত্তর ককেশাস পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত।আয়তন: ৫০,৩০০ বর্গকিলোমিটার।দাগেস্তান রাশিয়ার দক্ষিণাংশে অবস্থিত এবং দাগেস্তানের পূর্ব সীমান্তে কাস্পিয়ান সাগর অবস্থিত।দাগেস্তান শব্দটি তুর্কি ও ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে।তুর্কি দাগ শব্দটির অর্থ পর্বত এবং -স্তান শব্দটি এসেছে একটি ফার্সি প্রত্যয় হতে, যার অর্থ 'ভূমি'। অর্থাৎ, দাগেস্তান শব্দের অর্থ দাঁড়ায় পার্বত্য ভূমি।দাগেস্তান প্রজাতন্ত্র হল উত্তর ককেসাস অঞ্চলে অবস্থিত রাশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত একটি প্রজাতন্ত্র। এর রাজধানী এবং সর্ববৃহৎ শহর হলো মাখাচকালা, যা দাগেস্তান অঞ্চলের মাঝামাঝি কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলে অবস্থিত। ১৯২১ সালে দাগেস্তান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে প্রজাতন্রের সীমানা নির্ধারিত হয়। এ সময়ে তেরেক নদী হতে দক্ষিণে কাস্পিয়ান সাগরের তীর পর্যন্ত তেরেক প্রদেশের পূর্বাংশের অপার্বত্য সমতল ভুমি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।বর্তমানে অঞ্চলটি সরাসরি রুশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। ১৯১৭ সালে ২১ ডিসেম্বর ইঙ্গুশেতিয়া, চেচনিয়া এবং দাগেস্তান একত্রে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ইউনাইটেড মাউন্টেইন ডুয়েলারস অব দা নর্থ ককেসাস নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। বিশ্বের প্রধান শক্তিশালী দেশগুলো এই নবগঠিত রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। নবগঠিত রাষ্ট্রের রাজধানী দাগেস্তানের তেমির-খান শুরা'তে স্থানান্তরিত করা হয়। বিশিষ্ট চেচনিয় কূটনৈতিক তাপা চেরমোয়েভ ছিলেন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ইঙ্গুশ কূটনৈতিক ভাসান-গিরেয় ঝাবাগিয়েভ ছিলেন দেশটির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯১৭ সালে গৃহীত দেশটির সংবিধানের রচিয়তা ছিলেন।১৯২০ সালে তিনি তৃতীয় মেয়াদে পুনঃনির্বাচিত হন।১৯২১ সালে রাশিয়ানরা দেশটিতে আক্রমণ করে এবং জোরপূর্বক অঞ্চলটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করে। এর পরেও ককেসিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলতে থাকে, তবে দেশটির সরকার নির্বাসনে চলে যায়। বলশেভিক বিপ্লবের পরে অটোমান সৈন্যরা আজারবাইজান দখল করে এবং দাগেস্তান উত্তর ককেসীয় মাউন্টেন রিপাবলিক নামক ক্ষণস্থায়ী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। এদিকে রাশিয়ায় সাদা আন্দোলন এবং স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদের সাথে তিন বছরের লড়াইয়ের পরে অবশেষে বলশেভিকরা বিজয় লাভ করে, যার ফলশ্রুতিতে ১৯২১ সালে ২০ জানুয়ারি দাগেস্তান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।দাগেস্তানে ১৯৯০ এর দশকে জাতিগত উত্তেজনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।১৯৯৯ সালে স্বাধীন ইসলামিক দাগেস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি চেচনীয় ইসলামিক সংগঠন দাগেস্তানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন শামিল বাসায়েভ এবং ইবনে আল-খাত্তাব। রুশ সামরিক বাহিনী আক্রমণকারীদের প্রতিহত করে এবং ফেরত পাঠায়। এর প্রতিশোধ স্বরূপ রাশিয়ান বাহিনী ঐ বছরের শেষের দিকে পুনরায় চেচনিয়ায় অভিযান পরিচালনা করে। ২০০০ সাল হতে দাগেস্তান একটি স্বল্পমাত্রার গেরিলা যুদ্ধের স্থান হয়ে উঠেছে, যার সূত্রপাত হয়েছে চেচনিয়া থেকে। এই সংঘর্ষের ফলে শত শত সেনা ও সরকারী কর্মকর্তার প্রাণহানি ঘটেছে। এদের অধিকাংশই স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর সদস্য। এছাড়াও এই যুদ্ধে প্রচুর দাগেস্তানি জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহী এবং জনসাধারণের প্রাণহানি ঘটেছে।
জনসংখ্যা ২,৯১০,২৪৯ (আদমশুমারি ২০১০)।২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী, দাগেস্তানের ৮৩% মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। অন্যদিকে, ২.৪% রুশ অর্থোডক্স চার্চ, ২% ককেশীয় লোকধর্ম ও স্থানীয় ধর্মবিশ্বাস এবং ১% জনগণ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। এছাড়াও, ৯% মানুষ আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী হলেও ধার্মিক নন, ২% নাস্তিক এবং ০.৬% মানুষ তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ে উত্তর দেননি। দাগেস্তানিরা মূলত শাফি মতবাদে বিশ্বাসী সুন্নি মুসলিম এবং তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা পালন করছে। কাস্পিয়ান উপকূলে মূলত বন্দর নগরী দারবান্দ ও তাঁর আশেপাশের এলাকার জনগণ প্রধানত শিয়া (প্রাথমিকভাবে আজারবাইজানি জাতিগোষ্ঠীর)। এই অঞ্চলে কিছু সালাফি মতবাদের মানুষও বসবাস করে।দাগেস্তানের সংসদ পিপলস এসেম্বলি অব দাগেস্তান নামে পরিচিত। সংসদের মোট আসন সংখ্যা ৭২ এবং প্রত্যেক সংসদ সদস্য ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। পিপলস এসেম্বলি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী এবং আইন প্রণয়নকারী সংস্থা।২০০৩ সালের ১০ জুলাই দাগেস্তানের সংবিধান গৃহীত হয়। এটি অনুসারে সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় পরিষদের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ১৪টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সাংবিধানিক পরিষদের মাধ্যমে দাগেস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্যদের চার বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় পরিষদ সরকারের অভ্যন্তরীণ সদস্যদের নিয়োগ দেয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন