দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের আগমন ও মুসলমান




মো.আবু রায়হানঃদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হল সমগ্র এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশ, ভৌগোলিকভাবে বলা যেতে পারে- চীনের দক্ষিণে, ভারতের পূর্বে, নিউগিনির পশ্চিমে এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে অবস্থিত দেশগুলির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর সীমানায় পূর্ব এশিয়া, পশ্চিমে দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ওশেনিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত মহাসাগর অবস্থিত।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আয়তন প্রায় ৪৫ লাখ বর্গকিলোমিটার,যা এশিয়ার ১০.৫% বা পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ৩%। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মোট জনসংখ্যা ৬৫৫ মিলিয়নেরও বেশি, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৮.৫%। দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার পরে এটি এশিয়ার তৃতীয় সর্বাধিক জনসংখ্যার ভৌগোলিক অঞ্চল।দক্ষিণপূর্ব এশিয়া (Southeast Asia) কথাটি সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৮৩৯ সালে আমেরিকার একজন ধর্মযাজক হাওয়ার্ড ম্যালকমের (Howard Malcom) একটি ভ্রমণ বৃত্তান্তে।যিনি আমেরিকার ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির উদ্যোগে নানা অজানা তথ্য আহরণের জন্য এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার বিবরনীটির শিরোনাম ছিল Travels in South-Eastern Asia, Embracing Hindustan, Malaya, Siam, and Chinaমূলত এ বিবরণেই প্রথম Southeast Asia অর্থ্যাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া শব্দটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অঞ্চলটিকে দুটি উপঅঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া মূলভূখন্ড (অথবা ইন্দোচীন) যা গঠিত হয়েছে বর্তমান ভিয়েতনাম,লাওস,কম্বোডিয়া,থাইল্যান্ড, মায়ানমার(বর্মা) এবং পশ্চিম মালয়েশিয়া নিয়ে এবং উপকূলবর্তী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া (অথবা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া উপদ্বীপ) যা গঠিত হয়েছে বর্তমান ইন্দোনেশিয়া, পূর্ব মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন দ্বীপপূঞ্জ, পূর্ব তিমুর, ব্রূনেই, কোকোস(কিলিং) দ্বীপপুঞ্জ ও ক্রিসমাস দ্বীপ নিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্যের এগারটি দেশ নিয়ে গঠিত। ব্রূনেই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম। পূর্ব তিমুর বাদে বাকি ১০টি দেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা (Association of Southeast Asian Nations) আসিয়ানের সদস্য।বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত চারটি ধর্মের মানুষ বাস করে বৌদ্ধ ধর্ম , ইসলাম ধর্ম , খ্রিস্টধর্ম এবং হিন্দু ধর্মের।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রসার ঘটেছিল শান্তিপূর্ণভাবে। এই অঞ্চলে ইসলামের প্রবেশ এবং বিস্তার ঘটেছিল বাণিজ্যের পথ ধরে এবং সুফি সাধকদের মাধ্যমে। It is believed that Islam first arrived in these South-eastern regions by the 7th century. Muslim merchants from the Arabian Peninsula had to pass through these islands of the south via the maritime Silk Roads to reach China's ports.আব্বাসীয় খিলাফতের প্রাথমিক বিবরণ অনুসারে, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জটি জায়ফল, লবঙ্গ এবং আদা জাতীয় এক ধরনের মশলা গলঙ্গলের প্রাচুর্যের কারণে মুসলিম নাবিকদের কাছে বিখ্যাত ছিল।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম প্রসারের পূর্বে ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলে তিনটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল, যেগুলো হলো শ্রীবিজয়া(মালয়েশিয়া), মাজপাহিত (ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ) ও সিয়াম বা শ্যাম (থাইল্যান্ড)। জনগণ তখন হিন্দু, বৌদ্ধ ও সর্বপ্রাণবাদের সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি মিশ্র ধর্ম অনুসরণ করতো। ইসলামের তৃতীয় খলীফা ওসমানের রাজত্বের প্রথম দিকে আরব মুসলিম বণিকরা সমুদ্রপথে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় বন্দরে যাত্রাবিরতির মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের সাথে ইসলামের যোগসূত্র স্থাপন করে।প্রথম যে মুসলিম চীন সফর করেছিলেন তিনি হলেন সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)। মনে করা হয়, তিনি ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে চীনের ক্যান্টন শহরে এসেছিলেন।৬৫১ সালে একটি দূতাবাস স্থাপনের জন্য সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) তৃতীয় বার চীন সফরে এসেছিলেন। তাং সম্রাট গাওজং তাতে সম্মতি প্রদান করেন এবং ক্যান্টনে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। এভাবেই ক্যান্টন (কুয়াংচৌ)-তে চীনের প্রথম মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠে।

৯০৪ সাল থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত মুসলিম বণিকরা শ্রীবিজয়ার সুমাত্রা বন্দরের বাণিজ্যকর্মে ক্রমে অধিকতর জড়িত হয়।The expansion of trade among West Asia, India and Southeast Asia helped the spread of the religion as Muslim traders brought Islam to the region. Gujarati Muslims played a pivotal role in establishing Islam in Southeast Asia. The second theory is the role of missionaries or Sufis. ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুসলিম বণিকরা ভারতের গুজরাট, বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় বন্দর এবং চীন থেকেও অধিক সংখ্যায় আসতে থাকে। এসব মুসলিম বণিক, যারা সর্বদাই ধর্মপ্রচার মিশন সঙ্গে আনত, তারা উপকূলীয় বন্দর-শহরগুলোতে স্থায়ীভাবে বসতিস্থাপন করে, যেমন মালাক্কা ও উত্তর সুমাত্রার (আচেহ, জাভা) সুমাত্রা বা পাসাই। তারা স্থানীয় নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায় গড়ে তোলে। সম্ভবত দশম শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ অঞ্চলে মুসলিম বণিক কর্তৃক স্থাপিত মুসলিম বসতি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে উত্তর সুমাত্রায় উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি গড়ে তোলে। এ সময়ের মধ্যে তারা দু’টো মুসলিম নগর-রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। একটা সুমাত্রা বা পাসাই-এ, অপরটি ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের পার্লাক-এ ।খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে বহু আরব ব্যবসায়ীরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন।সমুদ্র নামের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে।ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে রাজ্যটির পতন ঘটে।
১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মালিক আল-সালেহের কবরের উপরে নির্মিত স্মৃতিসৌধটি হল ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া প্রাচীনতম ইসলামী শিলালিপিগুলির মধ্যে একটি । এ থেকে জানা যায় যে, সুমাত্রার একটি রাজ্য সমুদ্রের প্রথম শাসক মুসলমান ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো ১২৯২ সালে চীন থেকে ইউরোপ ফেরার পথে উত্তর সুমাত্রায় থেমেছিলেন। তখন তিনি পার্লাক নামের একটি ইসলামিক শহর পরিদর্শন করেছিলেন। আবার আরব পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাদে পার্লাক শহর পরিদর্শন করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে, এর রাজা একজন সুন্নি মুসলমান। মালাক্কা মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরকে সংযোগকারী মালাক্কা প্রণালীর তীরে অবস্থিত। আনুমানিক ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে মালয়ের পলাতক রাজা পরমেশ্বর এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৪১০ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর পরমেশ্বর হিন্দু রাজ্য শ্রীবিজয়াকে একটি মুসলিম সুলতানাত অর্থাৎ মালাক্কা সুলতানাতে পরিণত করেন এবং নিজে সুলতান ইস্কান্দার শাহ নাম ধারণ করেন।১৫শ’ শতকে মালাক্কার রাজারা মালয় উপদ্বীপের অধিকাংশ এবং সুমাত্রা দ্বীপের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। পর্তুগিজরা ১৫১১ সালে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়া এসেছিল।বিখ্যাত পর্তুগিজ পর্যটক ও নাবিক অ্যাফোন্সো ডি অ্যালবুকার্কির নেতৃত্বে তারা ১৫০৭ সালে গুজরাটের সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দিউ বিজয় এবং ১৫১০ সালে গোয়া বিজয়ের পর ১৫১১ সালে মালাক্কা বিজয় করে।মালয় উপদ্বীপ, সুমাত্রা এবং জাভা দ্বীপাঞ্চল থেকে শুরু করে ফিলিপাইন পর্যন্ত ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্থানীয় লোকেরা ইসলামের সংস্পর্শে আসেন এবং ধর্মান্তরিত হন। ভারত, চীন এবং মধ্য প্রাচ্যের বিদেশী মুসলমানরা মালয় উপদ্বীপ সফরে এসে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। মনে করা হয় যে, বিদেশ থেকে এসে বসতি স্থাপন করা নতুন নাগরিকরা নিজেদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপরে জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। পরিবর্তে তাদের স্থানীয় সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিল।মালাক্কা উপদ্বীপের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জেরে চীন, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল এবং এভাবে কোনও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়াই ইসলাম এই অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।কেননা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামী সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল স্থানীয় সংস্কৃতি। ধর্মীয় আকিদা বিশ্বাস এবং শৈল্পিক অর্জন বিশেষ করে নিজস্ব শিল্পের ভিত্তিমূলে স্থাপিত ছিল সেই সংস্কৃতি। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, যখন এই এলাকায় স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজদের আগমন ঘটে, তত দিনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিকতাবাদ সত্ত্বেও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।এ অঞ্চলের মুসলমানরা সবসময় নিজেদের দেশে বিদেশীদের উপস্থিতির বিরোধী ছিল। এ কারণেই ১৫১১ সালে মালয়-তে এবং ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দে সলুক দ্বীপে পর্তুগিজদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে মুসলমানরা ব্যাপক সংগ্রাম করেছিল। সতেরো শতকেও তারা ডাচদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।
১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে ডাচরা মালয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় মালাকা দ্বীপ দখল করে নিয়েছিল। আবার আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা পূর্ব ভারত দ্বীপ তথা বলা যেতে পারে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার ওপর নিজেদের আধিপত্য বা উপনিবেশ স্থাপন করে। এভাবে তারা এই অঞ্চলের মশলাপাতি ব্যবসার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হয়। এই বিশাল এলাকার ওপর ডাচদের বাণিজ্যিক শাসন কায়েম থাকার পরও মুসলমানরা উনিশ শতক পর্যন্ত নিজেদের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বা পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল। আঁচেহ, মালয়, মিনাং কাবাউ এবং জাভার মতো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিতে বিশেষ ইসলামী সমাজ গড়ে উঠেছিল। সেই মুসলিম সমাজ একদিক থেকে যেমন অপরাপর মুসলিম সমাজের মতোই ছিল তেমনি অপরদিকে কোনো কোনো দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারীও ছিল। ১৮১৯ সালে ব্রিটিশ বাহিনীও মালাক্কা প্রণালী দখল করে নিয়েছিল। এ সময় তারা সিঙ্গাপুরে নতুন করে একটি ঘাঁটিও নির্মাণ করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে তারা সমগ্র মালয়ব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসেছিল। ডাচ সরকারও ১৯১১ সালের মাথায় পূর্ব ভারতের সমগ্র দ্বীপাঞ্চল তথা ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওপর প্রথমবারের মতো নিজেদের পরিপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এই পুরো অঞ্চলের ওপর একক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল তারা।ঐতিহাসিক ডাঃ ক্যারুল কার্স্টেন বলেছেন যে, নবী মুহাম্মদের শিক্ষাগুলি কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল সে সম্পর্কে আকর্ষণীয় বিষয়টি হল এটি কোনও বিজয়ের সাথে জড়িত ছিল না এবং ধীরে ধীরে এবং আশ্চর্যরকমভাবে এটি হয়েছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ১১টি। আছে দুটি টেরেটরি ও একটি প্রশাসনিক এলাকা। এখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত রাষ্ট্র চারটি- মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওস। মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র তিনটি- ইন্দোনেশিয়া,মালয়েশিয়া ও ব্রুনাই।খ্রিস্টান প্রভাবিত রাষ্ট্র দুটি- ফিলিপাইন ও পূর্ব তিমুর।হিন্দু ধর্ম (ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ ও অন্যত্র)।মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুসলমানের দেশ ইন্দোনেশিয়া ও সবচেয়ে কম মুসলমান বসবাসকারী দেশ লাওস এই অঞ্চলেই অবস্থিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ইসলাম সর্বত্র বহুল প্রচলিত ধর্ম। প্রায় ২৪১ মিলিয়ন মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ৪২% মুসলমান।মুসলমানরা ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার পাশাপাশি থাইল্যান্ডের পট্টানি এবং ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ের কিছু অংশে বেশি সংখ্যক মুসলমানের বাস।বেশিরভাগ মুসলমান সুন্নি এবং শাফিয়ী মাযহাবের ফেকাহ বা ধর্মীয় আইন অনুসরণ করে।ইসলাম মালয়েশিয়া এবং ব্রুনাইয়ের রাষ্ট্রীয় ধর্ম । ইন্দোনেশিয়ার ছয়টি ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে ইসলাম অন্যতম।বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় ৮৮%, ব্রুনেই ৭৮%, মালয়েশিয়া ৬৩%, সিঙ্গাপুর ১৪.৩% ,থাইল্যান্ড ১২% , ফিলিপাইন ১১% , মায়ানমার ৪.৩% , কম্বোডিয়া ১.৯% , পূর্বতিমুর ০.৩% , ভিয়েতনাম ০.১% ও লাওসে ০.০১% মুসলমান বাস করে।
Banda Aceh Grand Mosque
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া।আয়তন ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৯৪০। সরকারি ভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু বেশির ভাগ ইন্দোনেশীয় স্থানীয় মাতৃভাষায়ই কথা বলে।বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশের বসবাস এই দেশটিতে। মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশই মুসলমান। বিশ্বের বুকে এটিই প্রথম সংখ্যাধিক্য মুসলমানের দেশ। সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ইন্দোনেশিয়া থেকে দুই লাখ ২১ হাজার নর-নারী হজে যান।হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষভাগে ইয়েমেনের আরব ব্যবসায়ীরা নোঙর ফেলেন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে। তাঁদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়।হিজরি নবম শতকে পুরো অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। সুলতান হারুন তুরনাথ ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে প্রতারণার মাধ্যমে হত্যা করে পর্তুগাল ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয়। সুলতান হারুনের হত্যার মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। তবে ব্রিটিশ আর ডাচরা তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও ধর্ম ও সংস্কৃতিতে তারা কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি।১৫৮০ থেকে কয়েক শতাব্দীকালের ঔপনিবেশিক শাসনের পর ১৯৪৯ সালে ডাচদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি।
মালয়েশিয়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। বহু জাতির ও বহু ভাষার মানুষের বসবাস মালয়েশিয়ায়।পুরো মালয় দ্বীপপুঞ্জ এক সময় মালয়েশিয়া নামে পরিচিত ছিল; তবে পরবর্তীকালে, এর সীমানা ভৌগোলিকভাবে খর্বিত হয়। এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটেন উপনিবেশের অধীনস্থ অংশই মালয়েশিয়া নামে পরিচিত হয়।যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে ১৩ টি রাজ্য এবং তিনটি ফেডারেল অঞ্চল নিয়ে গঠিত।যার মোট আয়তন ৩,২৯,৮৪৫ বর্গকিমি। জনসংখ্যা প্রায় ৩২ মিলিয়ন। দাপ্তরিকভাবে মালয়েশিয়া একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হলেও ইসলাম এর আনুষ্ঠানিক ধর্ম। মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৩% ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া ১৯.৮% জন বৌদ্ধ, ৯.২% জন খ্রিষ্টান, ৬.৩% জন হিন্দু এবং বাকিরা অন্যান্য ধর্ম পালন করে থাকে। সকল ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-আচরন পালন করার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন এখানে।মালয়েশিয়ায় সুন্নী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ।মালয়েশিয়া শরিয়াহ ভিত্তিক সকল কাজে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরন করে থাকে।ইসলাম ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় আলোচনা কিংবা যেকোন ধরনের সমস্যা নিষ্পত্তিতে ‘শরীয়াহ আদালত’র সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। তবে শরিয়াহ আদালতের কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত বিয়ে,সম্পত্তির উত্তরাধিকার,বিয়ে বিচ্ছেদ, ধর্মীয় আলোচনা প্রভৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ।উপদ্বীপীয় মালয়েশিয়া ১৯৪৬ সালে মালায়ান ইউনিয়ন হিসাবে একীভূত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে মালয় ফেডারেশন হিসাবে মালয়েশিয়া পুনর্গঠিত হয় এবং ৩১ আগস্ট ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়া, উত্তর বর্নিও, সারাওয়াক এবং সিঙ্গাপুরের সাথে একত্রিত হয়ে মালয়েশিয়ায় পরিণত হয়। ১৯৬৫ সালে, সিঙ্গাপুরকে ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
The Islamic Arts Museum Malaysia (IAMM)
ব্রুনাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটি বোর্নিও দ্বীপের উত্তর উপকূলে অবস্থিত। এর উত্তরে দক্ষিণ চীন সাগর, এবং বাকী সব দিকে মালয়শিয়া।এটি একটি রাজতান্ত্রিক ইসলামী দেশ।১৫শ শতাব্দীতে যখন একজন মালয় মুসলিম সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হন, তখন থেকেই ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৫৯-এর সংবিধান মোতাবেক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।২০১৪ সালের ৩০শে এপ্রিল, সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ ১লা মে ২০১৪ থেকে ব্রুনাইয়ে প্রথম ধাপে শরিয়া আইনকানুনকে বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগের ঘোষণা দেন।ব্রুনাইয়ের মোট আয়তন ৫,৭৬৫ বর্গ কিলোমিটার।জনসংখ্যা বর্তমানে জনসংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬২০ জন।মোট জনসংখ্যার ৭৮.৮ ভাগ মুসলিম।এমনকি বেশিরভাগ লোক মালয় বংশোদ্ভূত সুন্নি মুসলিম যারা শাফেয়ী মতাদর্শ অনুসরণ করে। অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের মধ্যে অধিকাংশ মালয় ব্রুনাই, মালয় কেদায়ান (দেশীয় উপজাতি থেকে ধর্মান্তরিত) এবং চীনা ধর্মান্তরিতরা অন্তর্ভুক্ত। ব্রুনাই তেল সম্পদে সমৃদ্ধ একটি ধনী রাষ্ট্র। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে এটি এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ হিসেবে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৪ সালে এসে দেশটি স্বাধীন হয়।

ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মিন্দানাও দ্বীপেও ইসলামের প্রসার ঘটে। পরবর্তীকালে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত ও পারস্য থেকে মুসলমানরা ফিলিপাইনে গমন করেন। এভাবে ফিলিপাইনে ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।বর্তমানে জনসংখ্যার প্রায় ৮১ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক। মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ১১ শতাংশ হলেও ইসলাম দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। ফিলিপাইনের একটি সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম মরো। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জে এদের বাস।মরো শব্দটি স্পেনীয়দের উদ্ভাবন। অতীতে মুসলিম স্পেন ও পর্তুগালের মুসলমানদের মুর বলা হতো। সেখান থেকে স্থানীয় বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠীকে একত্রে মরো জনগোষ্ঠী হিসেবে সম্বোধন করা হয়।মিন্দানাও দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ এবং এর আয়তন ৯৭ হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। এর রাজধানীর নাম সুলু। জনসংখ্যা দুই কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার (২০১৮)। জনসংখ্যার ৯৮ ভাগই মুসলমান।মুসলমানদের দ্রুত উত্থান দুশমনদের কাছে অসহ্য বলে মনে হলো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫৯৬ সালে মিন্দানাওয়ের স্পেনীয় শাসক মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। পরবর্তীকালে ডাচ ও স্পেনীয় শাসকরা যৌথভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে ১৬৩৭ সালে মিন্দানাও এবং ১৬৩৮ সালে সুলুর পতন ঘটে।ষোড়শ শতক থেকে উনাবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত স্পেনীয় ঔপনিবেশিক শাসনামলে তারা স্পেনীয় কায়দায় স্থানীয় অধিকাংশ জনগণকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করে। ফিলিপিনে স্পেনীয় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দমন ও নির্যাতনের মাধ্যমে এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা হয়।১৯৪৯ সালে ফিলিপাইন স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পরপরই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি ওঠে। ফলে ম্যানিলা সরকারের সাথে মুসলমানদের সঙ্ঘাত শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে তা সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ নেয়।উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৫০ বছর মিন্দানাওয়ে সঙ্ঘাতের ফলে এক লাখ ৫০ হাজার মুসলমান নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
থাইল্যান্ড মূলত বৌদ্ধদের দেশ।রাজকীয়ভাবে পাঁচটি ধর্মকে সহযোগিতা করা হয়। এগুলো হলো বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু ও শিখ। ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী তেরাভাদা বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী।ইসলাম এ দেশে বিকাশমান ধর্ম। ৫,১৪,০০০ বর্গকিলোমিটারের রাজতন্ত্রের দেশ থাইল্যান্ডে ৭ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৭৫ লাখ মুসলিম অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ।বৌদ্ধ ৮৭ শতাংশ, খৃষ্টান ০.৭২ শতাংশ এবং অন্যান্য ০.০৮ শতাংশ। গোটা থাইল্যান্ডে মসজিদের সংখ্যা তিন হাজার ৪৯৪। শুধু ব্যাংককেই রয়েছে ১৭০টি মসজিদ।থাইল্যান্ডের দক্ষিণের মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী সোংকা, পাতানি, ইয়ালা ও নারাথিওয়াট প্রদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। বেশির ভাগ অধিবাসীর ভাষা মালয়।সেখানকার মোট জনগোষ্ঠীর ৭৫ শতাংশ মুসলিম।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক আদমশুমারী অনুযায়ী থাইল্যান্ডের মুসলিম প্রধান তিনটি রাজ্য পাতানি, নারাথিওয়াট ও ইয়ালার জনসংখ্যা হল- পাতানি মুসলিম ৫ লাখ, বৌদ্ধ ১ লাখ ৩০ হাজার ও খ্রিস্টান ৪ হাজার; নারাথিওয়াট মুসলিম ৬ লাখ, বৌদ্ধ ১ লাখ ও খ্রিস্টান ৩ হাজার এবং ইয়ালা মুসলিম ৩ লাখ, বৌদ্ধ ২ লাখ ও খ্রিস্টান ২ হাজার। থাইল্যান্ডের ৮০% মুসলমান এ অংশে বাস করে।এখানে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয় ২০০৪ সালে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের সম্পর্কে আরো জানতে পড়তে পারেন-

১. https://harkara19.blogspot.com/2020/09/blog-post_45.html
২. https://harkara19.blogspot.com/2020/09/blog-post_11.html
৩. https://harkara19.blogspot.com/2020/09/blog-post_87.html
৪. https://harkara19.blogspot.com/2020/09/blog-post_10.html
৫. https://harkara19.blogspot.com/2020/09/blog-post_41.html
৬. https://harkara19.blogspot.com/2020/09/blog-post_5.html
৭. https://harkara19.blogspot.com/2020/10/blog-post.html


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল